কিনেছিলেন এক হাজার টাকার বন্ড! যেভাবে দুর্নীতির পর্দা ফাঁস করলেন সাংবাদিক পুনম

Electoral Bond: পুনম জানিয়েছিলেন, তিনি দিল্লির একটি এসবিআই শাখায় গিয়েছিলেন ইলেক্টোরাল বন্ড কেনার জন্য। বন্ড বিক্রি করার আগে তাঁর কাছ থেকে সমস্ত কেওয়াইসি নেওয়া হয়।

লোকসভা ভোটের আর দেরি নেই। ঘোষণা সারা, প্রার্থীতালিকা তৈরি। অযোধ্যায় রামজন্মভূমি দিয়ে ইনিংসের শুরুটা একেবারে ঠিকঠাক হয়েছিল বিজেপির। তবে গোল বাঁধালো এই ইলেক্টোরাল বন্ড দুর্নীতি মামলা। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে বিজেপি সরকারের এই প্রকল্পকে বেআইনি ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্ট। স্বাভাবিক ভাবে লোকসভা ভোটের ঠিক আগে বন্ড কেলেঙ্কারি বেশ অস্বস্তিতে ফেলেছে বিজেপিকে। সাত তাড়াতাড়ি সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট (CAA) কার্যকর করে জনগণের মাথা ঘোরানোর চেষ্টা করেছিল বটে বিজেপি সরকার, তবে কাজের কাজ কিছু হয়নি। সুপ্রিম কোর্টের কড়াকড়ির মুখে এসবিআই বাধ্য হয়েছে ইলেক্টোরাল বন্ড সম্পর্ক সমস্ত তথ্য এবং নথি সামনে আনতে। সেসব উঠেছে নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটেও। হাজার হাজার কোটি টাকার খেলা জনগণের সামনে পরিষ্কার। তবুও যেটুকু ধোঁয়াশা রয়ে গিয়েছে,তার উপর থেকেও পর্দা সরাতে চায় শীর্ষ আদালত। কোন কোন ব্যবসায়িক সংস্থা বা ব্যক্তিবিশেষের কাছ থেকে উপকৃত হয়েছে কোন কোন রাজনৈতিক দল, তার খতিয়ানও স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার কাছ থেকে চেয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যেই সামনে আসার কথা সেই তথ্যের।

বিজেপির এই ইলেক্টোরাল বন্ড প্রকল্প যে দুর্নীতির শর্টকাট এমনটা অনেকদিন ধরেই দাবি করে আসছিলেন সাংবাদিকদের একটি অংশ। তবে লোকসভা ভোটের আগে এই দুর্নীতিকে প্রকাশ্যে আনার নেপথ্যে যে সাংবাদিকের প্রত্যক্ষ হাত ছিল, তিনি পুনম আগরওয়াল। 'দ্য কুইন্ট' নামে একটি স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের 'ইনভেস্টেগেটিভ জার্নালিস্ট' হিসেবে কাজ করতেন পুনম। ২০১৮ সাল নাগাদ একটি প্রতিবেদনের জন্য এক হাজার টাকা দামের দু'টি ইলেক্টোরাল বন্ড নিজেই কিনে বসেন পুনম। তার পর রাজনীতির নদীতে বয়ে গিয়েছে বহু জল। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দেয় এসবিআই-কে ইলেক্টোরাল বন্ড সংক্রান্ত সমস্ত নথিপত্র প্রকাশ করতে। নানা টালবাহানার পর অবশেষে সেই নথি প্রকাশ করেছে এসবিআই। ইলেকশন কমিশনের ওয়েবসাইটে তুলে দেওয়া হয়েছে সেই নথি। মোট দু'টি নথি প্রকাশ করেছে এসবিআই। তার মধ্যে একটি তালিকায় রয়েছে বন্ডের মাধ্যমে রাজনৈতিক অনুদানকারীদের নাম, অনুদানের পরিমাণ ও বন্ড কেনার তারিখ। দ্বিতীয় তালিকায় রয়েছে, কোন দল ইলেক্টোরাল বন্ড থেকে কত টাকা পেয়েছে তার হিসেব।

আরও পড়ুন: SBI-এর কাছে সমস্ত বন্ডের আলফা-নিউমারিক নম্বর চাইল সুপ্রিম কোর্ট, কী এই ইউনিক কোড?

সেই তালিকায় দেখা যাচ্ছে, ক্রেতাদের তালিকায় নাম রয়েছে পুনম আগরওয়ালের। তবে তার নামের পাশে উল্লেখ করা হয়েছে ২০২০ সালের ২০ অক্টোবর তারিখটিকে। অথচ পুনম বন্ডটি কিনেছিলেন ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে। একই অঙ্কের বন্ড, একই নাম অথচ তারিখের এই অসঙ্গতিকে তুলে ধরে এসবিআইয়ের রিপোর্টের সত্যতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে দিয়েছেন পুনম। এসবিআইয়ের রিপোর্ট সামনে আসার পরেই ওই অসঙ্গতির কথা তুলে ধরে মাইক্রোব্লগিং সাইট এক্সে পুনম জানান, খুবই কাকতালীয় ব্যাপার না হলে এমনটা হওয়া সম্ভব নয়। অর্থের পরিমাণ এক, ক্রেতার নাম এক, কিন্তু তারিখের ক্ষেত্রে এত বড় অসঙ্গতি কীভাবে সম্ভব। যদি না একই নামে অন্য কোনও ক্রেতা ওই একই পরিমাণ অর্থের বন্ড না কিনে থাকেন। যেহেতু স্টেট ব্যাঙ্ক বন্ডের উপর থাকা ওই ইউনিক আলফা নিউমারিক নাম্বারটি প্রকাশ্যে আনেনি, ফলে এই অসঙ্গতি যাচাইয়ের কোনও উপায় নেই বলেও জানান পুনম।

সোমবার সুপ্রিম কোর্ট স্টেট ব্যাঙ্ককে ওই ইউনিক আলফা নিউমারিক নম্বরটিই প্রকাশ্যে আনতে বলেছে। আগামী বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সময় দেওয়া হয়েছে এসবিআইকে। তার মধ্যেই ওই ডেটা প্রকাশ করতে হবে ভারতীয় স্টেট ব্যাঙ্ককে। ওই নথি হাতে আসার সঙ্গে সঙ্গে তা নির্বাচন কমিশনকে ওয়েবসাইটে প্রকাশ করারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রাথমিক ভাবে এসবিআই জানিয়েছিল, ওই নম্বরটির নথি তারা রেকর্ডে রাখেনি। পরে অবশ্য সুপ্রিম-তোপের মুখে সেই নথি রাখার কথা মেনে নেয় স্টেট ব্যাঙ্ক। পুনম একটি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, কীভাবে তিনি বন্ডের উপর ওই ইউনিক নম্বরটি আবিষ্কার করেন। আসলে প্রতিটি বন্ডের উপরেই ওই আলফা-নিউমেরিক্যাল নাম্বার থাকে, যা প্রতিটি বন্ডের ক্ষেত্রে আলাদা আলাদা। সেই ইউনিক কোড একমাত্র অতিবেগুনি রশ্মির সামনেই ফুটে ওঠে। ওই নম্বরের মাধ্যমেই একমাত্র জানা সম্ভব যে ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে কোন দলকে কে অনুদান দিয়েছে তা জানা। এমনকী তাঁর কেনা ইলেক্টোরাল বন্ডে যেমন অসঙ্গতি ধরা পড়েছে, তেমন আরও কোনও অসঙ্গতি রয়েছে কিনা, তা-ও জানা যাবে ওই তথ্য সামনে এলে।

পুনম জানিয়েছিলেন, তিনি দিল্লির একটি এসবিআই শাখায় গিয়েছিলেন ইলেক্টোরাল বন্ড কেনার জন্য। দিল্লির একমাত্র ওই শাখাটিতেই ইলেক্টোরাল বন্ড বিক্রি করা হচ্ছিল। দেশের নাগরিক হিসেবেই ওই বন্ড কিনতে গিয়েছিলেন পুনম। ব্যাঙ্কের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কেন এই বন্ড তিনি কিনতে চান? পুনম জানান, রাজনৈতিক দলগুলিকে বন্ডের মাধ্য়মে অনুদান দিতে চান তিনি। বন্ড বিক্রি করার আগে তাঁর কাছ থেকে সমস্ত কেওয়াইসি নেওয়া হয়। কোথা থেকে তিনি বন্ডের কথা জানতে পারলেন, তা-ও জিজ্ঞেস করা হয়েছিল ব্যাঙ্ককর্তাদের তরফে। তারপরেই পুনমের কাছ থেকে এক হাজার টাকার চেকটি নেওয়া হয়।

পরবর্তীকালে কৌতূহলের বশবর্তী হয়েই ওই বন্ডটি ফরেন্সিক পরীক্ষার জন্য পাঠান পুনম। সেখান থেকেই তিনি জানতে পারেন, ওই এক হাজার টাকার বন্ডটির উপরে একটি লুকানো ইউনিক নম্বর রয়েছে, যা একমাত্র ইউভি রশ্মির সামনে ফেললেই দেখা যাবে। সেই নম্বরটি ইউনিক, তার প্রমাণ পাওয়ার জন্য এরপর আরও একটি এক হাজার টাকার বন্ড কেনেন পুনম। স্বাভাবিক ভাবেই সেটিরও ফরেন্সিক পরীক্ষা করেন পুনম। দেখা যায়, দু'টি বন্ডের উপর ছাপা নম্বর একে অপরের থেকে আলাদা। বুঝতে পারেন, প্রতিটি বন্ডের উপরেই রয়েছে এমন একটি করে ইউনিক আলফা নিউমারিক্যাল নম্বর। তথ্য় জানার অধিকার আইনে প্রশ্ন করা হলে, এসবিআই স্বীকার করেছে, এই ইউনিক নম্বরগুলি রেকর্ডে রেখেছিল এসবিআই। অবং তা অডিটের ব্যবহার হওয়ার কথা। অর্থ মন্ত্রক অবশ্য জানায়, ইলেক্টোরাল বন্ডের একটি সিকিওরিটি ফিচার ওই ইউনিক আলফা নিউমারিক্যাল নম্বর।

আরও পড়ুন: নির্বাচনী বন্ডের নামে কীভাবে তোলাবাজি চক্র চালাচ্ছিল মোদি-শাহের বিজেপি?

সাংবাদিক হিসেবে পুনম অতদিন আগে যে তথ্য এবং সত্য খুঁজে বের করে এনেছিলেন ফরেন্সিক পরীক্ষার মাধ্যমে, তা অবশেষে সকলের সামনে আসতে চলেছে। সুপ্রিম কোর্ট সোমবারই জানিয়ে দিয়েছে, বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটার মধ্যে ওই ইউনিক নম্বর-সহ বাকি সমস্ত তথ্য প্রকাশ করতে হবে এসবিআই-কে। এমনকী হলফনামা দিয়ে এ-ও জানাতে হবে যে তারা এই সংক্রান্ত আর কোনও তথ্য গোপন করেনি। হাজার হাজার কোটি টাকার খেলা হয়েছে এই ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে। যার ৪৮ শতাংশই গিয়েছে বিজেপির কোষাগারে। তার পরে তালিকায় রয়েছে তৃণমূল ও কংগ্রেস। যথাক্রমে ১২ ও ১১ শতাংশেরও বেশি অর্থ কোষাগারে পুরেছেন তারা এই বন্ড প্রকল্পের মাধ্যমে। নামী-বেনামী বহু সংস্থা ও ব্যক্তি কোটি কোটি টাকার ইলেক্টোরাল বন্ড কিনেছেন। কোথা থেকে এসেছে এই টাকা? কালো টাকা দমনে উদগ্রীব বিজেপি সরকার আদতে কি ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে কালা টাকার কারাবারিদের কাছেই নোট ফর্সা করার একটা উপায় করে দিয়েছিলেন? এত কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে তারাই বা কোন কোন সুবিধা নিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলির কাছ থেকে। স্বাভাবিক ভাবেই এই সব প্রশ্নের উত্তর মিলতে চলেছে খুব শিগগিরই। সাংবাদিক হিসেবে একদিন যে প্রশ্নগুলি তুলে দিয়েছিলেন দুনিয়ার সামনে, সেই প্রশ্নগুলি লোকসভা ভোটের আগে আদৌ কতটা বিপাকে ফেলতে চলেছে কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকা বিজেপি সরকারকে? সেটাই এখন দেখার।

More Articles