শুধু দাড়ির জন্য ব্লেডের বিজ্ঞাপনে রাজি হননি গুরুদেব
সাক্ষর সেনগুপ্ত: নেহাত শখে যে এ সব বিজ্ঞাপনে সম্মতি দিতেন, তা নয়। মূলত, প্রতিষ্ঠানের জন্য অর্থসংগ্রহই ছিল তাঁর বিজ্ঞাপন জগতে আসার কারণ। বিদেশি ও দেশীয় এয়ারলাইন্স, ভারতীয় রেল থেকে শুরু করে গোদরেজ সাবান, বোর্নভিটা, কুন্তলীন কেশ তেল, রেডিয়ম ক্রিম, বাটা-র জুতো, ডোয়ারকিন হারমোনিয়াম, সমবায় বিমা, ছাপাখানা, কটন মিল, ফটো-স্টুডিয়ো, রেকর্ড, বই, মিষ্টির দোকান, ঘি, দই, কাজল-কালি, পেন্টওয়ার্ক, এমনকি মস্তিষ্কবিকৃতি রোগের মহৌষধ পর্যন্ত হরেক পণ্য ও পরিষেবার বিজ্ঞাপনে খুঁজে পাওয়া যেত তাঁকে। অধিকাংশই প্রকাশিত হয়েছিল আনন্দবাজার পত্রিকা, অমৃতবাজার, দ্য স্টেটসম্যান, প্রবাসী, তত্ত্ববোধিনী, ক্যালকাটা গেজেট, আর বিদেশে দ্য গার্ডিয়ান, দ্য গ্লোব-এর মতো পত্রিকাতেও। ব্যক্তিত্বটি অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ আর তাঁর প্রতিষ্ঠানটির নাম বিশ্বভারতী।
নোবেল জয়ের পরে কবিগুরু যেমন বহু দেশের আমন্ত্রণে ভ্রমণ করেছিলেন, তেমনই স্বদেশে তাঁর সৃষ্টিশীলতার পূর্ণ মূল্যায়নের জন্য খানিকটা পেশাদারি পথেও হাঁটতে উদ্যোগী হন। যতটা সম্ভব গুছিয়ে কাজ করার এই চেষ্টা যথারীতি ফলপ্রসূও হয়। দেশে বিদেশে বহু বিজ্ঞাপনে তাঁকে ব্যবহার করেন নানা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধাররা। জালিয়ানওয়ালা বাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করে ব্রিটিশের দেওয়া নাইটহুড ত্যাগ করেছিলেন, সেই ঘটনার সূত্রেও এক পানীয় কোম্পানি নিজেদের বিজ্ঞাপনে লিখেছিল, ‘টেগোর হ্যাজ় গিভ্ন আপ হিজ় নাইটহুড বাট ক্যান ইউ অ্যাফোর্ড টু গিভ আপ ড্রিংকিং আওয়ার ফ্রুট?’ এতেই বোঝা যায় তাঁর বিজ্ঞাপনযোগ্যতা কেমন ছিল।
জানা যায় একবার ‘ভারত’ ব্লেড সংস্থা তাদের পণ্যের বিজ্ঞাপনের জন্য কবির কাছে গেলে তিনি তার শ্বেতশুভ্র, দীর্ঘ দাড়িতে সস্নেহে হাত বুলািয়ে বলেছিলেন, “এই দাড়ি নিয়ে আমি যদি বিজ্ঞাপন করি তাহলে কেউ কি তোমাদের ব্লেডের ধারে আস্থা রাখবে? না আমাকে করবে বিশ্বাস?” আবার একই ধরণের পণ্যের দুই কোম্পানির বিজ্ঞাপনেও দেখা গেছে রবীন্দ্রনাথকে। বন্ধু হেমেন্দ্র মোহন বোসের অনুরোধে সুলেখা কালির বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেলে লিখেছিলেন, “সুলেখা কালি। এই কালি কলঙ্কের চেয়েও কালো।”ঐ সময় সুলেখা কালিকে বিদেশি কোম্পানির কালি পার্কারের এবং শেফার্সের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হতো। আবার একই রবীন্দ্রনাথ ‘কাজলকালি’র বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেলে লিখেছেন, “কাজলকালি ব্যবহার করে সন্তোষ লাভ করেছি, এর কালিমা বিদেশি কালির চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।”

চিত্রঋণ : Google
একদিকে সরকারি রেলের বিজ্ঞাপনে যেমন কবির কবিতা ব্যবহার করা হয়েছে, ঠিক তেমন বিদেশি “কে এল এম রয়াল ডাচ” এয়ারলাইন্সের বিজ্ঞাপনেও ব্যবহার করা হয়েছে এই কোম্পানির বিমান যাত্রায় কবিগুরুর সন্তুষ্টিপত্র। পূর্ব ভারতীয় রেলওয়েতে বিজ্ঞাপন হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল কবির শ্যামলী কাব্যের ‘হঠাৎ দেখা’ কবিতার প্রথম দুলাইন- ‘রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা, ভাবিনি সম্ভব হবে কোনো দিন।’ কবিসত্ত্বাকে বাঁচিয়ে রেখেও কবি লিখেছেন কোনো কোনো বিজ্ঞাপন। যেমন ‘লিপটন চা’-এর বিজ্ঞাপনে কবি রবীন্দ্রনাথকেই খুঁজে পাওয়া যায়। লিপটনের বিজ্ঞাপনে তিনি লিখেছিলেন, ‘চা-স্পৃহ চঞ্চল/ চাতকদল চল/কাতলি-জল তল/কলকল হে…’ ১৯২১ সালে দেশী কোম্পানির উৎপাদিত গোদরেজ সাবানের বিজ্ঞাপনে দেখা গেছে কবির শ্মশ্রুমণ্ডিত ছবি। যেখানে কবি লিখেছেন, ‘I know of no foreign soaps better than Godrej’s and I will make a point of using Godrej’s soap.’ ‘এর বিপরীত ছবিও আছে।
একই কোম্পানির সব পণ্যের বিজ্ঞাপন কবি লিখেছেন একসঙ্গে। বাঙালি ব্যবসায়ী হেমেন্দ্রমোহন বোসের কোম্পানীতে তৈরি হতো মাথায় মাখা তেল, পান মশলা এবং সুগন্ধি। প্রায় ছয় বছর ধরে সাবান, স্নো, পাউডারের মতো প্রসাধনীর বিজ্ঞাপনে মহিলাদের উপস্থিতি দেখতে অভ্যস্ত হলেও রবীন্দ্রনাথকে পাওয়া গেছে এসব বিজ্ঞাপনে। কারণ তার সময়ের সুপার মডেল তিনি। ১৩৫২ বঙ্গাব্দে ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় প্রকাশিত এই কোম্পানীর বিজ্ঞাপনে কবি লিখেছিলেন, কেশে মাখো ‘কুন্তলীন’। রুমালেতে ‘দেলখোস’। পানে খাও ‘তাম্বুলীন’। ধন্য হোক এইচ বোস।
কলকাতার রেডিয়াম ল্যাবরেটরির উৎপাদিত রেডিয়াম ক্রিমের বিজ্ঞাপনে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘রূপচর্চার জন্য স্নো ও ক্রিমজাতীয় প্রসাধন যারা ব্যবহার করেন, তারা রেডিয়াম ফ্যাক্টরির তৈরি ক্রিম ব্যবহার করে দেখুন, বিদেশি পণ্যের সঙ্গে এর কোনো পার্থক্য খুঁজে পাবেন না।’ অথচ ঢাকা থেকে জয়শ্রী’ পত্রিকার জন্য কবিগুরুর কাছে ‘ লেখা আনতে গেলে তিনি খুব ক্লান্ত এবং লেখা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় তাদেরকে লেখা দিতে পারেননি। তাই ফিরিয়ে দেওয়ার সময় রবীন্দ্রনাথ, ‘খালি হাতে ফিরে যাবে!- এই বলে এক বাক্স রেডিয়াম স্নো তাদের হাতে দিয়ে বলেছিলেন, এটা সবাই মিলে মেখো। আমি তো এসব ব্যবহার করি না।’ তখন রবীন্দ্রনাথকে প্রশ্ন করা হয়- আপনি নিজে না মাখলে কেন ওদের বিজ্ঞাপনে লিখে দিয়েছেন? ব্যবহার না করে লিখলেন কি করে! তখন রবীন্দ্রনাথ হেসে তাদেরকে উত্তর দেন, ‘দুটো লাইন লিখে দিলে আমার ভিক্ষের ঝুলিতে কিছু টাকা পাওয়া যাবে যে! অনেক কোম্পানি তাকে তাদের উৎপাদিত পণ্য পাঠাত কবির ঠিকানায় এবং তিনি উদার হস্তে চিঠি লিখে তাদের প্রশংসা করতেন, সেগুলিকেই পরে বিভিন্ন কোম্পানি ব্যবহার করত বিজ্ঞাপন হিসেবে। এতে কিছু সমস্যাও তৈরি হয়েছিল। অনেক কোম্পানি তাদের পণ্যের প্রসারের জন্য সেগুলিকে বাড়াবাড়ি রকমের ব্যবহারও করেছে। কেশোরাম কটন মিলের তৈরি শাড়ি, লং ক্লথ, টুইল, তোয়ালে বিষয়ে লেখা তার চিঠি স্বাক্ষরসহ সম্পূর্ণ ছেপে দিয়ে, নীচে লেখা হয়েছিল, ‘পূজায় এই কাপড় কিনিবেন, বেঙ্গল স্টোর্সে পাওয়া যায়।’
ব্রিটেনের তৈরি ‘বোর্ন-ভিটা’র বিজ্ঞাপনে কবির ছবির পাশে তার স্বাক্ষরিত একটা লাইনে পণ্য সম্পর্কে কবি লিখেছেন, ‘বোর্ন-ভিটা সেবনে উপকার পাইয়াছি।’রবীন্দ্রনাথ ‘জলযোগ কোম্পানির জন্যও লিখেছেন বিজ্ঞাপন। ওই বিজ্ঞাপনে তিনি লেখেন, ‘জলযোগের বানানো মিষ্টান্ন আমি চেখে দেখেছি। এটা আমাকে তৃপ্তি দিয়েছে। এর আলাদা স্বাদ আছে।’ ঘিয়ের বিজ্ঞাপনেও আমরা পাই কবিগুরুকে। কলকাতায় তৈরি শ্রীঘৃত সম্পর্কে তিনি লেখেন, ‘বাংলায় ঘিয়ের ভেজাল বাঙালির অন্ত্রের ভেজালকেও অনিবার্য করে তুলেছে। আশা করি শ্রীঘৃত বাঙালির এই ভেজাল রোগের প্রতিকার করবে।’সে সময়ের স্টুডিও এস ঘোষের বিজ্ঞাপনে কবিগুরুর ছবি ব্যবহার করা হয়েছিল এবং সেখানে কবি লিখেছিলেন, ‘এস ঘোষ আমার যে দুটি ফটোগ্রাফ তুলেছেন তা অতি সুন্দর ও সুনিপুণ। দেখে আমি বিস্মিত ও সন্তুষ্ট হয়েছি। তাদের ব্যবসায়ে তারা যে যথেষ্ট সফলতা লাভ করবেন তাতে আমার সন্দেহ নেই।’
১৯৩৬ সালে ‘দ্য রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া’ এর লোকাল বোর্ডের নির্বাচনের প্রার্থী ছিলেন অমরকৃষ্ণ ঘোষ। সেই বছরের ৯ অক্টোবরে কবি স্বাক্ষরিত বাংলা এবং ইংরেজি পত্রিকায় অমর ঘোষের প্রতি কবির সমর্থনের বিষয়টি বিজ্ঞাপন আকারে প্রকাশিত হয়। কবির হস্তাক্ষরে সেই বিজ্ঞাপনের কথাটি ছিল, “রিজার্ভ ব্যাঙ্কের লোকাল বোর্ডের নির্বাচনে শ্রীযুক্ত অমরকৃষ্ণ ঘোষের সফলতা কামনা করি।’আর ইংরেজিতে এটা ছাপা হয়েছিল এভাবে, ‘I earnestly desire the success of Sj. Amar Krishna Ghosh at the election to the Local Board of Reserve Bank.’ সেই নির্বাচনে ঘোষবাবু ৫৩৩৪টি ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের লোকাল বোর্ডের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। শেষে কি না ভোটের বিজ্ঞাপনেও বিশ্বকবি! বেঁচে থাকো বাঙালি।
তথ্যসূত্র:
- রবীন্দ্রজীবনকথা - প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়
- জয়শ্রী’ পত্রিকা. ঢাকা, সুবর্ণজয়ন্তী সংখ্যা- শকুন্তলা রায়ের প্রবন্ধ
- রবীন্দ্রনাথ বিজ্ঞাপন ও সেই সময় - হিরণ্ময় মাইতি