ফুটবলে নায়কের জেল্লা বেশিদিন থাকে না

World Cup 2022: ফুটবলের অর্গ্যাজম হলো গোল। অর্গ্যাজমের মতোই, প্রতি ম্যাচে গোল দেখতে পাওয়াটাও আজকালকার ফুটবলে দুর্লভ হয়ে উঠেছে।

নায়ক
সেই কবে একদিন হাওয়ার দেবী আলতো ঠোঁট ছোঁয়ালেন মানুষের পায়ে- চিরকালের অশ্রদ্ধা আর অবহেলার পায়ে- সেই চুম্বন থেকে জন্ম হয় ফুটবলের নায়কের। সে জন্মছে টিনের চালের খুপরি ঘরে, খড়ের বিছানায়। প্রায় তখন থেকেই সে বলের সঙ্গে সেঁটে থাকে।

এদিকে হাঁটি হাঁটি পা পা-এর বয়স থেকেই সে শিখে যায় ফুটবল কীভাবে খেলতে হয়। একেবারে শুরুর দিকে পাড়ার ছোট্ট একচিলতে মাঠে খুশির হাওয়া বইয়ে দেয়। বস্তির পিছন দিকের গলিতে রাত না-নামা পর্যন্ত পাগলের মতো বল পেটায়, তখন হয়তো আর বল দেখাই যাচ্ছে না তবু খেলে যায়। খানিক বড় হয়েই ছেলেটি উড়োজাহাজে চড়ে বসে আর স্টেডিয়ামগুলোও তার সঙ্গে সঙ্গে উড়তে থাকে একটা জয় থেকে আরেকটা জয়ে, সংবর্ধনা থেকে সংবর্ধনায়।

বল নিজেই তাকে খুঁজে বের করে, তাকে হাড়ে-মজ্জায় চেনে, তাকে চায়। তার পায়ের পাতায় আশ্রয় খোঁজে, স্থির হয়ে বসে। সে তাকে আদর করে, কথা বলায়। এই অন্তরঙ্গ সংলাপে লাখো অব্যক্ত স্বর বাঙ্ময় হয়ে ওঠে। তুচ্ছ নগণ্যের দল, চিরকাল যাদের অবজ্ঞাত করে রাখা হয়েছে, তারাও জীবনের মানে খুঁজে পায় এইসব ওয়ান-টু পাসের দৌলতে, ঘাসের বুকে জেড অক্ষর এঁকে দেওয়া ড্রিবলে, অসামান্য সব ব্যাকহিল গোলে, মাথার ওপর দিয়ে তুলে মারা ভলিতে। সে যখন খেলতে থাকে, দলে বারোজন খেলোয়াড়: ‘বারো? ওটা আসলে পনেরো! কুড়ি!’

আরও পড়ুন: পেশাদার ফুটবলে খেলোয়াড় ‘দাস’, জেতা ছাড়া তার কাছে অন‍্য বিকল্প নেই

বল আপনমনে হেসে ওঠে, শূন্যে আলো ছড়ায়। সে তাকে মৃদু টোকায় নিচে নামিয়ে আনে, ঘুম পাড়ায়, সোহাগে ভরিয়ে দেয়, তার সঙ্গে নাচে। এই সব অভূতপূর্ব জিনিস দেখে তার ভক্তমণ্ডলী এই ভেবে নিজেদের না-হওয়া নাতিপুতিদের জন্য সমব্যথী হয় যে, বেচারারা ফুটবলের এই জাদু দেখতে পেল না!

কিন্তু নায়কের জেল্লা বেশিদিন টেকে না। মানুষ আবার কবে অমর হলো! তার সোনায় মোড়ানো পা দু'-খানি যখন ঝিমিয়ে আসে, প্রথম বিস্ফোরণের পর শুরু হওয়া তারকার আয়ু ক্রমে ঢলে পড়ে কৃষ্ণগহ্বরে। ততদিনে তার শরীরে জোকারের পোশাকের চেয়েও বেশি তালি-তাপ্পি। ততদিনে বাজিকর অথর্ব হয়ে পড়েছে, শিল্পী তখন বন্য বোঝা-য় রূপান্তরিত: ‘ওই কম্মের দুখিরামকে দিয়ে আর চলবে না।'

জনতার প্রশস্তির ঝরনা ততক্ষণে বিদ্বেষের অশনিতে রূপান্তরিত, ‘শালা ঘাটের মরা’।

সবসময় অবিশ্যি নায়কের পতন হঠাৎ করে ঘটে না। আবার কখনও নায়কের অপমৃত্যু গণস্মৃতি থেকে দ্রুত মুছেও যায়।       

ভক্ত
হপ্তায় একদিন ফুটবলের ভক্ত ঘর থেকে স্টেডিয়ামের দিকে দৌড় লাগাবেই।

ব্যানার-পতাকা দুলবে, নানান ধাতব বাজনার আওয়াজে আকাশ-বাতাস মুখরিত হবে। গোল করে পাকানো কাগজ উড়িয়ে রঙের ঢেউ বয়ে যাবে শূন্যে, টুকরো রঙিন কাগজ পরাগরেণুর মায়ায় ভরিয়ে দেবে মাঠের অনেকটা অংশ। সেই সময় গোটা শহরটা কিছুক্ষণের জন্য অদৃশ্য হয়ে যায়, দৈনন্দিনের যাবতীয় রুটিন ভুলে বসে সবাই। থাকে শুধু মন্দির। ওই পবিত্র স্থানে তখন হাজির পৃথিবীর একমাত্র ধর্মাবলম্বীরা যাদের মধ্যে নাস্তিকের কোনো স্থান নেই, তারা সবাই তখন ব্যস্ত তাদের দেবতার মহিমা প্রচার করতে। যদিও ফুটবলের ভক্তরা টিভিতে ম্যাচ দেখলে মাঠের যাবতীয় অলৌকিক ঘটনা স্বচ্ছন্দে অনেক বেশি উপভোগ করতে পারে, তবু সে তীর্থযাত্রীর পরম নিষ্ঠায় মাঠে যায়, যেখানে তার রক্তমাংসের দেবদূতরা সেদিনের অপদেবতাদের সঙ্গে লড়ছেন।

এখানে ভক্তরা প্যান্টের পকেট থেকে রুমাল বের করে ওড়ায়, গপ্ করে গিলে নেয় নিজেরই মুখের লালা, না খেয়ে খেয়ে পিত্তি পড়ে, মাথার টুপি খুলে চিবোয়, ফিসফিস করে ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করে, প্রতিপক্ষকে শাপমন্যি করে, আবার হঠাৎ করে প্রবল চেঁচিয়ে ওঠে। একটা গোল হলে সম্পূর্ণ অপরিচিতকেও প্রায় ঝাঁপ মেরে মাছির মতো জাপটে ধরে। যতদিন ফুটবলে উন্মত্ত জনতা আছে ততদিন ভক্তের অভাব হবে না। এমন হাজারও নিবেদিতপ্রাণ ভক্ত বিশ্বাস করে তার দলই দুনিয়ার সেরা, সব রেফারিই একচোখো আর সমালোচকরা একেকটা জোচ্চোর।

ভক্তরা কখনওই বলে না, ‘আজ আমার দলের খেলা আছে।’ তাদের বাঁধাবুলি, ‘আজ আমাদের খেলা।' তারা জানে বারো নম্বর জার্সি আবেগের হাওয়ায় ঘূর্ণির বেগ আনতে পারে, যা ঘুমিয়ে পড়া বলকেও তীরের বেগে সামনের দিকে উড়িয়ে নিয়ে যায়, তেমনি দলের এগারোজন খেলোয়াড়ও জানে ভক্তেরা না থাকলে তাদের খেলাটা হয়ে দাঁড়াবে কোনও বাজনা ছাড়াই নাচার মতো।

খেলা শেষ হওয়ার পরও ভক্তরা মাঠ ছেড়ে যায় না, ওখানে বসেই নিজেদের জয় উদযাপন করে: ‘কেমন গোলটা হল বলো দোস্ত!’ ‘ওদের কেমন দিলাম বলো!’ নইলে হারের যন্ত্রণায় ভেঙে পড়ে : ‘ওরা ফের জালিয়াতি করে জিতল।' ‘রেফারিটা পুরো জালি।' তারপর ধীরে ধীরে সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়ে আর ভক্তেরাও বাড়ির দিকে যায়। শূন্য স্টেডিয়াম জুড়ে নেমে আসে ছায়ার আলো-আঁধারি। স্টেডিয়ামের কংক্রিটের ছাদে ইতস্তত আগুন জ্বলতে থাকে। তারপর একসময় মানুষের কণ্ঠস্বর আর আলোও মিলিয়ে যায়। ফাঁকা স্টেডিয়াম একা দাঁড়িয়ে থাকে। ভক্তরাও ফেরে নিঃসঙ্গতায়: আবার আমরা থেকে ফেরে আমিতে। তারা চলে গেলে ভিড় হঠে যায়, কালো কালো মাথার জটলা গলে গলে যায়। হুল্লোড় শেষে রোববারটা একেবারে নষ্ট হয়ে যায়।  

অন্ধভক্ত
ফুটবলের অন্ধভক্তদের প্রকৃত ঠিকানা হলো পাগলাগারদ। সব কিছুকে অস্বীকার করার বাতিক তাদের মাথার যাবতীয় প্রমাণ-সাবুদকে ঘেঁটে ঘণ্ট পাকিয়ে ফেলে। আর মগজের এই জাহাজডুবির অবশিষ্টাংশ জলের মধ্যে প্রমত্তের মতো এলোমেলো এবং প্রবল বিদ্বেষে ভেসে বেড়ায়।

অন্ধভক্তদের দেখা যায়, স্টেডিয়ামে বাজখাঁই গলায় চ্যাঁচাতে, তার সঙ্গে থাকে ব্যক্তিগত টুকিটাকিও।  সে গায়ে জড়িয়ে নেয় দলের পতাকা, গালে ভালবাসার জার্সির রং, স্টেডিয়ামে আসার রাস্তায় বিপুল আদিখ্যেতায় হল্লাহাটি করে। সে কখনও একা আসে না। উচ্ছৃঙ্খল জনতার মাঝে রাস্তা দিয়ে ভাসতে ভাসতে আসে। সে অনেকটা তেঁতুলবিছের মতো। নিজে তেমন সাহসী না হলে কী হবে, অন্যদের বশ্যতা স্বীকার করিয়ে ছাড়ে। অন্ধভক্তরা ভেতরে ভেতরে বেশ ভীতু কিন্তু ক্রমশ তারাই ভয়ের কারণ হয়ে ওঠে। অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন রোববারগুলো তার সারা সপ্তাহের সম্ভাব্য নির্বিবাদী জীবনযাত্রার ভূত তাড়িয়ে ছাড়ে :  তার শয্যা আসক্তিহীন, কাজে মন থাকে না, হয়তো কোনও কাজই নেই! একদিনের জন্য মুক্তি আর তা থেকেই সে জীবনের যাবতীয় পাওনা উসুল করে।

তার খেলা দেখা অনেকটা মৃগীরুগির ফিট হওয়ার মতো, আসলে মনোযোগ দিয়ে খেলা সে দেখেই না। তার খাসতালুক হলো স্টেডিয়ামের দর্শকাসন। ওটাই তাদের যুদ্ধক্ষেত্রও। সেখানে প্রতিপক্ষের কোনও ভক্ত যদি কোনও ভাবে থেকে যায়, তো আগুনে ঘি পড়তে আর বাকি থাকে না। ভালো তো হিংস্র হয় না। কিন্তু অশুভ আর কোনও বিকল্প পথ খোঁজে না। এমন ভক্তের কাছে প্রতিপক্ষ সব সময়ই ভুলে ভরা, তাই তাকে আচ্ছাসে রগড়ানি দেওয়া প্রয়োজন বলে সে মনে করে। তার মাথায় সব সময় প্রতিপক্ষ গিজগিজ করে। এমনকী প্রকৃতই শান্ত কোনও দর্শক স্টেডিয়ামে বসে যদি বলে ফেলে যে, অন্ধভক্তটির প্রতিপক্ষ দল বেড়ে খেলছে। তাহলে তার যা প্রাপ্য, তা সুদে-আসলে মিটিয়ে দেওয়া হয়।         

গোল
ফুটবলের অর্গ্যাজম হলো গোল। অর্গ্যাজমের মতোই, প্রতি ম্যাচে গোল দেখতে পাওয়াটাও আজকালকার ফুটবলে দুর্লভ হয়ে উঠেছে।

পঞ্চাশ বছর আগে, কোনও খেলা গোলশূন্যভাবে শেষ হচ্ছে এমনটা দেখাই যেত না: ০-০, দুটো হাঁ মুখ, একজোড়া হাই তোলা যেন। কিন্তু আজকাল এগারো জন খেলোয়াড় পুরো নব্বই মিনিট ক্রসবার থেকে ঝুলেই কাটিয়ে দেয়। তাদের একটাই ধ্যান-জ্ঞান, গোল ঠেকানো। ফলে তারা গোল করার আর সময়ই পায় না।

বুলেটের গতিতে সাদা বলটা যখন জালে জড়িয়ে যায় তার যে উত্তেজনা সেটা ক্রমশ অবাস্তব, রহস্যময় হয়ে উঠছে। কেননা সেই অলৌকিক ঘটনা আজকাল প্রায় ঘটে না বললেই চলে। গোল, তা সে যত সাদামাটাই  হোক, তা ধারাভাষ্যকারদের মুখে সব সময়ই গো ও ও ও ও ও ও ও ও ও ও ল। একেবারে বুকের মধ্যিখান থেকে বেরিয়ে আসা আওয়াজ, যা প্রখ্যাত অপেরা গায়ক এনরিকো কারুসোর মতো কণ্ঠস্বরকেও চিরকালের মতো থামিয়ে দিতে পারত। এদিকে গোল হলে উত্তেজনায় দর্শকদের পাগলামির বাঁধ ভাঙে। স্টেডিয়ামগুলোও ভুলে যায় তাদের কংক্রিটের বাঁধন। তারাও যেন সব কিছু থেকে মুক্ত হয়ে মাটি ছেড়ে শূন্যে ওঠে, তারপর উড়তে থাকে।

More Articles