চাকরি চেয়ে লাঠি! কীভাবে রাতের অন্ধকারে করুণাময়ীতে অভিযান পুলিশের?

Karunamoyee TET Operation: মহিলা চাকরিপ্রার্থীদের মহিলা পুলিশ টানতে টানতে নিয়ে গেল বাসের কাছে। ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে গেল গাড়ি। তোলা হল অ্যাম্বুল্যান্সেও। সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হল সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের।

সবেমাত্র ফাঁকা আকাশের নিচে ঘুমে ঢুলেছেন ওঁরা। কারও মাথায় বালিশের কাজ করছে খবরের কাগজ। কেউ আবার জলের বোতলে মাথা দিয়েই এলিয়ে পড়েছেন ফের। চালচুলো আর সম্বল শেষ করে রাস্তায় নেমেছিলেন ওঁরা! আর ঠিক সেই মুহূর্তেই, পরদিন নতুন লড়াইয়ের স্বপ্ন বোনার স্বপ্নেই হঠাৎ ‘হামলা’! হাজির হলেন বহু মানুষ! প্রত্যেকের পরণে প্রায় এক পোশাক। রাস্তা থেকে টেনে হিঁচড়ে তুলে নিয়ে গেল ওঁদের। রাস্তায় পড়ে রইল ব্যাগ, জুতো, জলের বোতল! গড়াগড়ি খেল কলমও! বৃহস্পতিবারের, তারিখ অনুযায়ী শুক্রবারের মধ্যরাত দেখল এমনই এক মর্মান্তিক ছবি!

মর্মান্তিক কেন? এই ছবির পক্ষে কিম্বা বিপক্ষে কিছু বলা যায় কী যায় না, এ সংবাদ-সত্তায় হাজারো প্রশ্নের অবকাশ থাকলেও যে ছবি কাল দেখল গোটা দেশ, মধ্যরাতের চেঁচামেচিতে যেভাবে ঘুম ভাঙল এই রাজ্যের- তা কি শোভনীয় হল খুব একটা?

এই বিতর্ক আর আলোচনার মধ্যেই দেখে নেওয়া যাক, আদতে কী ঘটল রাতে।

বৃহস্পতিবার দুপুর। কলকাতা হাইকোর্ট। এজলাসের সওয়াল জবাবের পর বিচারপতি নির্দেশ দিলেন, সল্টলেকের করুণাময়ী অঞ্চলে প্রশাসনের জারি করা ১৪৪ ধারা মানতে হবে আন্দোলনকারীদের। যাঁরা ২০১৪ সালের টেট উত্তীর্ণ চাকরিপ্রার্থী, প্রায় ৮৪ ঘণ্টা ধরে টানা ওই অঞ্চলে চাকরির দাবিতে আন্দোলন করছিলেন তাঁরা। চাকরিপ্রার্থীদের দাবি, আদালতের নির্দেশের পর ১৪৪ ধারা জারি থাকা নির্দিষ্ট এলাকার নিয়ম মেনেই আন্দোলনে বসেন তাঁরা। ভালোই ভালোই চলছিল সব।

বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা। স্লোগান আর দাবির রোষানলে উত্তপ্ত হয় করুণাময়ী। সরকারের কেন তাঁদের উপর করুণা নেই, কেন ন্যায্য অধিকার পাইয়ে দেওয়া যায় না, এই প্রশ্নেই সরব হন আন্দোলনরতরা।

আরও পড়ুন- অপরাধ সিপিআইএম করা, তাই বাবা-মাকে পুড়িয়ে মারা হয়েছে: দীপঙ্কর দাস

বৃহস্পতিবার রাত ১০টা। প্রায় শুনশান এলাকায় কয়েকজন সংবাদকর্মী, গুটিকয়েক পুলিশকর্মী আর আন্দোলনকারী ছাড়া কেউ নেই। চারিদিক নিস্তব্ধ। সন্ধ্যার তেজ তখন কমেছে খানিকটা। কারণ, লড়াইয়ের প্রস্তুতি চলছে ফের।

বৃহস্পতিবার রাত ১০.১০। হঠাৎ গুঞ্জন! এত পুলিশ কেন! মুহূর্তেই ভরে গেল চারপাশ। শুনশান করুণাময়ীর নিস্তব্ধতা ভেঙে দিল ভারী বুটের শব্দ।

বৃহস্পতিবার রাত ১১টা। আরও বাড়ল পুলিশকর্মীর সংখ্যা। প্রত্যেকেই কেমন যেন প্রস্তুত! মাথায় হেলমেট। হাতে লাঠি। কারও কারও সঙ্গে কাঁদানে গ্যাসের শেল!

বৃহস্পতিবার রাত ১১টা ৫০। আগের মতোই ফের মাইকিং শুরু করল পুলিশ। বলা হল, “কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করব, উঠে যান এক্ষুণি।”

বৃহস্পতিবার ১২টা ০৫। পুলিশ আটকাতে মানব বন্ধন করে দাঁড়ালেন বিজেপি কর্মীরা। ধাক্কাধাক্কি শুরু করল পুলিশ।

বৃহস্পতিবার রাত ১২টা ১০। ততক্ষণে ঘড়ির কাঁটা এবং ক্যালেন্ডার বলছে শুক্রবারে পা দিয়েছি আমরা। ফের মাইকিং। এবার সময় হাতে ২ মিনিট।

বৃহস্পতিবার রাত ১২টা ১৪। শুরু হল অভিযান। একের পর এক আন্দোলনকারীদের টেনে হিঁচড়ে তোলা হল পুলিশের সঙ্গে আসা বাসে। চলল ধ্বস্তাধ্বস্তি। চিৎকার। প্রতিরোধ। পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে গেল পুলিশ। মহিলা চাকরিপ্রার্থীদের মহিলা পুলিশ টানতে টানতে নিয়ে গেল বাসের কাছে। একসঙ্গে বন্দি হলেন ওঁরা। ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে গেল গাড়ি। তোলা হল অ্যাম্বুল্যান্সেও। সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হল সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের। রকেটের গতিতে কাজ করল পুলিশ। নিয়ে যাওয়া হল একরাশ স্বপ্ন আর দাবিতে মশগুল থাকা বিক্ষোভকারীদের।

শুক্রবার হয়েছে তখন। ঘড়ির কাঁটায় রাত ১২টা ৫৫। ফের শুনশান করুণাময়ী। নিস্তব্ধ মেট্রো স্টেশনের আলো আর রাস্তার আলোর মাঝে ছড়িয়ে হাওয়াই চপ্পল, জলের বোতল, ছাতা, আর কর্মের সন্ধান পাওয়া যায় এমন খবরের কাগজ!

কাজের সন্ধান ওঁরা পেয়েছিলেন। কিন্তু অভিযোগ, কাজ পাননি। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও নাকি চাকরি হয়নি ওঁদের, দাবি ছিল এমনই। আর সেই দাবিতেই আন্দোলনে নেমেছিলেন ওঁরা। তার পরিণতিতে দেখা গেল পুলিশের অপারেশন টেটের এই ঐতিহাসিক স্মৃতি!

আরও পড়ুন- দুর্নীতির আখ্যানে নয়া চরিত্র! যেভাবে সিবিআইয়ের জালে এলেন ‘কালো মানিক’!

প্রসঙ্গত, রাজ্য প্রাথমিকে নিয়োগ এবং টেট সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগে তোলপাড়। ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার হাতে গ্রেফতার হয়েছেন রাজ্যের তৃণমূল বিধায়ক তথা প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রাক্তন সভাপতি মানিক ভট্টাচার্য। তাঁর শীর্ষ আদালতে করা গ্রেফতারি সংক্রান্ত আবেদন ইতিমধ্যেই খারিজ করেছে আদালত। লক্ষ লক্ষ টাকা নিয়ে, মানুষ ঠকিয়ে চাকরি দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। ঠিক এর সঙ্গেই মাথাচাড়া দিয়েছে এসএসসি নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতিও। সেই ঘটনার তদন্তেও নেমেছে সিবিআই, ইডি। কোটি কোটি টাকা উদ্ধারের ছবি দেখেছে এই রাজ্য। গ্রেফতার হয়েছেন স্বয়ং রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়। সঙ্গে গারদে গিয়েছেন তাঁর ঘনিষ্ঠ অর্পিতা মুখোপাধ্যায়ও। এর সঙ্গেই উঠে এসেছে গরু, কয়লা পাচার দুর্নীতির অভিযোগ। একাধিক বিতর্ক আর প্রশ্নের মুখে পড়েছে মমতার সরকার। সরব হয়েছেন বিরোধীরা। ঠিক এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে ফের অস্বস্তি বাড়ায় ২০১৪-এর প্রাথমিকে পাশ করা চাকরিপ্রার্থীরা। প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের দফতরের কাছে আন্দোলনে বসেন ওঁরা। তারপর শুরু হয় অনশন। চাপে পড়ে সরকার, প্রশাসন, আদালতে গড়ায় মামলা। ফের মাথাচাড়া দেয় ১৪৪ ধারা ইস্যু। এর মধ্যেই ওই অবস্থানে সামিল হন বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা।

বৃহস্পতিবার রাতেই ওই অবস্থানে সামিল হয় বিজেপি। যান বাম নেতারাও। কংগ্রেসের তরফেও অনেকেই উপস্থিত হন করুণাময়ীতে। পুলিশের সংখ্যা বাড়তে থাকলে মানব বন্ধন করে আটকায় বিজেপি। মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায় দেন হুঁশিয়ারি। কিন্তু ৮৪ ঘণ্টার টানাপড়েন মাত্র ১০ মিনিটেই তুলে দিল পুলিশ। কর্তাদের নির্দেশে তাঁদের বাহিনী সফল হলেও প্রশ্ন উঠছে ওঁরা তো জঙ্গি নন, ওঁরা তো অপরাধী নন, আর যদিও সেটা হতেন তাহলেও কি এমনটা করা যায়!

More Articles