পঞ্চমবার প্রেসিডেন্ট হয়েই তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের হুমকি! যেভাবে রাশিয়ায় জয়ী হলেন পুতিন?

Vladimir Putin, Russia: রাশিয়ার দু'শো বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকতে চলেছেন পুতিন। সেই ১৯৯৯ সালে ক্ষমতায় বসেছিলেন তিনি। তার পর থেকে একবারও প্রেসিডেন্ট পদ থেকে টলানো যায়নি এই রাষ্ট্রনেতাকে।

ইউক্রেনের সঙ্গে ভয়াবহ যুদ্ধ, লক্ষ লক্ষ সেনার মৃত্যুতে বিশ্ব রাজনীতিতে জোরদার সমালোচনা থেকে একঘরে হয়ে যাওয়া, কোনও কিছুই ঠেকাতে পারল না তাঁর জয়। বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে পঞ্চমবার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট হলেন ভ্লাদিমির পুতিন। আর ভোটে জিতেই ঘোষণা করে দিলেন, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আর দেরি নেই।

তাঁকে নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। কেউ বলেন, পুতিন আর বেঁচে নেই। তাঁর বডি ডবলদের দিয়েই রাষ্ট্র চলছে। নববর্ষ উপলক্ষে দেশবাসীর উদ্দেশে স্বল্প সময়ের যে ভাষণ দিয়েছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন, তা নাকি এআই জেনারেটেড। এমন একটা বিতর্ক তৈরি হয়েছিল সেসময় থেকেই। ফলে পুতিনের না থাকার সংশয় আরও ঘনীভূত হয়। তবে দিনের শেষে পুতিন যে আছেন, তা তিনি জিতেই প্রমাণ করে দিলেন। গত শুক্রবার থেকে রবিবার পর্যন্ত টানা তিন দিন ধরে অনুষ্ঠিত হয়ে রাশিয়ার ভোট-উৎসব। আর সেই ভোটে প্রায় ৮৭.৮ শতাংশই গিয়েছে রুশ প্রেসিডেন্টের পক্ষে।

রাশিয়ার দু'শো বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় থাকতে চলেছেন পুতিন। সেই ১৯৯৯ সালে ক্ষমতায় বসেছিলেন তিনি। তার পর থেকে একবারও প্রেসিডেন্ট পদ থেকে টলানো যায়নি এই রাষ্ট্রনেতাকে। ২০২২ সাল থেকে ইউক্রেনের সঙ্গে ফের সশস্ত্র সংগ্রামে জড়ায় পুতিন বাহিনী। নৃশংস ভাবে হামলা করা হয় ইউক্রেনে। এমনকী পরমাণু হামলারও হুমকি দিয়েছিলেন রুশ প্রেসিডেন্ট। তার জেরে বিশ্বমঞ্চে কোণঠাসা হয়েছেন পুতিন। আমেরিকা, ব্রিটেন থেকে শুরু করে একাধিক ছোট-বড় দেশ বিরোধিতা করেছে রাশিয়ার এই পদক্ষেপে। রাশিয়ার সঙ্গে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলদিমির জেলেনেস্কি। প্রায় ৩১ হাজার সেনারই শুধু মৃত্যু হয়েছে এই যুদ্ধে। সাধারণ নাগরিকেরা যে কত মরেছেন, কত গৃহহারা হয়েছেন, তার কোনও সীমাপরিসীমা নেই।

আরও পড়ুন: পেশায় কাঠমিস্ত্রি পুতিনের ‘বডি ডবল’! রুশ প্রেসিডেন্টের অবর্তমানে তাঁর হাতেই কি দেশের রাশ?

রাশিয়ার ক্ষতিও কোনও অংশে কম হয়নি। স্বাধীন রুশ সংবাদ সংস্থা মিডিয়াজোনার হিসেব বলছে, ২০২২-২০২৩ জুড়ে যুদ্ধ করতে গিয়ে অন্তত ৭৫ হাজার রুশ সেনা বলি হয়েছে। অন্য দেশ থেকে বাসিন্দাদের কাজের আশা দিয়ে রাশিয়ায় নিয়ে গিয়ে যুদ্ধ করানো হচ্ছে তাদের দিয়ে বলেও অভিযোগ। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশ্বরাজনীতির মঞ্চে কোণঠাসা করা হয়েছে রাশিয়াকে। পুতিনের বিরুদ্ধে আমেরিকা থেকে শুরু করে বহু দেশই খড়্গহস্ত। তাতে কী! তার পরেও বিপুল ভোটে জয় পান পুতিন। ভেঙে দেন সর্বকালের ইতিহাস। হবে না-ই বা কেন!

আদতে ভোটের ময়দানে তেমন কোনও বিরোধীই ছিল না পুতিনের। জানা গিয়েছে, এই নির্বাচনের আগেই রুশ কারাগারে মৃত্যু হয়েছিল পুতিন বিরোধী নেতা অ্যালেক্সি অ্যালেক্সি নাভালনির। স্বৈরাচারীর সমস্ত শর্ত মেনেই কোনওদিনই কোনও রাজনৈতির প্রতিদ্বন্দ্বিকেই মাথা তুলতে দেননি পুতিন। পুতিনের বেশির ভাগ রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীই হয় মারা গিয়েছেন, নয় তাঁরা জেলবন্দি। কয়েকজনকে নির্বাসনেও পাঠিয়েছেন পুতিন। যে বা যারা সরব হতে চেয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে, তাদের তীব্র দমনপীড়নের মুখে পড়তে হয়েছে। ফলে এই ভোটে পুতিনের নিরঙ্কুশ জয় যে কেবল সময়ের অপেক্ষা ছিল, তাতে আর সন্দেহ কী!

জয়ের পর দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন পুতিন। তিনি বলেছেন, ‘এই সমর্থনের জন্য এবং আমার ওপর বিশ্বাস রাখার জন্য আপনাদের সবাইকে, সব নাগরিককে ধন্যবাদ জানাতে চাই।’ পুতিন জিতেছেন। নিরঙ্কুশ ভাবেই জিতেছেন। কিন্তু রাশিয়ার মানুষ চেয়েছেন বলেই জিতেছেন, এমনটা কিন্তু নয়। রাশিয়ার এই গোটা ভোটপ্রক্রিয়া আদপেই ততটা শান্তিপূর্ণ ছিল না। ভোটের প্রথম দিনেই বিভিন্ন ভোট কেন্দ্রে তাণ্ডব চলে। গ্রেফতার হয় অন্তত ৮ জন। যদিও বেসরকারি হিসেবে সেই সংখ্যাটা আরও বেশি বলেই দাবি। ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের উদ্দেশেই পরিকল্পিত ভাবে গন্ডগোল চালানো হয়। সরকারি সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, ব্যালট বাক্সে সবুজ রং ফেলা থেকে ঝামেলার সূত্রপাত। এর পরে ব্যালটও জ্বালিয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ। পরিস্থিতি সামলাতে দ্রুত পুলিশ ডাকা হয়। বিস্ফোরণেরও খবর মিলেছে। বেশির ভাগ গন্ডগোলের ঘটনাই মস্কোয় ঘটেছে। এ ছাড়া দক্ষিণ রাশিয়ার ভোরোনেজ় এবং উত্তর ককেশাস অঞ্চলে কারাচায়-চার্কেসিয়া অঞ্চলেও বেশ কিছু অশান্তির ঘটনা ঘটেছে।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমের দাবি, রাশিয়ায় তাণ্ডবের অন্তত ছ’টি ঘটনার ফুটেজ খতিয়ে দেখেছে তারা। তার মধ্যে রয়েছে একটি ভিডিয়োও। সেখানে দেখা গিয়েছে, সেন্ট পিটার্সবার্গের ভোট কেন্দ্রের কাছে এক মহিলা পেট্রল বোমা ছুড়ছে। আরও বেশ কিছু ভিডিয়োতেও দেখা যায়, ভোট কেন্দ্রের ব্যালট বাক্সে রং ঢেলে দেওয়া হচ্ছে। এমনই এক ভিডিয়োয় দেখা যাচ্ছে, মস্কোর একটি ভোট কেন্দ্রে ব্যালট বাক্সের উপরে সবুজ রং ঢেলে দিচ্ছে এক মহিলা। রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডের পাশাপাশি ইউক্রেনে রুশ অধিকৃত অঞ্চলগুলিতেও ভোটগ্রহণ হয়। এমনই এক ছোট শহর স্ক্যাডোভস্কের একটি ভোট কেন্দ্রের সামনে একটি জঞ্জালের পাত্রে আইইডি বিস্ফোরণ হয়। তবে এই ঘটনায় কেউ হতাহত হননি।

এদিকে ভোটে জিতে উন্নয়ন বা আশার কোনও কথাই শোনা গেল না রাষ্ট্রনেতার মুখে। বরং তিনি ঘোষণা করে দিলেন, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আর বেশি দেরি নেই। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণার পর থেকেই বারবার তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা শোনা গিয়েছে পুতিনের মুখে। বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সবচেয়ে বেশি বিরূপ রুশ প্রেসিডেন্ট। ভোটে জিতে বিজয়ভাষণ দেওয়ার সময় তিনি বলেন, রাশিয়া ও ন্যাটোর মধ্য লাগাতার দ্বন্দ্ব ক্রমশ পৃথিবীকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। ইউক্রেনে সেনা মোতায়েনের ব্যাপারে সম্প্রতি বারবার ন্যাটো দেশকে সতর্ক করেছেন পুতিন। কার্যত স্পষ্ট ভাবেই তিনি জানিয়েছেন, এই ধরনের পদক্ষেপ রাশিয়াকে পারমাণবিক যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাবে। এর আগেও তিনি একাধিক বার পারমাণবিক যুদ্ধের ভয় দেখিয়েছেন। পুতিনের শীর্ষ উপদেষ্টা দিমিত্রি মেদভেদেভও পশ্চিমের দেশগুলোকে ইতিমধ্যেই এই সংক্রান্ত সতর্কতা পাঠিয়েছেন। আর ক্ষমতায় এসেই ফের সেই হুমকিই যেন আবারও দিয়ে রাখলেন পুতিন।

আরও পড়ুন:এই প্রথম নয়, আগেও চেষ্টা হয়েছে হত্যার, কীভাবে বারবার সব জাল ছিঁড়ে বেরিয়ে এসেছেন পুতিন?

পুতিনের এই জয়ের সমালোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। পশ্চিমের দেশগুলি কার্যত এক সুরেই বলেছে, রাশিয়ার এই ভোট সুষ্ঠু বা অবাধ- কোনওটাই ছিল না। জার্মানি এই ভোটকে 'সাজানো নির্বাচন' বলেই তোপ দেগেছে। আমেরিকার বিদেশমন্ত্রী লর্ড ক্যামেরনের গলাতেও শোনা গিয়েছে একই সুর। ইউক্রেনের ভূখণ্ডে অবৈধ ভাবে ভোট করানোর কড়া নিন্দা করেছেন তিনি। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনেস্কির কথায়, "এটি স্বৈরশাসককে ক্ষমতায় রাখার নির্বাচন।" যদিও রাশিয়ার এই ভোটকে স্বচ্ছ ও নিরুপদ্রব বলেই বর্ণনা করেছেন পঞ্চম বার সিংহাসনজয়ী পুতিন। পুতিনের এই জয় বিশ্বরাজনীতির পক্ষে আদতে কতখানি আশঙ্কার, উঠেছে প্রশ্ন। এমনিতেই ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন যুদ্ধ নিয়ে সংকটে বিশ্ব। তার মধ্যেই কি লেগে যেতে পারে আরও বড় কোনও অশান্তি। পুতিনের তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের হুমকি বাকি দেশগুলোর কাছে আদতে কতটা ভয়ের? পুতিনের এই জয় যেন বিশ্বমঞ্চের সামনে তুলে দিয়েছে একগুচ্ছ প্রশ্ন।

More Articles