জঙ্গিহামলার মুখে নিরস্ত্র লড়াই! মুম্বইয়ের সেই দিন মনে পড়লে শিউরে উঠতে হয় আজও

26 November Mumbai attack : ফিরে দেখা চোদ্দ বছর আগের ভয়াবহ মুম্বাইয়ের সেই দিন

চোদ্দ বছর আগের ২৬ নভেম্বর। মুম্বাই শহর। সন্ধ্যা পর্যন্ত দিব্যি স্বাভাবিক ছন্দে চলছিল সবটা। প্রতিদিনের মতোই বাজারগুলোতে মানুষজনের উপচে পড়া ভিড়। মেরিন ড্রাইভেও তখন থিকথিক করছে ভিড়। এর মাঝেই হঠাৎ ছন্দপতন।জইশ-ই-মহম্মদের ১০ জন সন্ত্রাসবাদীর একটি দল ছড়িয়ে পড়ে বাণিজ্যনগরীতে। মুহূর্তের মধ্যে শুরু হয় লাগাতার হামলা। ধিকি ধিকি করতে করতে দপ করে জ্বলে ওঠে সে আগুন। ছড়িয়ে পড়তে থাকে আরও। টানা চার দিন ধরে তাণ্ডব চালায় সন্ত্রাসবাদীরা। এ যেন ভারতীয় ইতিহাসের এমন এক কালো দিন যা কেউ চাইলেও ভুলতে পারে না। ২৬ থেকে ২৯ নভেম্বর জঙ্গি হামলায় নিহত হয়েছিলেন ১৬৪ জন৷ আহত হন অন্তত ৩০৮ জন৷ সরকারি এ হিসেবের বাইরের চিত্রটা অবশ্য আরও ভয়াবহ। এখনও সেই ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন নিহতর পরিজনেরা ও আহতরা৷

দেখতে দেখতে চোদ্দটা বছর। আজ আবার নভেম্বর মাস, আবারও একটা ২৬ তারিখ। ২০০৮ সালের অভিশপ্ত সেই রাতের ভয়াবহ স্মৃতি আজও দগদগে৷ সেই প্রথমবার নয় ১৯৯৩ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত মোট ১৩টি সন্ত্রাসবাদী হামলা সহ্য করেছে মুম্বই। কখনও বোমা বিস্ফোরণ, কখনও লোকাল ট্রেন বিস্ফোরণ, কখনও আবার জঙ্গি হামলা, যেন ঝাঁজরা করে দিয়েছে শহরের পাঁজর। এমন একটা ইতিহাস যে নগরের, সে তো সিঁদুরে মেঘ দেখলেও ভয় পাবেই। এতোদিন পেরিয়ে এসেও ভয় কাটেনি, উপরন্তু ঝালিয়ে নিচ্ছে সেই ঘটনাই। কীভাবে ঘটেছিল সবটা, কেন ঘটেছিল, ঘটনার পর কী হল, ইত্যাদি সব প্রশ্নের উত্তর খোঁজা চোদ্দ বছরেও শেষ হয়নি। হয়তো আরো চোদ্দ বছর লেগে যাবে, তবুও শেষ হবে না।

আরও পড়ুন : জঙ্গির আবেদন অগ্রাহ্য, বহাল মৃত্যুদণ্ডই! লালকেল্লা হামলার ত্রাস কে এই পাক জঙ্গি আরিফ?

তখন রাতের অন্ধকার। মাছ ধরার ডিঙি নৌকা নিয়ে ১০ জন জঙ্গি রাতের এসে নামলো মুম্বাইয়ের উপকূলে। সন্ত্রাসীরা যাত্রা শুরু করেছিল করাচি বন্দর থেকে। তারপর গভীর সাগর পর্যন্ত ছিল একই জাহাজে। সাগরেই ভারতীয় মাছ ধরার নৌকাটি ছিনতাই করে তারা। তারপর মুম্বাই উপকূলে এসে হত্যা করে নাবিককে। নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে রীতিমত বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আরব সাগর পেরিয়ে ঢুকে পড়ে দক্ষিণ মুম্বাইয়ে।তাও আবার কাঁধে বন্দুক ও গোলা–বারুদের ঝোলা নিয়ে। এরপর শুরু হয়ে যায় ভয়াবহ তাণ্ডব। ঠান্ডা মাথায় খুন করার মারাত্মক খেলা। এক এক করে ১৬৪ জনকে মেরে ফেলে নিমেষের মধ্যে।

মুম্বইয়ে পা রেখে প্রথমেই ছত্রপতি শিবাজি মহারাজ টার্মিনাস রেল স্টেশনে হামলা চালায় ইসমাইল খান ও আজমল কাসভ নামের দুই জঙ্গি। ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে ৯টা। এরপর একে একে দক্ষিণ মুম্বইয়ের ১০টিরও বেশি জায়গায় হামলা চালায় জঙ্গিরা ওবেরয় ট্রাইডেন্ট, তাজ হোটেল, লিওপোল্ড ক্যাফে, কামা হাসপাতাল, নরিম্যান হাউস, ইহুদি কমিউনিটি সেন্টার, মেট্রো অ্যাডল্যাবস এবং টাইমস অফ ইন্ডিয়া ভবন ও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের পিছনের একটি গলি, এমনকী মুম্বই বন্দরের অদূরে মাজাগাঁও ও ভিলে পার্লের একটি ট্যাক্সির মধ্যেও বিস্ফোরণ ঘটায় জঙ্গিরা। দীর্ঘ ৬০ ঘণ্টা ধরে চলতে থাকে গুলি বিনিময়। এক অন্য রকম পুলিশি তৎপরতার সাক্ষী থেকেছিল সেদিন বাণিজ্যনগরী। আচমকা ঘটনার ঘনঘটায় বিচলিত না হয়ে জীবন বাজি রেখেছিল গোটা টিম।২৮ নভেম্বর সকালের মধ্যেই মুম্বই পুলিশ ও অন্যান্য রক্ষীবাহিনী তাজ হোটেল ছাড়া অন্য সব আক্রান্ত স্থান সুরক্ষিত করে ফেলে। ২৯ নভেম্বর ভারতের জাতীয় রক্ষী বাহিনী (এনএসজি) তাজ হোটেলে আশ্রয়গ্রহণকারী অবশিষ্ট জঙ্গিদের হত্যা করে। এই অপারেশনটির নাম ছিল অপারেশন ব্ল্যাক টর্নেডো। অবশেষে যবনিকা পতন। আজমল কাসভ ছাড়া সকলেরই মৃত্যু হয় সেই সংঘাতে। জঙ্গি মুক্ত হয় মুম্বাই শহর।

ভারত তো চিরকালই ঐক্যের কথা বলে। বলে, বিভেদের মাঝে মিলনের কথা। সেইদিন সবথেকে ভয়াবহ যেটা হয়েছিল, তা হল তাজ হোটেলের ঘটনা। অভিশপ্ত সেই রাতে প্রাণের বাজি রেখে হোটেলে আগত অতিথিদের রক্ষা করেছিল তাজ প্যালেস হোটেলের কর্মীরা। চার জঙ্গির সামনে নিরস্ত্র অবস্থাতেই দাঁড়িয়েছিলেন তাঁরা। এরা কেউ, পুলিশ অথবা সেনা নয় তবুও কেবল একটা জোরেই লড়ে গিয়েছিলেন সেদিন। তা হল, ভারতীয় সভ্যতা সংস্কৃতির ‘অতিথি দেবভব’র বার্তা। মানববন্ধন তৈরি করে বুকে গুলির আঘাত নিয়েছিলেন তাঁরা। যেন নিজেদের বাড়ি আক্রান্ত। শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে হলেও আঁচ লাগতে দেওয়া যাবে না ২০০০ জন অতিথিদের।

আরও পড়ুন : একদিকে জঙ্গিদের হুমকি, অন্যদিকে প্রশাসন || কাশ্মীরে যেভাবে বাঁচেন সাংবাদিকরা

হ্যাঁ, এটি ছিল পরিকল্পিত হামলা। জঙ্গিরা কি একেবারেই জানতো না যে তাদের জীবন শেষ হতে পারে? নিশ্চিত জানতো। তবুও এ ঘটনা কেন? কী এর আসল কারণ? জেরার মুখে জঙ্গি আজমল কাসভ স্বীকার করে, তারা পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার সদস্য। শুধু তাই নয় পাকিস্তান সরকারও স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয় যে সে দেশে বসেই ঠান্ডা মাথায় জঙ্গিরা এ পরিকল্পনা করেছিল। দীর্ঘ বিচারের পর ২০১০ সালের ৬ মে মুম্বইয়ের বিশেষ আদালত ধৃত জঙ্গি আজমল কাসভকে মৃত্যুদণ্ড দেয় বিচারক।

কী শেখালো এ ঘটনা?
তবে এ ঘটনা যেমন কেড়ে নিয়েছে , পাশাপাশি অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়ে গেছে দেশকে। সরকার, প্রশাসন, সেনা ও পুলিশ প্রত্যেকেই নিজেদের মতো করে সাজিয়েছে ঘুঁটি। নতুনভাবে হামলা হলেই রুখে দাঁড়াবে। যোগ্য জবাব দেবে ষড়যন্ত্রকারী সন্ত্রাসবাদীদের। উল্লেখ্য, গত ১৪ বছরে এমন হামলার ঘটনা আর ঘটেনি। পাকিস্তানি সন্ত্রাসবাদীরা হামলা করলে এখন রয়েছে জব্বর অস্ত্র, জবাব দেওয়া হচ্ছে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক এবং এয়ার স্ট্রাইক দিয়ে। শুধু তাই নয়, মুম্বই হামলার পরে দেশে দ্রুত ন্যাশনাল সিকিউরিটি গার্ডের চারটি কেন্দ্র তৈরি করা হয়েছিল। যার ফলে দ্রুত হামলা মোকাবিলা করতে পারে টিম। তৈরি হয়েছে মাল্টি এজেন্সি সেন্টার। যাতে প্রয়োজনে একাধিক নিরাপত্তা সংস্থা, গুপ্তচর সংস্থা, সরকার, হাসপাতাল, পুলিশ এবং গোয়েন্দা সংস্থার মধ্যে একযোগে সমন্বয় করা যায়। সর্বোপরি বাড়ানো হয়েছে উপকূলের নিরাপত্তাও।


এখানেই শেষ নয়, এই ঘটনার জের যে এখনও রয়েছে দেশীয় নীতিতে তার প্রমাণ মিলল বিদেশমন্ত্রী এস জয়শংকরের আজকের কথাতেও। ১৪ তম বর্ষপূর্তিতে ফের নাম না করে পাকিস্তানকে হুঁশিয়ারি দিলেন বিদেশমন্ত্রী। বললেন, এই ঘটনার বিচার হবেই।সেদিনের এই হামলা শুধু ভারত নয়, সারা পৃথিবী জুড়েই নিরাপত্তা ব্যবস্থার কাঠামো বদলে দিয়েছিল আমূল। তারপর থেকেই সন্ত্রাস দমন যে কোনও শহরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার অন্যতম অঙ্গ হয়ে উঠেছে। মুম্বই হামলার পর পৃথিবীর অধিকাংশ দেশই লস্কর ই তইবাকে বেআইনি ঘোষণা করেছে ঠিকই কিন্তু আক্ষেপ একটাই এই সংগঠনের প্রাণপুরুষ তো বহাল তবিয়তেই আছে পাকিস্তানের আশ্রয়ে।

More Articles