অনিল-কন্যা কি বিশ্বাসঘাতক? না কি তাঁর দলত্যাগ বামেদের জন্য রেড অ্যালার্ট?

এই বক্তব্যের দায় সংস্থার ওপর বর্তায় না। মতামত লেখকের একান্ত নিজস্ব।

অজন্তা বিশ্বাস সিপিআই(এম)-এর একজন সদস্য ছিলেন। তিনি তাঁর দলীয় সদস্যপদ নবীকরণ করেননি। এই খবরটা আট-দশটা খবরের মতোই মামুলি খবর হতে পারত। কারণ, অনেকেই নানা কারণে গত বেশ কয়েকবছর ধরে সিপিআই(এম)-এর সদস্য পদ নবীকরণ করেননি। কিন্তু অজন্তা বিশ্বাস যেহেতু সিপিআই(এম)-এর প্রয়াত রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাসের কন্যা, তাই তাঁর দলীয় সদস্য পদ নবীকরণ না করানোর বিষয়টি, রাম-শ্যাম-যদু-মধুর দলীয় পদ নবীকরণ না করার মতো কোনও মামুলি বিষয় হিসেবে সাধারণ মানুষের কাছে পরিগণিত হতে পারে না, গণমাধ্যম এবং বামমনস্কদের একাংশ তেমনটাই মনে করে। সেই কারণেই বিষয়টি ঘিরে নানা আলাপ-আলোচনা চলছে।

অজন্তা বিশ্বাসের ব্যক্তিসত্তা রয়েছে, সেই ব্যক্তিসত্তা যে সবসময়  তাঁর প্রয়াত পিতার মতাদর্শের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে চলবে, কোনও অভিধানে তেমন কোনও বাঁধাধরা নিয়ম করা নেই। তাই এক্ষেত্রে যদি ব্যক্তি অজন্তা বিশ্বাস মনে করেন যে, সিপিআই(এম) দলটিকে সাফল্যের ধারাবাহিকতায় একটি স্তরে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর প্রয়াত পিতার বিশেষ ভূমিকা ছিল, তা সত্ত্বেও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন সেই দলের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন না, তাঁর এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আছে! অজন্তা বিশ্বাস-অনিল বিশ্বাসের কন্যা বলেই তাঁকে বাধ্যত সিপিএমের সদস্য থাকতে হবে, এ কথা অর্থহীন। আসলে, সিপিএমের একজন শীর্ষ নেতার শারীরিক অনুপস্থিতির সময়ে, তাঁর আত্মজা পিতার ভাবাদর্শের সঙ্গে নিজেকে আর একাত্ম রাখতে পারলেন না- এটা আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠল, এর নেপথ্যে একটাই কারণ, তুখড় রাজনীতিক অনিল বিশ্বাসের রাজনৈতিক ক্যারিশমা। সেই কারণেই তাঁর মৃত্যুর এত বছর পরেও প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে এই বিতর্ক।
               
সিপিএম-এর শুরুর সময় থেকে, দলের রাজ্য সম্পাদকের পুত্র-কন্যাদের সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণের খুব একটা দৃষ্টান্ত আমরা দেখতে পাই না।প্রমোদ দাশগুপ্ত অকৃতদার ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর যিনি দলের রাজ্য সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করলেন, সরোজ মুখোপাধ্যায়, তাঁর এক পুত্র। সেই পুত্র কৃতবিদ্য অধ্যাপক বটে, কিন্তু দলীয় পরিমণ্ডলে তাঁকে সেভাবে আমরা কখনও দেখিনি। সরোজবাবুর পরে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক হলেন শৈলেন দাশগুপ্ত, তাঁর পুত্র স্থানীয় রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। সেই সক্রিয়তা ঘিরেও আবার নানা ধরনের বিতর্ক ছিল। তবে সেই বিতর্ক ছাপিয়ে শৈলেন দাশগুপ্তর পুত্র সেভাবে রাজনীতির অঙ্গনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য খুব একটা চেষ্টা কখনও করেছেন বলে শোনা যায় না।

আরও পড়ুন: ঝিমিয়ে পড়া বামেদের চাঙ্গা করছেন মহম্মদ সেলিম?


               
অনিল বিশ্বাসের কন্যা অজন্তা ছাত্রজীবনে পার্টির ছাত্রসংগঠনের সক্রিয় কর্মী হলেও, ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতার ক্ষেত্রে, তাঁর সেই সময়ের বিরোধী রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে ওঠাবসা ঘিরে দলের অন্দরে যে বিতর্ক ছিল না, একথা জোর দিয়ে বলা যায় না। তবে অজন্তা দলীয় সদস্যপদ গ্রহণ করলেও বামফ্রন্ট ক্ষমতায় থাকাকালীন নিজের পেশাগত জীবন নিয়েই বেশি ব্যস্ত থেকেছেন। রাজনৈতিক পরিসরে তাঁকে কখনও সেভাবে দেখতে পাওয়া যায়নি।    
           
সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকের সন্তানদের ভেতরে প্রথম যিনি বাবার ক‍্যারিশমা ব্যবহার না করেও পরিণত রাজনৈতিক বোধ আর কবিসত্তার সম্মিলিত পরিচয় রেখে জনমানসে একটা শ্রদ্ধার আসন তৈরি করতে পেরেছেন, তিনি হলেন সদ্য-প্রাক্তন রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রর কন্যা রোশনারা মিশ্র। সূর্যবাবু যখন সিপিএমের সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন দল  ক্ষমতায় নেই। কিন্তু দলীয় বৃত্তে কখনওই সূর্যবাবুর সন্তান 'বাবার মেয়ে' হিসেবে নিজেকে তুলে ধরার চেষ্টা করেননি ।
                 
একই কথা অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বলতে হয় ওই দলের বর্তমান রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিমের সন্তানদের ঘিরেও। সেলিমের দুই পুত্র কিন্তু দলীয় সদস্য। নিজেদের পেশাগত জীবনের পাশাপাশি রাজনৈতিক অঙ্গনেও তাঁরা কাজ করেন। সেক্ষেত্রে তাঁরা কিন্তু আর দশজন সহযোদ্ধার মতোই লড়াকু কর্মী। সেলিম আজ রাজ্য সম্পাদক হলেও, বিগত পনেরো-বিশ বছর ধরে তিনি দলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নেতা। দীর্ঘদিন তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, পলিটব্যুরোর সদস্য। বামফ্রন্ট ক্ষমতায় থাকাকালীন তিনি দলের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যও হন। তা সত্ত্বেও সেলিম কিন্তু কখনও তাঁর  সন্তানদের কি পেশাজীবন, কি রাজনৈতিক জীবন, কোনও ক্ষেত্রেই পিছনের দরজা ব্যবহার করে কোনোরকম সাফল্য পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেননি‌। সেলিমের এক সন্তান কিন্তু আজও নিজের কর্মক্ষেত্রে রাজনৈতিক ভাবে সক্রিয়। বাবাকে ব্যবহার করে তাঁরা কখনও দলের মধ্যে অতিরিক্ত ক্ষমতা ভোগ করার চেষ্টা করেননি বা দলীয় পদ বহির্ভূত কোনও ক্ষমতা ভোগ করেননি ।
                 
অজন্তা বিশ্বাসের সিপিএমের দলীয় সদস্য পদ নবীকরণ না করার এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে, দলের বিভিন্ন সময়ের সম্পাদকদের সন্তানদের রাজনৈতিক কার্যক্রম ঘিরে যে ঘটনাবলি, তাও কিন্তু আমাদের মনে রাখা বিশেষ প্রয়োজন। অজন্তা বিশ্বাস কিছুদিন আগে তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপত্র 'জাগো বাংলা'-তে নারীর ক্ষমতায়ন ঘিরে কয়েক কিস্তিতে একটি ধারাবাহিক প্রবন্ধ লেখেন। অত্যন্ত সাধারণ মানের সেই প্রবন্ধটিতে নারীর ক্ষমতায়ন প্রশ্নে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন। ব্যক্তি অজন্তা বিশ্বাসের আজকের প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সম্বন্ধে ইতিবাচক ধারণা তৈরি হতেই পারে। কিন্তু সেই ধারণার কথা অজন্তা যখন প্রকাশ্যে নিয়ে আসছেন, তখন কিন্তু তিনি সিপিআই(এম) নামক একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ দলের সদস্য।
             
সিপিআই (এম) দলের সদস্যপদ অর্জনের জন্য তিনটি ধাপ একজনকে পেরোতে হয়। অন্য অনেক রাজনৈতিক দলের মতো নিমেষে, মিসড কল দিয়ে দলের সদস্য হয়ে যাওয়া, তেমনটা কিন্তু আজও সিপিআই(এম) দলে সম্ভব নয়। আর সেই কারণে পার্টিতে অবস্থান করতে গেলে, দলের রাজনৈতিক অবস্থান, রাজনৈতিক মূল্যায়ন সম্পর্কে  দলে থেকে প্রকাশ্যে তার বিরোধিতা করা যায় না। যায় না বলেই, একটা সময় পশ্চিমবঙ্গের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেও ও দলের প্রতি মতাদর্শগত আস্থা বজায় রেখেও, অশোক মিত্রের মতো ব্যক্তিত্ব দলীয় সদস্যপদ বজায় রাখেননি ।
               
একটা শৃঙ্খলার মধ্যে এই দলের সমস্ত সদস্যকে থাকতে হয়। সীতারাম ইয়েচুরি থেকে একদম ভূমিস্তরের, ব্রাঞ্চ কমিটির একজন সাধারণ সভ্য- তাঁরা কেউই সেই শৃঙ্খলার, নিয়ম-নীতির বাইরে নন। সেই নিয়মনীতির ওপর দাঁড়িয়ে কিন্তু তাঁদের সমস্ত ধরনের রাজনৈতিক মূল্যায়ন দলের ভেতরে করতে হয়। তাঁদের নিজেদের সেই রাজনৈতিক মূল্যায়ন যদি দলের মূল্যায়নের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ না হয়, তাহলে তা তাঁদের দলের মধ্যে জানাতে হয়। তা নিয়ে দলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ মতাদর্শগত বিতর্ক চলে। তার পরিপ্রেক্ষিতে এক ধরনের সিদ্ধান্তের দিকে দল এবং ব্যক্তি পৌঁছয়।
               
সাম্প্রতিক অতীতে কংগ্রেসের সঙ্গে রাজনৈতিক বোঝাপড়া, বিশেষ করে নির্বাচনী সংগ্রাম ঘিরে সিপিএমের ভেতরে যে মতাদর্শগত লড়াই হয়েছে, যার জন্য তাদের বিশেষ প্লেনামও আয়োজিত হয়েছে, সেই প্রেক্ষিতকে মনে রেখেই প্রশ্ন করতে হয়, দলীয় সদস্যপদ বজায় রেখে, অজন্তা বিশ্বাস যেভাবে দলের মূল্যায়নের বাইরে গিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক মূল্যায়ন করেছেন, তেমনটা কখনও কোনও কমিউনিস্ট পার্টিতে করা যায় কি?
               
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনকালে নারীর ক্ষমতায়ন প্রসঙ্গে ব্যক্তি অজন্তা বিশ্বাসের যে মূল্যায়ন, তা প্রকাশ্যে নিয়ে আসার আগেই কেন দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে নিজের ব্যক্তিগত অভিমত প্রকাশ্যে আনলেন না অজন্তা? বহু মানুষই আছেন, যাঁরা নানা নীতির প্রশ্নে দলের সঙ্গে তাঁরা সহমত নন। এমন মানুষরা সাধারণত দলীয় সদস্যপদের বেড়াজালের মধ্যে যান না। অজন্তা বিশ্বাস কিন্তু তা করেননি। দলের অভ্যন্তরে তিনি থেকেছেন তাঁর পিতার মৃত্যুর পর দীর্ঘ সময়, অথচ মতাদর্শগত দিক থেকে যে তিনি ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছেন, সেকথা কাউকে বুঝতে দেননি।
                 
অনিল বিশ্বাসের কন্যা দলে অবস্থান করে যদি এই ধরনের ব্যক্তিস্বাতন্ত্রকে প্রাধান্য দিতে পারেন, তবে আগামী দিনে বামপন্থী রাজনীতির ক্ষেত্রে একটা বিপদবার্তা অবশ্যই উঠে আসে।

More Articles