সরকারি দুর্নীতিই যোগ্য প্রার্থীদের বঞ্চিত হওয়ার একমাত্র কারণ
SSC SCAM: শিক্ষা ব্যবস্থার যে হাল হয়ে রয়েছে, আজ থেকে ১৫ বছর পরে কারা শিক্ষক হবেন? তাঁরা কী শিখছেন আজকে?
পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর অনেক ছবি ভেসে আসছে সমাজমাধ্যমে। কোথাও হঠাৎ চাকরিহারা হয়ে শিক্ষক ভেঙে পড়ছেন কান্নায়, কোথাও ছাত্র ছাত্রীরা কাঁদছেন, কারও মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে যে এবার সংসার চলবে কী করে, কেউ সারা জীবন ভাল ফলাফল করে এসে সৎ ভাবে চাকরি পেয়ে এই দিনের কথা দুঃস্বপ্নেও ভাবেননি। সুপ্রিম কোর্টের রায়ে হঠাৎ করে প্রায় ২৫ হাজার শিক্ষকের চাকরি চলে গেছে!
অনেকের মনে অনেক রকম ব্যাখ্যা এই রায়ের এবং এই পরিস্থিতির। সবচেয়ে বেশি করে যে প্রশ্ন চলে আসছে তা হল, এই ২৫ হাজারের মধ্যে তো অনেকেই যোগ্য প্রার্থী ছিলেন, তাঁরা তো টাকা দিয়ে চাকরি পাননি। তাহলে তাঁদের কেন চাকরি গেল? এর মধ্যে প্রায় সাড়ে ছয় হাজারকে তো দাগী দোষী বলে চিহ্নিত করে তাদের বেতনের টাকা ফেরত দিতে বলা হয়েছে। তাহলে বাকিদের মধ্যে থেকে কেন যোগ্য প্রার্থীদের বেছে নিল না সুপ্রিম কোর্ট?
ন্যায্য প্রশ্ন। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের রায়ের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে কেন আদালত যোগ্য প্রার্থীদের আলাদা করতে পারল না এবং কেন বিচারপতিরা ২০১৬ সালে হওয়া এসএসসি পরীক্ষার পুরো প্যানেলটিকেই বাতিল বলে ঘোষণা করে দিলেন।
বোঝার সুবিধার্থে প্রথমে দেখে নেওয়া যাক শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে কী কী রকম দুর্নীতি হয়েছিল।
১. অনেক প্রার্থী নিয়োগপত্র হাতে পেয়েছেন, কিন্তু কাজে যোগদানের অনুমতি পাননি
২. ২০০৯ এর এসএসসি আইনের নিয়ম অনুযায়ী চতুর্থ দফার কাউন্সেলিং-এর তালিকা প্রকাশ করা হয়নি
৩. তালিকায় উপরে থেকেও চাকরি পাননি, অথচ তালিকার নিচের প্রার্থীরা নিয়োগপত্র পেয়েছেন
৪. গ্রুপ-ডি পদে প্রার্থীদের ওয়েটিং লিস্টের প্যানেল ২০১৯ সালের ২০ জুন প্রকাশিত হলেও, সেই প্যানেল বাতিল করে ২০২১ সালের ১৪ জুন নতুন ভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়
৫. নিয়োগের নিয়ম না মেনে ইচ্ছে মতো প্রার্থীদের বাছা হয়েছে
৬. মেধা তালিকা বা ওয়েটিং লিস্টে নাম না থাকা সত্ত্বেও প্রার্থীদের নিয়োগপত্র দেওয়া হয়েছে এবং তাঁরা স্কুলে যোগদানও করেছেন
এই ধরনের মামলা সুপ্রিম কোর্টের সামনে এসেছে। আর মেধা তালিকার ক্রম সংখ্যা না মেনে নিয়োগই হোক অথবা নির্বাচিত বা প্যানেলভুক্ত প্রার্থী না হওয়া সত্ত্বেও নিয়োগপত্র দেওয়াই হোক, স্কুল সার্ভিস কমিশন আদালতে হলফনামা দিয়ে স্বীকার করেছে যে শিক্ষক নিয়োগে বেনিয়ম ও ভুল হয়েছে।
আদালতের নির্দেশেই প্রাক্তন বিচারপতি রঞ্জিত বাগের নেতৃত্বে কমিটি কিন্তু ধরে ধরে এই বেআইনি নিয়োগ সংক্রান্ত তথ্য আদালতের সামনে পেশ করেছিল।
এবার প্রশ্ন তাহলে এই সাড়ে ছ'হাজার দাগীরা চিহ্নিত হলেন কী করে? কমিশন আদালতে শুধু স্বীকার করেছিল যে ১৪৯৮ জনকে বেআইনি ভাবে প্যানেলের বাইরে থেকে নিয়োগ করা হয়েছিল। ৯২৬ জন প্রার্থীকে ক্রম তালিকার নিচে থেকে উপরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল এবং ৪০৯১ জনকে ওএমআর শিটে গরমিলের পরেও চাকরি দেওয়া হয়েছিল। যাদেরকে প্যানেলের বাইরে থেকে নিয়োগ করা হয়েছিল তাদের তো সহজেই চিহ্নিত করা যায়।
এর পরে আদালত জিজ্ঞাসা করা সত্ত্বেও কমিশন বলেছে যে তারা বেআইনি সুপারিশের সংখ্যা বা সেই সংক্রান্ত প্রার্থীদের বিশদ তথ্য যাচাই করতে পারেনি।
তাহলে কী এর বাইরের সবাই নির্দোষ?এই কমিশনই কিন্তু বাকিদের ব্যাপারে কোনও তথ্য ঠিক ভাবে আদালতের সামনে পেশ করতে পারেনি।
এবার আদালত চেষ্টা করে যে ওএমআর শিটগুলি দেখতে। মূল বিষয়টি ছিল যে ওএমআর শিটে চাকরিপ্রার্থীরা পরীক্ষা দিয়েছিল তার নম্বরের সঙ্গে প্রার্থীদের মেধা তালিকা বা যাঁরা নিয়োগপত্র পেয়েছেন তাঁদের নাম মিলিয়ে দেখা। সেটা করতে গিয়েই অজস্র গরমিল সামনে এসেছে।
প্রথমত স্কুল সার্ভিস কমিশন জানিয়েছে যে, ফলাফল বেরনোর এক বছরের পর তাঁরা সব ওএমআর শিট নষ্ট করে দিয়েছে। কমিশনের আইনের নিয়মাবলীর ২১ নম্বর ধারা অনুযায়ী তারা সেটা করেছে।
একাদশ ও দ্বাদশ এবং নবম ও দশম শ্রেণীর শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ওএমআর শিট নষ্ট করে দেওয়ার এরকম নিয়ম থাকলেও, গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি শিক্ষাকর্মীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে ওএমআর শিট নষ্ট করে দেওয়ার কোনও নিয়ম নেই। কিন্তু কমিশন ২০১৯ সালের ২২ শে জুলাই এদেরও ওএমআর শিট নষ্ট করারও সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।
অন্যদিকে কমিশন বন্ধ দরজার পিছনে টেন্ডার করে ন্যাসা বলে একটি কোম্পানিকে ওএমআর শিট স্ক্যান ও পরীক্ষা করতে দিয়েছিল। তারা আবার ডেটা স্ক্যানটেক বলে একটি কোম্পানিকে ওএমআরশিট স্ক্যান করতে দিয়েছিল (কমিশন যদিও জানায় যে তারা ডেটা স্ক্যানটেককে নিয়োগ করেনি)। সেই ন্যাসার কাছে কিছু ওএমআর শিটের সফ্ট কপি ছিল। তার থেকেই কিছু ওএমআর শিট আদালতে জমাও দিয়েছিল কমিশন।
কিন্তু যখন সেই ওএমআর শিটের সঙ্গে কমিশনের কাছে থাকা নম্বর ইত্যাদি মিলিয়ে দেখা হয়, তাতে বেরিয়ে আসে যে তাদের মধ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। তদন্তে এমনও পাওয়া গেছে যে, ন্যাসা বলে কোম্পানিটির কাছে ইমেল করে নির্দিষ্ট প্রার্থীদের নম্বর বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে।
এই বিস্তর গরমিল দেখে আদালতের পক্ষে এটা নির্ধারণ করাই অসম্ভব হয়ে যায় যে কোন প্রার্থী যোগ্যতার ভিত্তিতে মেধা তালিকায় স্থান পেয়েছেন আর কোন প্রার্থী গোঁজামিল দিয়ে চাকরি পেয়ে গেছেন। এই গরমিলের বহর এমনই যে আদালত সিদ্ধান্তে এসেছে যে পুরো প্রক্রিয়াটিতেই এমন ভয়ঙ্কর রকম বেআইনি কাজ হয়েছে এবং নিয়ম ভাঙা হয়েছে, তাতে পুরো প্রক্রিয়াটিই বাতিলযোগ্য। এর সমর্থনে বেশ কয়েকটি পুরনো মামলার রায়ও তুলে ধরেছেন বিচারপতিরা। কাজেই এটা প্রথম নয় যে, পুরো প্যানেল বাতিল করে দেওয়া হল।
আরও পড়ুন:২৬,০০০ চাকরি বাতিলের ধাক্কা! বন্ধ হবে রাজ্যের সরকারি স্কুলগুলি?
এখন অনেকেই এই রায়ের দায় আদালতের উপর ঠেলে দিচ্ছেন। কিন্তু আদালতের তো তদন্ত করার কথা নয়। তাদের সামনে তথ্য প্রমাণ পেশ করার কথা সংশ্লিষ্ট তদন্তকারী সংস্থা এবং সরকারি দফতরের। এখানে তদন্তকারী সংস্থা যা হদিশ পেয়েছে তাতে ব্যাপক গরমিলই ধরা পড়েছে। সেই গরমিলের হিসাব দেওয়ার কথা ছিল স্কুল সার্ভিস কমিশনের। কিন্তু তারা সেই তথ্য দিয়েই উঠতে পারেনি বা দিতে চায়নি। কারণ তাতে ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যেত হয়ত। নতুন কোনও কেলেঙ্কারির সন্ধান পাওয়া যেত হয়ত।
এবার ভাবুন তো, আদালত কি টাকা নিয়ে মেধা তালিকার বাইরে থেকে প্রার্থীদের চাকরি দিল? আদালত ওএমআর শিট নষ্ট করে ফেলল এবং সঠিক ভাবে তার সফ্ট কপি রাখল না? আদালত বেআইনি ভাবে কারও কারও নম্বর বাড়াল বা কমাল? নাকি বিকাশ ভট্টাচার্য বা প্রাক্তন বিচারপতি ও বর্তমানে বিজেপির সাংসদ অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এই দুর্নীতিগুলি একের পর এক করে গেলেন? নাকি কেন্দ্রের বিজেপি সরকার এই দুর্নীতি করে দিয়ে গেছে পশ্চিমবঙ্গে এসে?
কারা কারা এই মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন সেই তালিকা দেখুন। কাদের অধীনে স্কুল সার্ভিস কমিশন বা মধ্য শিক্ষা পর্ষদ চলে দেখুন। কারা টাকা নিয়ে চাকরি পাইতে দিতে পারে দেখুন।
এতদিনে আদালতের দিকে বল ঠেলে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছিল। এখন এই রায়ের পর নিজের দোষ স্বীকার না করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি নিজের দিকে ছাড়া সবার দিকে আঙুল তোলেন, তাহলে কী বলার থাকতে পারে! তাঁর নাকের ডগা দিয়ে তাঁর দলেরই মন্ত্রী-নেতা-কর্মীরা দুর্নীতি করে গেলেন আর তিনি টের পেলেন না! তাহলে তো তিনি সরকার ও দলের প্রধান হিসেবে চূড়ান্ত ব্যর্থ। এতো আর পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলে বা কোচবিহারের প্রত্যন্ত গ্রামে তৃণমূলের দুর্নীতি নয়! এতো তাঁর চোখের সামনে ঘটে যাওয়া দুর্নীতি!
যোগ্য প্রার্থীদের বঞ্চিত হওয়ার কারণও হচ্ছে এই সরকারি দুর্নীতি।
ইতিমধ্যেই কথা শুরু হয়েছে যে রাজ্যের সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থাটাই তো এই রায়ের ফলে ভেঙে পড়বে। সত্যিই তো ২৫ হাজার শিক্ষক যদি হঠাৎ করে স্কুলে না আসেন তাহলে এমনটা তো হবেই। কিন্তু দেখবেন এই সমস্যার সমাধানেও জোড়া-তালি দিয়ে একটা ব্যবস্থা খাড়া করবে সরকার বাহাদুর।
আরও পড়ুন:সন্দেহভাজন প্রার্থীদের তালিকা থাকা সত্ত্বেও কেন যোগ্য-অযোগ্যদের আলাদা করা গেল না?
আমাদের রাজ্যের শিক্ষা-স্বাস্থ্য সমস্ত ক্ষেত্রই জোড়া তালি দিয়ে চলছে। চলছে বললে ভুল হবে। ধুঁকছে। শুধুই একে ওকে দোষারোপ করে তো কোনও লাভ নেই। এই যে যোগ্য প্রার্থীরা আজ কাঁদছেন, তার দায় কেউ নেবে না।
এখনও কোনও কোনও স্কুলে ভাল শিক্ষকেরা আছেন। কিন্তু এই যে শিক্ষা ব্যবস্থার যে হাল হয়ে রয়েছে, আজ থেকে ১৫ বছর পরে কারা শিক্ষক হবেন? তাঁরা কী শিখছেন আজকে? সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার কী পরিণতি হবে তা ভাবতে গিয়ে শিউড়ে উঠতে হয়।
আমার পরিচিত এক যুবক বিহার থেকে কলকাতায় এসে অত্যন্ত টেকনিক্যাল একটি কাজ করত। হঠাৎ করে সেই কাজ ছেড়ে দিয়ে সে বিহারে চলে গেল। কিছুদিন পরে খবর পেলাম সে তার গ্রামেরই একটি স্কুলে সংস্কৃত শিক্ষক হিসেবে সরকারি চাকরি পেয়েছে। যে ছেলেটি হিন্দিই ঠিক করে বলতে পারত না, যার সংস্কৃতে কোনও ডিগ্রিই নেই, সে কী করে এই চাকরি পেল, ভাবতে গিয়ে কোনও কুল পেলাম না।
ভয় লাগে এরকম অবস্থাই পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে গ্রামে না হতে থাকে। হয়ত শুরুটা এই শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি দিয়েই হয়েছে! আমার আপনার ছেলে মেয়েরা তো বেসরকারি স্কুলে লাখ লাখ টাকা দিয়ে পড়াশোনা করে ডিগ্রি নিয়ে বাইরে চলে যাবে। কিন্তু যারা পারবে না, তাদের কী হবে? কারা তাদের দায়িত্ব নেবে?