গৃহী রবিঠাকুর ও সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ; প্রেমের অলিন্দে অচেনাই রয়ে গেলেন স্বামীজি
Rabindranath and Swami Vivekananda:
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে বিবেকানন্দের দূরত্ব নিয়ে নানা অনুমান ও অনুসন্ধানের খবর আমরা জানি। নিবেদিতার মধ্যস্থতায় দু'জনের দেখা হয়েছিল চা-পানের আসরে কিন্তু দূরত্ব থেকেই গিয়েছিল। জগদীশচন্দ্রের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দের দু'জনেরই সুসম্পর্ক, তবু রবীন্দ্রনাথ আর বিবেকানন্দের মধ্যে যেন অসেতুসম্ভব দূরত্বের কথাই ভাবি আমরা।
একথা ঠিকই বিবেকানন্দের সন্ন্যাসধর্মের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের কবিধর্মের নানা বেমিল, তবু কখনও কখনও দু'জনের উচ্চারণে বেশ সাদৃশ্য চোখে পড়ে। যেমন ‘বালক’ পত্রিকায় প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের একটি rejoinder বিবেকানন্দের প্রেম বিষয়ক ভাবনার সঙ্গে তুলনীয়। ‘বালক’ পত্রিকায় রবীন্দ্রনাথ ‘রুদ্ধগৃহ’ নামে একটি গদ্যনিবন্ধ লিখেছিলেন। ‘বালক’-এর আশ্বিন-কার্তিক ১২৯২ সংখ্যায় লেখাটি প্রকাশিত। কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যার ঘটনাটি তখন এক বছরের কাছাকাছি নিকট অতীত, এই অস্বস্তিকর আত্মহত্যা সম্বন্ধে সংস্কৃতিমনস্ক ঠাকুরবাড়ির কর্তাব্যক্তিরা তখন নীরবতার কৌশল গ্রহণের পক্ষপাতী – নীরবতাই আস্তে আস্তে সামাজিক নিন্দে-মন্দর হাত থেকে পরিবারটিকে বাঁচাতে পারে।
এই বিশেষ ঘটনার কথা থাক। ‘রুদ্ধগৃহ’ লেখাটিতে রবীন্দ্রনাথ যে সাধারণ দর্শন-ভাবনায় পৌঁছেছিলেন তা মনে রাখার মতো। এ লেখাটিতে আছে বড় বাড়ির একটি ঘরের কথা। বাড়ির আর সব ঘর খোলা, কেবল সেটাই বন্ধ। সেখানে রাতে আলো জ্বলে না, দিনের বেলায় লোক ঢোকে না। কী করে ঢুকবে? ঘরের দরজায় যে তালা। সে তালায় মরচে ধরেছে, তার চাবি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ এ ঘরে একদিন মানুষের অনায়াস যাতায়াত ছিল, এ ঘরের মধ্যে স্নেহ-প্রেমের ‘অভিনয়’ হতো। অথচ দরজা বন্ধ করে দেওয়ার ফলে যেদিন দ্বার রুদ্ধ হয়েছিল সেদিনের পুরাতন অন্ধকার এ ঘরে জেগে আছে, পূর্ণিমার চাঁদের আলো ঢুকতে না পেরে রুদ্ধ-গৃহের বন্ধদ্বারের পায়ের কাছে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকে। এই যে বন্ধ-ঘরের শব্দছবি আঁকলেন রবীন্দ্রনাথ, এই ছবি থেকে পৌঁছতে চাইলেন অন্য এক কথায়। শোক-স্মৃতি-মৃত্যু এই তিনটিকে প্রিয়-বিয়োগের পর আটকে রাখতে নেই, মনের কারাগারে বদ্ধ থাকতে নেই।
এই কথাগুলি পাঠকের কাছে ঠিকমতো পৌঁছয়নি বলে ‘রুদ্ধগৃহ’ নামের লেখাটির rejoinder প্রকাশ করতে হল। ‘বালক’ পত্রিকায় পৌষ ১২৯২ সংখ্যায় প্রকাশিত হল ‘উত্তর প্রত্যুত্তর/ রুদ্ধ গৃহ সম্বন্ধে’। সেখানে বিষয়টি আরেকটু খুলে লিখলেন রবীন্দ্রনাথ। লিখলেন প্রকৃতির ধর্ম আর ক্ষুদ্রপ্রেমের কথা।
প্রকৃতির বৈরাগ্য দেখো। সে সকলকেই ভালোবাসে বলিয়া কাহারও জন্য শোক করে না। তাহার দুই চারিটা চন্দ্র সূর্য গুঁড়া হইয়া গেলেও তাহার মুখ অন্ধকার হয় না, একদিনের জন্যও তাহার ঘরকন্নার কাজ বন্ধ হয় না, অথচ একটি সামান্য তৃণের অগ্রভাগেও তাহার অসীম হৃদয়ের সমস্ত যত্ন সমস্ত আদর স্থিতি করিতেছে, তাহার অনন্ত শক্তি কাজ করিতেছে।
রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির এই ধর্মকে বলবেন অনুরাগের বৈরাগ্য। প্রকৃতির এই ধর্মকে কি মানুষ তার জীবনে সত্য করে তুলতে পারে না? রবীন্দ্রনাথের সিদ্ধান্ত, যেখানে প্রেম ক্ষুদ্র ও অন্ধ সেখানে পারে না। যেখানে প্রেম জৈব অধিকারের সীমানাকে অতিক্রম করে যায় সেখানে মানুষ প্রকৃতির মতোই অনুরাগের বৈরাগ্যের অধিকারী। ক্ষুদ্র প্রেম অন্ধ, কারণ অধিকারপরায়ণতার দাপটে সেখানে পরস্পর পরস্পরকে আটকে রাখে– গোটা পৃথিবী থেকে তারা নিজেরা নিজেদেরকে নির্বাসিত ও বিচ্ছিন্ন করে কেবল পরস্পর পরস্পরের উপর আমার সিলমোহর দিতে চায়। একজন অপরজনের থেকে কোনও কারণে বিচ্ছিন্ন হলে স্মৃতির শৃঙ্খলে আটকে যায়। ঠিক যেন রুদ্ধগৃহ। তখন দরকার হয় বিস্মৃতির।
"বিস্মৃতি মাঝে মাঝে আসিয়া স্মৃতির শৃঙ্খল কাটিয়া দিয়া যায়। আমাদিগকে কিছুক্ষণের মতো স্বাধীন করিয়া দেয়।"
যাকে রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির ধর্ম বলেছেন, যাকে বলেছেন অনুরাগের বৈরাগ্য তা স্বাধীনতা হরণ করে না। ছোট অধিকারপরায়ণ প্রেম স্বাধীনতা হরণ করে। ছোট অধিকারপরায়ণ প্রেম ভাবে প্রেমাস্পদ ‘কেবল তারই জন্য হয়েছে। সে চিরদিনই শুধু তারই থাকবে।’ এ যেন শিশুর গোঁ। এই গোঁ ধরলে প্রকৃতির মার আসে নেমে। সেই মার রুদ্ধ গৃহে বন্দিত্ব।
এই যে দার্শনিক কথা, প্রেমের মধ্যে মুক্তির কথা, স্বাধীনতার কথা ভাবছিলেন রবীন্দ্রনাথ এ কি একরকম করে বিবেকানন্দও ভাবছিলেন না!
রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দের সম্পর্কের মধ্যবর্তী দূরত্ব নিয়ে অনেক কথা লিখেছিলেন বিবেকানন্দ-গবেষক শঙ্করীপ্রসাদ বসু। তাঁর লেখায় আছে, ঠাকুরবাড়ি নাকি বঙ্গদেশের আবহাওয়ায় ইন্দ্রিয়াসক্তির বীজবপন করেছে এমন কথা বলে নিবেদিতাকে সাবধান করেছিলেন বিবেকানন্দ। বিবেকানন্দের ‘বিলাতযাত্রীর পত্র’ নামের ভ্রমণকাহিনিতে একজায়গায় আছে,
"ওই যে একদল দেশে উঠেছে, মেয়েমানুষের মত বেশভূষা, নরম-নরম বুলি কাটেন, এঁকে-বেঁকে চলেন, কারুর চোখের উপর চোখ রেখে কথা কইতে পারেন না, আর ভূমিষ্ঠ হয়েই পিরীতের কবিতা লেখেন, আর বিরহের জ্বালায় ‘হাঁসেন-হোঁসেন’ করেন—ওরা কেন যাক না বাপু সিলোনে।"
বিবেকানন্দপন্থী রবীন্দ্রনাথ বিরোধীরা এই অংশটি দাগিয়ে দিয়ে বলেন ‘নরম-নরম বুলি কাটারা’ই নাকি ঠাকুরবাড়ির লোক– এমন ইঙ্গিত করতে চেয়েছিলেন বিবেকানন্দ। রবীন্দ্রনাথ আর বিবেকানন্দকে দুই বিরোধীপক্ষ ভেবে দলাদলি করেন যাঁরা তাঁদের ক্ষুদ্রদৃষ্টির বাইরে রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দের লেখা পড়লে বোঝা যায় নানা বিষয়ে মতভেদ থাকলেও দু'জনের মধ্যে ভাবনাসাদৃশ্য কিছু কম ছিল না। প্রেমভাবনাতেও সাদৃশ্য ছিল।
এই যে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন তাঁর rejoinder-এ "অনুরাগ বদ্ধ করিয়া না রাখিলে তাহাকেই বৈরাগ্য বলে অর্থাৎ বৃহৎ অনুরাগকেই বৈরাগ্য বলে।" – এ বিবেকানন্দেরও উপলব্ধির কথা। উদ্বোধন পত্রিকায় প্রকাশিত হল বিবেকানন্দের কবিতা ‘সখার প্রতি’ (১৫ মাঘ ১৩০৫)। কবিতাটি যেন তাঁর আত্মকথন। নিজের সঙ্গে এ যেন তাঁর নিজের কথা, তিনি নিজেই নিজের সখা। নিজের অভিজ্ঞতা যেন নিজেকেই বলছেন। সে কবিতায় লিখলেন তিনি মন্ত্র, তন্ত্র, প্রাণ-নিয়মন, মতামত, দর্শন-বিজ্ঞান, ত্যাগ-ভোগ সবই বুদ্ধির বিভ্রম। তাহলে কী সত্য? প্রেমই সত্য। সে প্রেম ক্ষুদ্র-স্বার্থপর প্রেম নয়।
অনন্তের তুমি অধিকারী, প্রেম-সিন্ধু হৃদে বিদ্যমান,
“দাও-দাও” যেবা ফিরে চায়, তার সিন্ধু বিন্দু হয়ে যান।ব্রহ্ম হতে কীট পরমাণু, সর্ব্বভূতে সেই প্রেমময়,
মন প্রাণ শরীর অর্পণ, কর সখে, এ সবার পায়।বহুরূপে সম্মুখে তোমার, ছাড়ি কোথা খুঁজিছ ঈশ্বর?
জীবে প্রেম করে যেইজন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর।
বিবেকানন্দ এই কবিতায় যেমন প্রেম-সিন্ধুর কথা লিখলেন তেমনি রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রত্যুত্তরে লিখেছিলেন, "প্রেম জাহ্নবীর ন্যায় প্রবাহিত হইবার জন্য হইয়াছে।" বিবেকানন্দ যেমন লেখেন “দাও-দাও”, লেখেন "মনঃ প্রাণ শরীর অর্পণ, কর সখে, এ সবার পায়" তেমনি রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন,
যদি এমনি হয় যে, একজন সহসা এক আঘাতে তোমার হৃদয়ের কঠিনস্তর বিদীর্ণ করিয়া অমৃত উৎসের অনন্ত মূল অবারিত করিয়া দিয়াছে তবে সেই উৎস কই কেবল খননকারীর নাম-খোদিত সমাধি পাষাণ দিয়া ঢাকিয়া রাখিবে? সংসারের শত সহস্র তৃষিত আছে তাহাদিগকে দূরে তাড়াইয়া দিও না; তাহাদিগকে ডাকিয়া তাহাদের তৃষা দূর করো, তোমারই প্রিয়তমের কল্যাণ হইবে।
বিবেকানন্দ সন্ন্যাসী, গার্হস্থ্যের প্রাতিষ্ঠানিকতার বাইরে তিনি। তাই তাঁর তো প্রিয়া নেই, প্রিয়তম নেই। রবীন্দ্রনাথ গৃহী, তাঁর প্রিয়া, প্রিয়তম থাকায় আপত্তি নেই। তবে প্রাতিষ্ঠানিকতার বাইরে থাকা সন্ন্যাসীর কি কাছের জন থাকে না? থাকে, তবে সে থাকা গৃহীর বদ্ধতা-ক্ষুদ্রতার মধ্যে রুদ্ধ হয়ে থাকা নয়। রবীন্দ্রনাথও বদ্ধ-ক্ষুদ্র গৃহী ছিলেন না। সন্ন্যাসী বিবেকানন্দের ভালোবাসার জন নিবেদিতা কিন্তু সেই ভালোবাসা কোনও অর্থেই রুদ্ধপ্রেম নয়। মানুষের সামনে যথার্থ মানুষ এলে ‘হৃদয়ের কঠিনস্তর বিদীর্ণ করিয়া অমৃত উৎসের অনন্ত মূল অবারিত’ করে দেয়। বিবেকানন্দের স্পর্শে নিবেদিতার হৃদয় খুলে গিয়েছিল। এদেশে এসে যেভাবে শত সহস্র তৃষিত মানুষের জন্য কাজ করেছিলেন নিবেদিতা তা কি ভালোবাসা ছাড়া সম্ভব!