ঘাস কাটার মজুর থেকে অভিনয়, দেশের প্রথম মালয়ালম নায়িকাকে শ্রদ্ধা গুগলের, চেনেন তাঁকে?

PK Rosy on Google Doodle : লড়াই আসলে পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে জেহাদও বটে। পিকে রোজির এই লড়াইকেই আরও একবার স্মরণ করল গুগল।

১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩। ফোনে বা কম্পিউটারে গুগল খোলার পর অনেকেই নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন একটি বিশেষ জিনিস। ‘গুগল’ শব্দটার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে এক মহিলার মুখ। ‘গুগল ডুডল’-এর এমন কারসাজি অনেক সময়ই দেখা যায়। বিশেষ বিশেষ দিনে গুগলের চিরাচরিত লোগো বদলে যায়। ডুডলের বিশেষ আঁকা ছবিটি সেখানে ভেসে আসে। ১০ ফেব্রুয়ারিও সেরকম বিশেষ কোনও দিন নিশ্চয়ই। কিন্তু কে এই মহিলা? কী তাঁর পরিচয়?

আমাদের ভারতীয় সিনেমার ইতিহাস সুদূরপ্রসারী। কেবল পৃথ্বীরাজ কাপুর, দিলীপ কুমার, অমিতাভ বচ্চন বা শাহরুখ খানেই সেসব সীমাবদ্ধ নেই। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, আহমেদাবাদ থেকে অরুণাচল প্রদেশ – সব জায়গায় ছড়িয়ে রয়েছে সিনেমা-চলচ্চিত্র-শিল্পের এক বিস্তৃত ইতিহাস। তার কিছু কিছু আমাদের জানা, অনেকটাই অজানা। সেরকমই এক অজানা নক্ষত্র হলেন পিকে রোজি (PK Rosy)। ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ তাঁরই ১২০ তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন করা হল। আর সেই বিস্মৃতপ্রায় অভিনেত্রীকেই শ্রদ্ধা জানাল স্বয়ং গুগল। পিকে রোজির পরিচয়? তিনি দেশের প্রথম মহিলা অভিনেত্রী, যিনি মালয়ালম সিনেমায় নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। তাঁর এই লড়াই আসলে পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণাও বটে। সমস্ত বাধা টপকে পিকে রোজির এই লড়াইকেই আরও একবার স্মরণ করল গুগল।

আরও পড়ুন : জ্যান্ত দেহের মাথা কেটে খুন! বাস্তবের ‘খোকা’ হার মানাবে সিনেমার চরিত্রকেও!

পিকে রোজির জীবন সম্পর্কে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। যেটুকু জানা যায়, তাতেই তাঁর লড়াইয়ের চরিত্রটা উঠে আসে। ১৯০৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি কেরালার তিরুবনন্তপুরমে জন্মগ্রহণ করেন পিকে রোজি। তখন অবশ্য এর নাম ছিল ত্রিবান্দ্রাম। ছোটবেলায় তাঁর নাম ছিল রাজাম্মা। দলিত পরিবারে জন্ম হওয়ার ফলে এমনিই একঘরে ছিল ওই পরিবার। দিনমজুর, ঘাস কাটার কাজ করতে হতো রোজির বাবা-মাকে। খুব ছোট বয়সেই রোজির বাবা মারা যান। সংসারের বোঝা এসে পড়ে ছোট্ট রাজাম্মার ওপর। পরিবারের সঙ্গে তিনিও দিনমজুরির কাজে নামেন সেই ছোট বয়সেই। ঘাস কাটার মজুর হিসেবেই কাজ করতেন তিনি।

তার মধ্যেই চলছিল স্বপ্ন দেখার কাজ। সেই সময় কেরালা বা মালয়ালম সিনেমার জগত প্রায় অন্ধকার। কার্যত কিছুই নেই। কেবল রয়েছে লোক সংস্কৃতি, নাচার স্থানীয় কিছু নাটক। সেই নাটকের দিকেই আকর্ষিত হন পিকে রোজি। স্থানীয় স্কুলে শিখতে শুরু করেন কেরালার স্থানীয় নৃত্যনাট্য ‘কাক্কারিসি নাটকম’। শিব-পার্বতী দেবতার পোশাক ছেড়ে সামান্য মানুষ হয়ে মর্তে এসেছেন, এটাই ছিল নৃত্যনাট্যের মূল থিম। এখান থেকেই অভিনয়, নাচ-গানের সঙ্গে আলাপ হয় পিকে রোজির।

যখন একটু বড়ো হলেন, তখনই সাহসী একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন রোজি। সোজা চলে গেলেন ‘থাইকাউড়’ নামের এক নাটকের দলে। ততদিনে অভিনেত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন তিনি। কিন্তু সাহসী কেন? কারণ, সেটা বিংশ শতকের শুরুর সময়। ভারতের অধিকাংশ এলাকাতেই মেয়েদের ঘরের চার গণ্ডির মধ্যেই রেখে দেওয়া হয়। আর সিনেমা? সেটা তো ছিল ‘খারাপ হওয়ার জায়গা’। সেই সময়ের সমাজের ধারণাই ছিল, থিয়েটার, সিনেমায় যে মেয়েরা কাজ করে, তাঁরা সব্বাই খারাপ! মালয়ালম সংস্কৃতিও সেই ভাবনা থেকে বাইরে ছিল না। তার ওপর পিকে রোজির পরিবার ছিল অত্যন্ত গোঁড়া। তবুও পা বাড়ালেন তিনি। জানেন, ভবিষ্যতে ভীষণ বিপদ, ঝড় আসতে চলেছে তাঁর জীবনে। তবুও হাল ছাড়লেন না তিনি।

আরও পড়ুন : সবাই জানেন ‘আজগুবি’ সিনেমা! তাও কেন ভারতবর্ষে চিরকাল জিতে যান শাহরুখ খান?

১৯২৮ সাল। পরিচালক-অভিনেতা জেসি ড্যানিয়েল মালয়ালম ভাষায় একটি সিনেমা তৈরির সিদ্ধান্ত নিলেন। ‘বিগাথাকুমারন’ (Vigathakumaran), বাংলায় যার অর্থ ‘হারিয়ে যাওয়া শিশু’ (The Lost Child)। এক ধনী ব্যক্তির ছেলেকে অপহরণ নিয়ে সিনেমার গল্প লেখা হয়েছিল। নির্বাক এই সিনেমায় তিনি নিজে প্রধান অভিনেতা বা নায়কের ভূমিকায় নামতে চলেছেন। কিন্তু নায়িকা? কেরালার একজন মহিলাও নায়িকার ভূমিকায় আসতে চাইছেন না। তাহলেই যে সিনেমায় নামতে হবে! সমাজ একঘরে করে দেবে তারপর! সিনেমায় নামলেই যে ‘খারাপ’ হতে হবে। মাথায় হাত পড়ল জেসি ড্যানিয়েলের।

সেই সময়ই সামনে এলেন পিকে রোজি। অভিনেত্রী হিসেবে তো ভালো ছিলেনই; সেইসঙ্গে সাহস করে সিনেমায় নামার সিদ্ধান্তটিও নিলেন। ১৯২৮ সাল। মুক্তি পেল ‘বিগাথাকুমারন’। এই সিনেমা সবদিক থেকেই ঐতিহাসিক। কেরালার প্রথম সিনেমা ছিল এটি। এরপরই পরিচালক জেসি ড্যানিয়েলকে মালয়ালম সিনেমার জনক হিসেবে অভিহিত করা হয়। আর পিকে রোজি? মালয়ালম সিনেমার প্রথম নায়িকা, কেরালার প্রথম সিনেমার অভিনেত্রী হিসেবে ইতিহাসের খাতায় নামটি লিখিয়ে নিলেন।

তারপরই শুরু হয় প্রতিবাদের ঢেউ। ‘বয়কট গ্যাং’ তখনও ছিল ভারতে। কেরালার প্রায় সমস্ত জায়গায় বলা হয়, এই সিনেমাটিকে বয়কট করা হোক। কেন? কারণ ছিল দুটি। এক, সিনেমায় পিকে রোজির আবির্ভাব। একজন মেয়ে হয়ে সিনেমায় নামল! ঘোর কলিযুগ! সিনেমায় একটি দৃশ্য ছিল, যেখানে নায়িকার খোঁপায় গোঁজা ফুলকে চুম্বন করছেন নায়ক। সেই দৃশ্য দেখানোর পরই শুরু হল পাথরবৃষ্টি।

আরও পড়ুন : সুচিত্রা সেনকে বিয়ে করতে চেয়েছিলেন উত্তমকুমার, উত্তরে কী বলেছিলেন মহানায়িকা?

দ্বিতীয় কারণটি ছিল আরও ‘ভয়ানক’। পিকে রোজি একে তো মহিলা, তার ওপর দলিত পরিবারে জন্ম। সিনেমায় তাঁর চরিত্রটির নাম সরোজিনী, যার জন্ম নায়ার পরিবারে। দলিত হয়ে কী করে উচ্চবর্ণের নায়ার পরিবারের এক মেয়ের চরিত্রে অভিনয় করলেন পিকে রোজি? আক্রমণের ঝাঁঝ আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেল। স্রেফ এই ইস্যুর জন্য অনেক বিশিষ্ট মানুষ ‘বিগাথাকুমারন’ সিনেমাটি দেখতেও এলেন না। প্রিমিয়ারের সময়ও ব্যাপক গণ্ডগোল হয়েছিল। অবস্থা বুঝে জেসি ড্যানিয়েল রোজিকে প্রিমিয়ারে ডাকলেনই না। অবশ্য ঠিক ম্যানেজ করে লুকিয়ে সেখানে চলে গিয়েছিলেন পিকে রোজি।

এরপর তাঁর ব্যাপারে আর কিছু জানা যায় না। এই একটি সিনেমাতেই তিনি অভিনয় করেছিলেন। পরে কেরালায় দলিত আন্দোলনের মুখও হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর এই অভিনয়ের কথা অনেকদিন গোপনে ছিল। ১৯৬০-৭০’র দশকে প্রথমবার তাঁকে নিয়ে লেখা প্রকাশিত হয়। তখনই গোটা ভারত জানতে পারে পিকে রোজির কথা। আর ‘বিগাথাকুমারন’? তার কোনও প্রিন্ট এখন পাওয়া যায় না। পিকে রোজিকেই বা মনে রেখেছেন কজন!

More Articles