রেফারির চোখকে সরিয়ে আসছে যন্ত্র! অফসাইডের নতুন নিয়ম কতটা ঠিক, কতটা ভুল
World Cup 2022: অফসাইড পুরোপুরি যান্ত্রিক হয়ে যাবে কি না, তা বলা শক্ত।
অফসাইড বোধহয় ফুটবলের সবচেয়ে বড় বিতর্কের ক্ষেত্র। ক্রিকেটের এলবিডব্লুর সঙ্গে এর তুলনা করা হয় প্রায়ই। আইনদুটোই যে জটিল, সেটা বোঝা যায়, কারণ পাড়ার মাঠে বিকেলবেলা যে ক্রিকেট বা ফুটবল খেলা হয়, তাতে প্রায় কখনওই এলবিডব্লু বা অফসাইড আইন প্রয়োগ করা হয় না। প্রথমত, তাতে সাংঘাতিক ঝগড়া হবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ভুল সিদ্ধান্ত দেওয়া হচ্ছে বলে। আর দ্বিতীয়ত, সবার আন্ডারস্ট্যান্ডিং সমান নয় বলে আইনের প্রয়োগ সমানভাবে হবেই না।
সবার আন্ডারস্ট্যান্ডিং সমান নয় কেন? কারণ এই আইনগুলো প্রচণ্ডভাবে ইন্টারপ্রিটেশন-নির্ভর। লেটারের থেকে ঢের বেশি ইম্পর্ট্যান্ট এখানে স্পিরিট। আইনটা এবং ঘটনাটা দুটোই কীভাবে দেখা হচ্ছে, তার ওপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত।
ফুটবলের আদি দশায় অফসাইড ব্যাপারটা সেভাবে ছিল না। জেসি থ্রিং বলে এক ইস্কুলমাস্টার একটানা অফসাইড আইন প্রবর্তনের পক্ষে সওয়াল করেন। প্রথম যখন ফুটবলের নিয়মকানুন পাকাপোক্তভাবে লিপিবদ্ধ করা হয়, তখন অফসাইড আইন ছিল বেশ কড়া। বলের সামনে থাকলেই সেটা হতো অ্যাটাকিং প্লেয়ারের জন্য অফসাইড পজিশন। সবাইকে ছুটতে হতো বলের পেছনে। বোঝাই যাচ্ছে, কেন থ্রু-পাসিং বা অনেক ক্ষেত্রে ক্রসিংয়ের থেকেও বেশি তৎকালীন খেলোয়াড়রা ভরসা রাখতেন পায়ে বল নিয়ে কাটিয়ে কাটিয়ে গোল দেওয়ায়। সব পাস যেখানে খুব সাবধানে করা স্কোয়ার পাস বা ব্যাক পাস হবে, সেখানে আক্রমণে পাসিং ফুটবল খেললে অ্যাটাকের গতি প্রতিহত হবে খালি।
আরও পড়ুন: ফুটবলে নায়কের জেল্লা বেশিদিন থাকে না
তবে এই নিয়ম বেশিদিন টেকেনি। খুব শিগগিরই আইন হয়, প্লেয়ার বল পাওয়ার সময় তাঁর সামনে থাকতে হবে তিনজন বিপক্ষ দলের ফুটবলারকে। এই আইনটা প্রায় ষাট বছর ছিল। বহুবার বহুভাবে তিন জনকে দু'জনে নামিয়ে আনার জন্য এফ্এ-কে চাপ দেওয়া হয়েছিল। তাতে লাভ খুব একটা হয়নি। অবশেষে ১৯২৫ সালে হাইবুরিতে একটা ট্রায়াল ম্যাচ খেলিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে সামনে তিন জনের বদলে দু'জন বিপক্ষ খেলোয়াড় হলেই অনসাইড থাকা যাবে। এতে দুম করে বেড়ে যায় গোলের সংখ্যা। লং-বল জিনিসটার ব্যাপক প্রয়োগ শুরু হয়ে গিয়েছিল। এই আইনটাই বেশ কিছু সূক্ষ্ম পরিবর্তনসমেত রয়ে গেছে আধুনিক ফুটবলে।
অফসাইড নিয়মের ঠিকঠাক প্রয়োগ নিয়ে ঝামেলা সর্বদা ছিল। ১৯৮৬ সালের বিশ্বকাপে বেলজিয়ামের সাথে সোভিয়েত ইউনিয়নের খেলাটা ৪-৩ গোলের একটা থ্রিলার হয়েছিল। তাতে বেলজিয়ামের ফরওয়ার্ড একবার বিশাল অফসাইডে বল পেয়ে গোল করেন। রেফারি গোল বাতিল করেননি। আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে যে, আমি কেন ভিএআরের পক্ষে, আমি ঠিক এই কারণটাই দর্শাব। পরিষ্কার ভুলগুলো আর ঘটবে না।
তাই বলে ভিএআর এবং নতুন সংযোজিত সেমি-অটোমেটেড অফসাইড নিয়ে আমার মনের ভাব খুব অবিমিশ্রভাবে ইতিবাচক একদমই নয়। এই পদ্ধতিতে গোদা চোখে ধরা না পড়ার মতো অফসাইড গুলোকে মাঠের ছাদের নিচে স্থিত ১২টি রোবটচক্ষু একাগ্রভাবে দেখে, ভিএআর অফিশিয়ালদের খবর পাঠায়। প্রতি সেকেন্ডে পাঁচশোটা ফ্রেম দেখায় যে ক্যামেরায়, সেটার সাহায্যে সূক্ষ্ম অফসাইড বোঝা অনেকটাই সহজ হয়ে আসে। ভিএআর অফিশিয়াল খবর দেন রেফারিকে, তিনি সেই বুঝে সিদ্ধান্ত জানান, একটু দেরিতে হলেও।
সেমি-অটোমেটেড অফসাইড ব্যবস্থা বেশ শক্ত হাতে আইনের প্রয়োগ করে। কিন্তু সেই প্রয়োগ একেবারে সৎ এবং নিরপেক্ষ হতে গিয়ে হয়ে যাচ্ছে প্রেক্ষাপটের প্রতি উদাসীন। আইনের চোখে কাপড় জড়িয়ে রাখায় আইন তো স্রেফ পক্ষপাতহীন হয় না, পাশাপাশি ইমিডিয়েট কনটেক্সটের ব্যাপারেও জ্ঞানহীন হয়ে পড়ে। সেটাই হচ্ছে। খুব ঘনঘন। অফসাইডকে আইনি শব্দের প্যাঁচের চাইতেও বেশি করে দেখা উচিত একটা সহজ-সরল নিয়ম হিসেবে। এবং বোঝা দরকার কেন অফসাইডের জন্ম হয়েছিল।
অফসাইডের জন্ম হয়েছিল অন্যায় সুবিধে নেওয়ার থেকে অ্যাটাকিং প্লেয়ারদের আটকানোর জন্য। যেখানে সামনে কোনও প্রতিপক্ষ নেই, সেখানে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে দূর থেকে পাওয়া বল নিয়ন্ত্রণ করে যাতে গোল না দিয়ে ফেলা যায়। এটা যেন কিছুতেই গেম-প্লে স্ট্র্যাটেজি না বনে যায়। অফসাইডের দায় নয় কারও বাড়িয়ে রাখা হাতের লাগোয়া কাঁধ দেড় সেন্টিমিটারের জন্য বিপক্ষের শেষ ডিফেন্ডারের হাঁটুর থেকে বেশি এগিয়ে আছে কিনা। অথচ বাস্তবে হচ্ছে সেটাই।
সেমিঅটোমেটেড অফসাইড থাকুক। বিলকুল থাকুক। কিন্তু যেখানে অন্যায্য সুবিধে নেওয়ার কোনও স্কোপ নেই, সেখানে অফসাইড দেওয়া হলে ব্যাপারটা বেশ একগুঁয়ে হয়ে পড়ে। এখানে অনেকে বলতে পারেন যে, মানুষের নিজস্ব আন্ডারস্ট্যান্ডিং প্রয়োগ করার জায়গায় জিনিসটা ফের চলে এলে অফসাইড স্ট্যান্ডার্ডাইজড হবে না। ভালো যুক্তি নিঃসন্দেহে। তবে সেমিঅটোমেটেড হবার পরও অফসাইড আইনের প্রয়োগ খুব সমান বলে তো অনেক সময়েই মনে হচ্ছেনা। আশা করি, সেমিঅটোমেটেড অফসাইড আরও সমানভাবে প্রয়োগ করা হবে ধীরে ধীরে। কিন্তু তবুও, আমি ফুটবল রোমান্টিকের মতো দাবি করব, যাতে অন্যায্য সুবিধে নেওয়ার ব্যাপারটা কর্তৃপক্ষের মাথায় থাকে। তেমন হলে অন্যায্য সুবিধে কী, সেটা সংজ্ঞায়িত করে দেওয়া হোক। গোলের ছ'গজ দূরে আধ ইঞ্চি পা বেরিয়ে থাকলে সেটা অন্যায্য হলেও ৪৫ গজ দূরে সেটাকে 'সুবিধে' বলা হবে কি না, সেটা ভাবার বিষয়। অবশ্য এতে জটিলতা আরও বাড়বে। অনেক বাড়বে। তবে জটিলতা এখনও বিশেষ কম নেই। এই ভিএআর আর সেমিঅটোমেটেড অফসাইড নিয়ে অনেক জলঘোলা চলছে। প্রচুর মানুষ মনে করেন ফুটবলের সহজ সারল্যকে রীতিমতো বিপাকে ফেলছে এই নিয়ম। বিশেষ করে গোল ঘোষিত হয়ে যাওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পর দুমদাম গোল বাতিল হয়ে গেলে অদ্ভুতই লাগে বেশ। যদি আইনে বিরাট বদল নাও আসে, সেটার প্রয়োগকে আরও মসৃণ করে দেওয়া দরকার। গোল নাকি গোল নয়, সূক্ষ্ম অফসাইড ছিল কিনা, সেসব বোঝার জন্যে দু'-তিন বা চার মিনিট নিয়ে নেওয়া হলে দর্শক তো রেগে যাবেই। এখনও সেমিঅটোমেটেড অফসাইড যেন খানিকটা সাহায্যকর্তা হিসেবেই রয়ে গেছে অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারির জন্য। এটা না করে ওটার প্রয়োগটাকে আরও সর্বাত্মক করে দিয়ে আইন ভাঙার মুহূর্তেই সচেতন করে দিক ফ্ল্যাগ হাতে দাঁড়ানো অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারিকে।
অফসাইড পুরোপুরি যান্ত্রিক হয়ে যাবে কি না, তা বলা শক্ত। এমনিতেও অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারির কাজটা আমার ফুটবলে সবচেয়ে কঠিন বলে মনে হয়। খালি চোখে তিনি যেটা করেন, সেটাকে অসাধ্যসাধন বলাই যায়। তবে পুরোদস্তরভাবে প্রযুক্তির স্বচ্ছ প্রয়োগ এই আইনকে অবশেষে একেবারে স্ট্যান্ডার্ডাইজ করে দিতে পারে। তাতে অবিশ্যি অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারির দায়িত্ব কমেনা। মাঠে যন্ত্রের নেওয়া সিদ্ধান্ত সময়মাফিক জানানোর পাশাপাশি মাঠের কিছু অংশের ফাউল দেখা আর থ্রো ইত্যাদি পরিচালনা করার জন্য তাঁর ভূমিকা একেবারেই খাটো করা যাবে না।
অফসাইড ফুটবলকে দিয়েছে একটা ইন্টারেস্টিং পরিমিতিবোধ। সর্বাত্মক আক্রমণেও তাই খেলোয়াড়দের অনুশীলন করতে হয় তীক্ষ্ণ-ধী কায়দায় পজিশন বজায় রাখার অভ্যেস। অফসাইড আইন ফুটবলের আবেগী যে গঠন, তার একটা প্রচণ্ড গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। প্রিয় খেলোয়াড়ের গোল একটুর জন্য বাতিল হওয়ার কষ্ট, বড় ম্যাচে গোলের আনন্দে নেচে উঠতে উঠতে হতাশায় ভেঙে পড়া, শেষ মুহূর্তে বিপক্ষ গোল দেওয়ার পর অ্যাসিস্ট্যান্ট রেফারির ফ্ল্যাগ তোলার স্বস্তি– এগুলো বাদ গেলে ফুটবল বড় পানসে হয়ে যাবে। তবে অফসাইড আইন ব্যবহার করে যারা ফুটবলকে গেটকিপ করে, যারা উদ্ধতভাবে "অফসাইড কাকে বলে বল তো?" জিজ্ঞেস করে, তারাও ওই অফসাইড আইনের মতোই, ফুটবলের লেটারটুকু বোঝে, স্পিরিটটা একটুও বোঝে না।