আইনের বিকল্প বুলডোজার, এখনও ব্রিটিশ ভূত তাড়া করছে ভারতকে

কথায় কথায় ঔপনিবেশিক শাসনের মুণ্ডপাত করলেও, যোগীর কাঁধে হাত রেখে ভারতবাসীর স্বাধীনতাস্পৃহা, মানবিক অধিকারের দাবিকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঔপনিবেশিক ঔদ্ধত্যেই সিলমোহর দিতে পারেন অবলীলায়। ঔদ্ধত্যের ষোলো কলা পূর্ণ হয় ব্রিটেনে...

 

নরম ঘুমের ঘোর ভাঙল?
দেখ চেয়ে অরাজক রাজ্য;
ধ্বংস সমুখে কাঁপে নিত্য
এখনও বিপদ অগ্রাহ্য?

 

বস্তাপচা সংলাপ, অকারণ মারদাঙ্গা। বাজেট ১০০ কোটি ছাড়িয়ে গেলেও, হিন্দি সিনেমা এখনও সাতের দশকের ফরমুলাতেই আটকে। আইন-আদালত নয়, অন দ্য স্পট জাস্টিসের বুলি আউড়ে চলেছেন বার্ধক্যের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা তাবড় নায়ক। স্বভাবতই তার প্রভাব পড়ছে ব্যবসায়। কিন্তু গা-গরম করা সংলাপ আওড়ে, মেক আপের প্রলেপে বলিরেখা ঢেকেও দর্শককে হলমুখী করা যাচ্ছে না। বরং রাজনীতির রঙ্গমঞ্চই এখন বিনোদনের যাবতীয় রসদ জোগাচ্ছে আম-ভারতবাসীকে। সংবিধানে হাত রেখে আইন এবং বিচারব্যবস্থার মর্যাদা রক্ষার শপথ নিলেও, নায়ক হওয়ার বাসনায় অন দ্য স্পট জাস্টিসই ভরসা হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজনীতির কারবারিদের। তাই কথায় কথায় বুলডোজার নামিয়ে ক্ষমতা প্রদর্শন করা তাঁদের রাজনৈতিক পরিচিতির ট্রেডমার্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার নিচে কে চাপা পড়ছেন, কী তাঁর অপরাধ, তা নিয়ে ভাবাভাবির দায় বা সময় নেই নাগরিক সমাজেরও। বরং মূল্যবৃদ্ধি, বেকারত্বর জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে বিনা পয়সার বিনোদন চেটেপুটে গ্রহণ করছেন সকলেই। আর এই গ্রহণযোগ্যতাকে ভর করেই অ্যাংরি ইয়ং ম্যান হয়ে ওঠার নেশায় বুঁদ যোগী আদিত্যনাথ, শিবরাজ চৌহানরা।

নামের সঙ্গেই জড়িয়ে রয়েছে রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের আদিম অভীপ্সা। আমেরিকার ব্যবসায়ী বেঞ্জামিন হল্টকেই বুলডোজারের প্রবর্তক হিসেবে ধরা হয়। ভারী ওজন তোলা এবং বয়ে আনার জন্য ১৮৯০ সালে ট্র্যাক্টর তৈরি করেন তিনি। তার অগ্রভাগে দাঁতযুক্ত লোহার পাতজুড়ে কালক্রমে আবির্ভাব ঘটে বুলডোজারের। আমেরিকার দুই কৃষক, জেমস কামিংস এবং জে আর্ল ম্যাকলিও ১৯২৩ সালে কৃষিকাজে ব্যবহারের জন্য বুলডোজারের পূর্ণাঙ্গ নকশা তৈরি করেন। ভারতে এই বুলডোজারের রাজনীতিকরণ হালফিলে, যেখানে রাজনৈতিক প্রোফাইলের ওজন বাড়াতে সকালে-বিকেলে রাস্তাঘাটে নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে বুলডোজার। মূলত সংখ্যালঘু, দারিদ্রসীমার নিচে বসবাসকারীরাই তার নিচে পিষ্ট হচ্ছেন। আর দুর্বলের ওপর সবলের এই আঘাতই বীরত্ব, সাহসিকতার তকমা পাচ্ছে। কয়েক বছর আগেও রাজনীতিতে যাঁদের যোগদানকে বাঁকা চোখে দেখতেন সাধারণ মানুষ, বুলডোজারের দৌলতে আজ তাঁদের মধ্যে কেউ ‘বুলডোজার বাবা’ হয়ে উঠেছেন, কেউ আবার হয়ে উঠেছেন ‘বুলডোজার মামা’। খবরের শিরোনামে যেই না নাম উঠছে, যেই না হিন্দুত্বের রক্ষক পরিচয় একটু আড়ালে চলে যাচ্ছে, বুলডোজার নামিয়ে প্রোফাইল আপডেট করিয়ে নিচ্ছেন। ফলও মিলছে হাতেনাতে। সুস্থ-স্বাভাবিক সমাজের গঠনে কোনও অবদান না থাকা সত্ত্বেও, ছেলের হাতের মোয়ার মতোই রাতারাতি দেশের রাজনৈতিক উত্তরাধিকারী বিবেচিত হচ্ছেন।

আরও পড়ুন: একদিকে জঙ্গিদের হুমকি, অন্যদিকে প্রশাসন || কাশ্মীরে যেভাবে বাঁচেন সাংবাদিকরা

ভারতীয় রাজনীতিতে বুলডোজার নীতির প্রতিষ্ঠা উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের হাতে। গোরখপুর মঠের মোহান্ত থেকে রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান হয়ে ওঠা যোগীর রাজনৈতিক উত্থানে আক্ষরিক অর্থেই উত্তোলকের ভূমিকা পালন করেছে বুলডোজার।২০১৭ সালে মুখ্যমন্ত্রীর পদপ্রার্থী হিসেবে কোনও মুখ ছাড়াই নির্বাচনে জয়লাভ করে বিজেপি। তারপর চমকপ্রদভাবে মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে অধিষ্ঠান যোগীর। আর তখন থেকেই রাজনীতিতে তাঁর পাথেয় হয়ে উঠেছে বুলডোজার। দুর্বৃত্ত দমনের যন্ত্র হিসেবে, রাষ্ট্রশক্তির পরিচায়ক হিসেবে বুলডোজারের ব্যবহার শুরু করেন তিনি। অপরাধমূলক কাজকর্মে লিপ্ত থাকার প্রমাণ থাক বা না থাক, দাঙ্গা-হাঙ্গামায় কোনও ভূমিকা থাক বা না থাক, সন্দেহভাজন মনে হলেই বুলডোজার নামিয়ে অন দ্য স্পট জাস্টিসের নামে প্রথমে জনৈক ব্যক্তির বাড়ি-দোকান প্রথমে গুঁড়িয়ে দেওয়ার রীতি চালু হয়। অর্থাৎ জনৈক ব্যক্তি আদৌ অপরাধী না কি নির্দোষ, আইনি পথে তার বিচার হবে পরে। বুলডোজার নামিয়ে আগেই শাস্তি প্রদান সেরে রাখা। উল্লেখযোগ্যভাবে শাস্তিপ্রাপ্তদের তালিকায় সংখ্যালঘু মুসলিমদের অধিক্য চোখে পড়ার মতো, যা গেরুয়া শিবিরের হিন্দুত্ববাদী আদর্শেরও পাথেয়।

Protest against bulldozer politics

প্রতিবাদে পথে সংখ্যালঘুরা

নিজের হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে কোনও কালেই রাখঢাক করেননি যোগী। মসজিদ-সংক্রান্ত কোনও কর্মসূচিতে অংশ না নেওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সগর্বেই ঘোষণা করেন, মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ে হিন্দু যোগীর পরিচয় তাঁর কাছে ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই মসজিদ-সংক্রান্ত কোনও কর্মসূচি বা অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার আগ্রহ নেই তাঁর। তাই বুলডোজারের নিচে পিষ্ট সংখ্যালঘু মুসলিমদের সংখ্যা বেশি হওয়া নিয়ে মাথা ব্যথা নেই তাঁর সরকারের মন্ত্রী-আমলা, এমনকী, পুলিশেরও। বরং তা নিয়ে বিক্ষোভ হলে কার্যত হুঁশিয়ারির সুরে যোগীর উপদেষ্টাকে বলতে শোনা যায়, "উপদ্রবকারীদের মনে রাখা উচিত, শুক্রবারের পর শনিবার কিন্তু আসবেই।" পড়শি রাজ্য হরিয়ানায় বিজেপি-র আইটি সেলের দায়িত্বে থাকা অরুণ যাদবও নির্লিপ্ত সুরে বলেন, "শুক্রবার যদি পাথর ছোড়ার দিন হয়, শনিবার বুলডোজার দিবস হওয়া উচিত।" নির্দিষ্ট করে শুক্রবার, মুসলিমদের নমাজ পড়ার দিনটির উল্লেখ রাজনৈতিকভাবে কোনদিকে ইশারা করে, তা অতি বড় অরাজনৈতিক ব্যক্তির পক্ষেও বোঝা অসম্ভব নয়।

বিরোধীদের আক্রমণ করতে গিয়ে বারবার মুসলিম তোষণের কথা উঠে এসেছে যোগী এবং বিজেপি নেতাদের মুখে। বুলডোজারের নিচে চাপা পড়া বিরোধী শিবিরের লোকজনের সংখ্যাও নেহাত কম নয়।২০২২-এর এপ্রিলে প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযাযী, ২০১৭ সালে যোগী প্রথমবার উত্তরপ্রদেশের মসনদে আসীন হওয়ার পর, ২০১৭-র ২০ মার্চ থেকে ২০২১-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত উত্তরপ্রদেশে গ্যাংস্টার আইনে ১৪,৯৮২টি মামলা দায়ের হয়। গ্রেফতার হন ৪৭,২১৪ জন। ৬৮৫ জনকে গ্রেফতার করা হয় জাতীয় নিরাপত্তা আইনে। বুলডোজার নামিয়ে তাঁদের ১,৯৩১ কেটি টাকার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত এবং গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। ২০২২ সালের ২৫ মার্চ দ্বিতীয়বার উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে যোগী শপথ নেওয়ার পর, প্রথম ১০০ দিনের কাজের যে হিসেব দিয়েছে তাঁর সরকার, তাতে ২,৯২৫ কোটি টাকার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত এবং গুঁড়িয়ে দেওয়ার কথা বলা রয়েছে। দ্বিতীয়বার যোগী জয়যুক্ত হওয়ার পর তাঁর সরকারের তদানীন্তন মন্ত্রী বলদেব সিং অউলাখকে বলতে শোনা যায়, “আমরা রেশন দিয়েছি, চিকিৎসা পরিষেবা দিয়েছি, মাথার ওপর ছাদ গড়ে দিয়েছি। মুসলিমরাও সব সুবিধা নিয়েছেন। তার পরেও বিজেপি-কে হারানোর চেষ্টায় ত্রুটি রাখেননি। ওদের নিয়ে ভাবতে হবে আমাদের। আরও জোরে ছোটাতে হবে বুলডোজার।”

সরকার-বিরোধী অবস্থান হোক বা পয়গম্বর মহম্মদকে নিয়ে বহিষ্কৃত বিজেপি নেত্রী নুপুর শর্মার বিতর্কিত মন্তব্য, যখনই রাস্তায় নেমেছেন রাজ্যের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ, তাঁদের দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছে যোগী সরকারের বুলডোজার। বুলডোজার তাঁর সরকারের শাসনক্ষমতার প্রতীকে পরিণত হয়েছে। যে কারণে দ্বিতীয়বার শপথগ্রহণের আগে ‘বুলডোজার বাবা’ যোগীর হাতে রূপোর তৈরি বুলডোজার উপহারস্বরূপও তুলে দেন রাজ্যের ব্যবসায়ী মহলের প্রতিনিধিরা। উত্তরপ্রদেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে এই বুলডোজার নীতি সংক্রমণের আকার ছড়িয়ে পড়েছে বিজেপি-শাসিত অন্য রাজ্যগুলিতেও। প্রতিপত্তিতে যোগীর সমকক্ষ হয়ে উঠতে একই পন্থা অবলম্বন করছেন মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান। পরোপকারী মামা থেকে এই মুহূর্তে ‘বুলডোজার মামা’ হয়ে উঠেছেন তিনি। রামনবমীকে ঘিরে অশান্তি মাথাচাড়া দিলে এপ্রিল মাসে বুলডোজার নামিয়ে খারগনে ৫০টি বাড়ি গুঁড়িয়ে দেয় শিবরাজ সরকার, যার মধ্যে সিংহভাগ বাড়ির মালিকই ছিলে মুসলিম নাগরিক। পাথর ছোড়ার ঘটনায় এরপর ১৬টি বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়, যার মধ্যে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে নির্মিত বাড়ি ছিল বেশ কয়েকটি। এরপর বিজেপি-শাসিত হরিয়ানার মনোহরলাল খট্টর সরকারও উচ্ছেদ অভিযানের নামে বুলডোজার নামিয়ে ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার কাজে নামে।

তবে এই বুলডোজার অভিযান দিল্লি না পৌঁছলে বোধহয় এত হইচই হতো না। বেআইনি জবরদখলকারীদের হটানোর নামে এই বছর এপ্রিল মাসে দিল্লির জাহাঙ্গিরপুরিতে উচ্ছেদ অভিযান চালাতে নামানো হয় বুলডোজার। হনুমান জয়ন্তীর মিছিল ঘিরে তার আগেই সাম্প্রদায়িক হিংসা ছাড়ায় ওই এলাকায়। তার ঠিক পরেই বুলডোজার নামানোয় দুইয়ে দুইয়ে চার করতে অসুবিধা হয়নি কারও। সুপ্রিম কোর্ট ভাঙার কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়ার পরও চলতে থাকে অভিযান। শেষমেশ বাম নেত্রী বৃন্দা কারাটকে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের প্রতিলিপি নিয়ে বুলডোজারের সামনে দাঁড়াতে হয়। সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন এবং জাতীয় নাগরিকপঞ্জি-বিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল শাহিনবাগেও এরপর পৌঁছয় বুলডোজার। প্রবল জনবিক্ষোভের মুখে পড়ে সেখান থেকে যদিও পিছু হটতে হয়। এর সঙ্গেও রয়েছে বিজেপি তথা কেন্দ্রীয় সরকারের সংযোগ। দিল্লি আম আদমি পার্টি-র দখলে থাকলেও, দিল্লির তিন পুরসভার নিয়ন্ত্রণ বিজেপি-র হাতে। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার এই তিন পুরসভাকে একত্রিত করার বিল পাশ করিয়ে নেয়, যাতে তিন পৃথক মেয়র নন, একজনের হাতেই পুরসভার ভার থাকবে বলে ঠিক হয়। তাই পুর নির্বাচনের আগে গেরুয়া নেতৃত্বর নেকনজরে থাকতেই তিন মেয়রের তরফে এক এক দিন এক এক জায়গায় বুলডোজার চালানোর তৎপরতা চোখে পড়ে। বাংলা, বিহার থেকে যাওয়া মানুষ, পাট্টা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে যাঁরা ওই এলাকায় বাস করছেন, তাঁদের রাতারাতি রোহিঙ্গা মুসলিম বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়। উচ্ছেদ অভিযানকে আইনি বৈধতা দেওয়ার প্রচেষ্টা লক্ষ করা যায় বিজেপি-র তরফেও।

কিন্তু উত্তরপ্রদেশ হোক বা মধ্যপ্রদেশ, হরিয়ানা হোক বা দিল্লি, বুলডোজার রাজত্ব চালাতে গিয়ে আইনের ধার ধারেননি কোনও মুখ্যমন্ত্রীই। বেআইনি জবরদখলকারীদের হাত থেকে সরকারি জমি রক্ষার নামে এই অভিযানে মূলত সংখ্যালঘু মুসলিমদেরই বেছে বেছে নিশানা করা হয়েছে। নির্মাণ বেআইনি হলেও, নিয়মমাফিক আগে জনৈক জবরদখলকারীকে আইনি নোটিস ধরাতে হয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বিনা নোটিসে বুলডোজার গিয়ে বাড়ি ভাঙতে শুরু করে। আবার কিছু ক্ষেত্রে শুধুমাত্র বিক্ষোভে অংশ নেওয়ার দরুন বাড়ি-দোকান ভাঙার যুক্তি উঠে এসেছে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে বেআইনি নির্মাণ-সংক্রান্ত বিষয় আদালতের বিচারাধীন থাকা অবস্থাতেই ভাঙচুর চালানো হয়েছে। তোয়াক্কা করা হয়নি সামনের জনের উত্তর এবং যুক্তিরও। তা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের তরফেও ভর্ৎসনার বাণী শোনানো হয়। শুধুমাত্র প্রতিহিংসা পূরণ করতে ভাঙচুর চালানো যায় না, তার বৈধ কারণ থাকা উচিত বলে মন্তব্য করে দেশের শীর্ষ আদালত। কিন্তু তারপরও বুলডোজার অভিযান বন্ধ হয়নি। বরং উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ এবং দিল্লিতে বুলডোজার অভিযানের বিরুদ্ধে জামিয়ত-উলেমা-ই-হিন্দ সংগঠনের তরফে স্থগিতাদেশের আর্জি জানানো হলে সুপ্রিম কোর্ট জানায়, পুরসভা কোনও নির্মাণকে বেআইনি মনে করলে, তাদের হাত বেঁধে দেওয়া আদালতের পক্ষে সম্ভব নয়। ফলে যা হওয়ার, তা হয়ে চলেছে।

বিগত কয়েক মাস ধরে একাধিক মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায় শুনে কপালে ভাঁজ পড়েছে চিন্তাশীল মানুষের। কিন্তু বুলডোজার রাজত্ব নিয়ে নাগরিক সমাজের নীরবতাও চোখে পড়ার মতো। গ্রাম থেকে জীবিকার সন্ধানে আসা শহুরে দরিদ্রদের নিয়ে যে কারও মাথাব্যথা নেই, একের পর এক ঘটনাই তার প্রমাণ। বাণিজ্যনগরী মুম্বইয়ে জনসংখ্যার ৫০ শতাংশর স্থায়ী ঠিকানা নেই। সরকারি শৌচালয়ের ওপর নির্ভরশীল ৪১.৭ শতাংশ। রাজধানী দিল্লির সৌন্দর্যায়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানো পরিযায়ী মানুষের পুনর্বাসন স্থল হিসেবে ইন্দিরা গান্ধীর আমলে চিহ্নিত হয়েছিল জাহাঙ্গিরপুরী। বংশপরম্পরায় সেখানে যেমন‍-তেমনভাবে মাথা গুঁজে রয়েছেন হাজার হাজার মানুষ। বাংলা বিহার, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান থেকে আসা মানুষ সরকারি পাট্টার ওপর নির্ভর করে সেখানে এত বছর ধরে বাস করে আসছেন। রাতারাতি তাঁদের উচ্ছেদ করা শুধুমাত্র বাসস্থানের অধিকার আইনের পরিপন্থীই নয়, নৈতিকতা-বিরোধীও। কিন্তু নাগরিক সমাজের সিংহভাগই এই সমস্ত শহুরে দরিদ্র মানুষের জন্য ভাবিত নন। তাঁদের ভোটের ওপর সরকার গঠনও নির্ভর করে না। তাই তাঁরা গেলেন কি থাকলেন, তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই সরকারেরও। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু ভোট, উচ্চবর্ণের সমর্থন ধরে রাখাই লক্ষ্য কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের। তাতে যাবতীয় ফাঁক-ফোকর বুজিয়ে ফেলতেই বুলডোজার নামিয়ে আস্ফালন।

তাই ১৩০ কোটি জনতার উদ্দেশে ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস’-এর বুলি আউড়ালেও, 'বুলডোজার বাবা’ যোগীকে প্রশংসায় ভরিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী। যোগীর কাঁধে ভরসার হাত রেখে, একসঙ্গে ছবি তুলে অলিখিতভাবে যোগীকে নিজের উত্তরাধিকার হিসেবে তুলে ধরতে পারেন তিনি। কথায় কথায় ঔপনিবেশিক শাসনের মুণ্ডপাত করলেও, যোগীর কাঁধে হাত রেখে ভারতবাসীর স্বাধীনতাস্পৃহা, মানবিক অধিকারের দাবিকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঔপনিবেশিক ঔদ্ধত্যেই সিলমোহর দিতে পারেন অবলীলায়। ঔদ্ধত্যের ষোলো কলা পূর্ণ হয় ব্রিটেনের সদ্য প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনকে ডেকে এনে, জেসিবি মেশিনে চাপিয়ে, বুলডোজার শাসনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হিসেবে তুলে ধরার মাধ্যমে। ঔপনিবেশিক শাসনের সেই ঔদ্ধত্য কাটিয়ে উঠতে ২০০ বছর সময় লেগেছিল ভারতের। তাই দেশের সংখ্যাগুরুরা যত দিন পর্যন্ত সংখ্যালঘুর অধিকার রক্ষার সাংবিধানিক এবং মানবিক দায়-দায়িত্ব স্বীকার করছেন, রাজনীতির কারবারিদের হাতে অন দ্য স্পট জাস্টিসের নামে গুন্ডানীতি, দমন, পীড়ন এবং শোষণ চলতেই থাকবে।

More Articles