দর্শক তো তার মুণ্ডু চায়, যন্ত্রণার বিনিময়ে কী পায় রেফারি?

World Cup Football 2022: ফুটবলের ইতিহাসের চিরকালীন আবেগে সবাই রেফারিকে ঘৃণা করে, কেউ তার প্রশংসা তো করেই না, উলটে প্যাঁক মারে।

রেফারি

হিস্পানিতে সে ‘আরবিত্রো’। খেলায় সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। এমন এক ঘৃণ্য স্বৈরাচারী, কোনও বিরোধী শক্তিকে যে মাথা তুলতে দেয় না। কিংবা বলা যায় ফুটানিবাজ জল্লাদ, অপেরার মতো আড়ম্বরে নিজের কেরদানি দেখায়, নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ভোগ করে। তার ঠোঁটের ফাঁকে চেপে ধরা বাঁশি, সেই বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে সে গোল হওয়া বা গোল বাতিলের নিদান দেয়। হাতে লাল আর হলুদ কার্ড নিয়ে খেলোয়াড়দের উচ্ছন্নে যাওয়ার রং দেখায়, হলুদ কার্ড পাপীকে সবক শেখানোর জন্য, যাতে সে অনুতপ্ত হতে বাধ্য হয়। আর লাল কার্ড জোর করে নির্বাসিত করার জন্য। লাইন্সম্যানেরা তাকে সাহায্য করে, যদিও তাদের হাতে শাসনক্ষমতা থাকে না। তারা মাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে দু'ধার থেকে নজর রাখে। রেফারিই কেবল খেলার মাঠের মধ্যিখানে পা দিতে পারে। উল্লসিত দর্শকের গর্জনের মধ্যে রেফারিই প্রথম সাইড লাইন টপকে মাঠে ঢোকে। কিন্তু তার কাজটাই এমন যে মানুষের ঘৃণার পাত্র হওয়া ছাড়া গতি নেই। ফুটবলের ইতিহাসের চিরকালীন আবেগে সবাই রেফারিকে ঘৃণা করে, কেউ তার প্রশংসা তো করেই না, উলটে প্যাঁক মারে।

তার থেকে বেশি কিন্তু কেউ দৌড়য় না। খেলার মাঠে এই অবাঞ্ছিত লোকটির নিশ্বাসের আওয়াজ দু' দলের বাইশ জন খেলোয়াড়ের কানে বাজে। রেফারি গোটা ম্যাচ জুড়ে না থেমেই ক্রমাগত দৌড়ে যেতে বাধ্য হয়। ঘোড়ার মতো প্রবল বেগে দৌড়ে দৌড়ে সে নিজের পিঠের হাড় পর্যন্ত ভেঙে ফেলে। কিন্তু এই যন্ত্রণার বিনিময়ে সে কী পায়? দর্শক তার মুণ্ডু চায়। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রেফারি সাদা বলটাকে তাড়া করতে গিয়ে সাগর সমান ঘামে। কিন্তু বল তার কাছে কখনও আসে না। কেবলই সামনে পিছনে পিছলে পিছলে যায় বাইশজন খেলোয়াড়ের পায়ে পায়ে। সেও নিশ্চয় খেলতে ভালোবাসে, কিন্তু তাকে সেই সুযোগ কখনও দেওয়া হয় না। দৈবাৎ বল তার গায়ে লাগলে গোটা স্টেডিয়াম রেফারির বাপ-মা তুলে গাল দেয়। এত বিদ্রূপ-অপমান সয়েও, মাথায় ঢেলা এসে পড়লেও, সব রকম নরকযন্ত্রণা সহ্য করেও সে কিন্তু স্রেফ ওই পবিত্র সবুজ ঘাসের মাঝে দাঁড়ানোর আনন্দটুকু পেতে চায়, যেখানে বল ভাসে আবার কখনও পিছলে যায়।

এদিকে কখনও আবার, যদিও কালেভদ্রে, তার সিদ্ধান্ত কাকতালীয়ভাবে দর্শকের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে মিলে যায়, তখনও কিন্তু হেনস্থা কমে না। হেরোরা তাকেই তাদের হারের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে, আর জয়ী দল বুঝিয়ে ছাড়ে যে ওই লোকটা মাঠে থাকা সত্ত্বেও তারা কীভাবে জিতেছে! প্রতিটি ভুলের জন্য সেই সুনির্বাচিত বলির পাঁঠা। যাবতীয় দুর্ভাগ্যের কারণ। রেফারির যদি কোনও অস্তিত্ব না থাকত তাহলেও হয়তো ফুটবলের ভক্তরা তাকে গড়ে নিত। কেননা তাকে তারা যতটা ঘৃণা করে, তার উপস্থিতি তাদের কাছে ততটাই প্রয়োজনীয়।

প্রায় এক শতাব্দী ধরে রেফারির পোশাক শোকের রঙে তৈরি হয়। কার জন্য বলুন তো? তার নিজের জন্যই মনে হয়। ইদানিং অবিশ্যি সে নিজের মর্মপীড়া লুকোতে উজ্জ্বল রঙের পোশাক পরছে।

আরও পড়ুন- পেশাদার ফুটবলে খেলোয়াড় ‘দাস’, জেতা ছাড়া তার কাছে অন‍্য বিকল্প নেই

ম্যানেজার

আগেকার দিনে ফুটবলে ছিল প্রশিক্ষক, চলতি কথায় যাকে বলা হত কোচ। কোচকে কেউ বিশেষ পাত্তা দিত না। ফুটবল যখন থেকে আর প্রাণের আরামের খেলা রইল না, তখন পেশাদারি ফুটবলের প্রয়োজন হল খেলোয়াড়দের তাঁবে রাখতে পারে এমন সব কেষ্টবিষ্টুদের। এই সময় নিঃশব্দে মারা গেল ফুটবলের আদি যুগ থেকে দলের সঙ্গে থাকা কোচ। ঠিক সেই সময়েই জন্ম হল ম্যানেজারের। যার জীবনের ব্রত, খেলায় উদ্ভাবনী শক্তিকে গলা টিপে মারা, খেলোয়াড়ের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া এবং তাদের সর্বস্ব নিংড়ে নেওয়া। এই করতে গিয়ে খেলোয়াড়েরাও এখন বাধ্যতামূলক নিয়মের জালে জড়িয়ে পড়েছে।

কোচ বলত : "চলো হে, খেলা শুরু করা যাক।"

ম্যানেজার বলে : "চলো কাজে লেগে পড়ো।"

আজকাল তারা সংখ্যায় কথা বলে। বিংশ শতাব্দীর ফুটবলের ইতিহাস, যাকে ভয়ডরহীন খেলা থেকে ভীরুতার দিকে যাত্রা বলা চলে, সেই ফুটবল ২-৩-৫ থেকে ৫-৪-১ ছকের দিকে গেছে, মধ্যিখানে অবিশ্যি কিছুদিন করে ৪-৩-৩ এবং ৪-৪-২ চলেছে। এলেবেলে যত বোকার হদ্দরাও সামান্য সাহায্য পেলে এইসব গাণিতিক ভাষ্যের নিজের মতো অনুবাদ করে নিতে পারবে, কিন্তু বাকিটা অসম্ভব। ম্যানেজারের মাথার মধ্যে দিবারাত্রি গিজগিজ করে নানান দুর্বোধ্য গাণিতিক ফর্মুলা, যা অপাপবিদ্ধা কুমারী মাতা মেরির মতোই রহস্যময়। অন্যদিকে সেইসব ফর্মুলার প্রয়োগ একই ঈশ্বরে পিতা, পুত্র ও পবিত্র সত্তার সম্মিলনের খ্রিস্টীয় ধারণার মতোই পাঠোদ্ধারের অযোগ্য।

আদ্যিকালের ব্ল্যাকবোর্ড থেকে আজকালকার বৈদ্যুতিন পর্দা; ইদানিং বড় খেলাগুলো সবই কম্পিউটারে ছকা হয়, তারপর ভিডিও দেখিয়ে খেলা শেখানো হয়। এইসব রণকৌশল নামক খোয়াবের লেশমাত্র আপনি টেলিভিশনের পর্দায় খেলা দেখে টের পাবেন না। টেলিভিশন-ক্যামেরা দলের ম্যানেজারের দুই ভুরুর ভাঁজে ক্যামেরা ফোকাস করতে পছন্দ করে। আমরা তাকে আকাশে ঘুষি ছুঁড়তে দেখি কিংবা চিৎকার করে খেলোয়াড়দের নির্দেশ দিতে শুনি, যেসব নির্দেশে হয়তো খেলা পালটে যেতে পারত কিন্তু সে আওয়াজ জনতার তীব্র উল্লাসের মধ্যে খেলোয়াড়ের কানে গেলে তো!

বেসবলের অনুশীলনে যেমন ফিল্ডাররা খুব কাছ থেকে ব্যাটারকে বল ছুঁড়ে দেয় আর ব্যাটারও পালটা মারে ফিল্ডারের হাতে, তেমনই সাংবাদিকেরা খেলা শেষ হওয়ার পরে সাংবাদিক সম্মেলনে গিয়ে ম্যানেজারের দিকে প্রশ্ন ছোঁড়ে। যদিও সে কখনই জয়ের রহস্য উন্মোচন করে না, তবে হারের ব্যাখ্যা সাতকাহন করে বলে। বাজে দলের কাছে বিশ্রি হারের পর ম্যানেজার বলে, "ওদের পরিষ্কার নির্দেশ দেওয়া ছিল, কিন্তু ওরা কানেই তোলেনি।" সে যেকোনও সংশয় দূর করতে উত্তম পুরুষের আশ্রয় ছেড়ে প্রথম পুরুষে কথা বলে। কমবেশি একই ফাটা রেকর্ড বাজায়, "আজ খেলায় যে উলটো ফল হল, তাতে এতদিনের সাফল্য নষ্ট হয়ে যায় না। এই ম্যানেজার স্পষ্ট চিন্তার ফুটবল পছন্দ করে, আগেই বলা হয়েছিল তার জন্য অনেক আত্মত্যাগ প্রয়োজন। কঠোর অনুশীলনে আগেও সাফল্য এসেছে এবং ভবিষ্যতেও আসবে।"

চোখ ধাঁধানো দৃশ্যের নেপথ্যে এভাবেই নানা জিনিসকে মাড়িয়ে চলা হয়, কোনও কিছুই দীর্ঘস্থায়ী হয় না। ম্যানেজারও পণ্যায়িত সমাজের আর পাঁচটা জিনিসের মতো, যাকে ব্যবহারের পর ময়লার বালতিতে ছুঁড়ে ফেলা যায়। আজ দর্শকরা চিৎকার করে ‘জিও গুরু’ বলে, আবার সামনের রোববারই হয়তো বলবে তার ফাঁসি হওয়া উচিত।

ম্যানেজার মনে করে ফুটবল হল বিজ্ঞান, আর মাঠ তার ল্যাবরেটরি। কিন্তু আইনস্টাইনের প্রতিভা আর ফ্রয়েডের সূক্ষ্মতা দলের মালিক বা ভক্তদের কাছে যথেষ্ট নয়। মাতা মেরি যেভাবে চোদ্দো বছরের বারনাদেত সুব্যরুকে ছ'মাসে আঠারো বার দেখা দিয়েছিলেন, তারা তেমন নিষ্ঠা দেখতে চায়! আর চায় মহাত্মা গান্ধীর চরিত্রের নিহিত শক্তি দেখতে।

আরও পড়ুন- ফুটবলে নায়কের জেল্লা বেশিদিন থাকে না

রঙ্গমঞ্চ

এই নাটকের কুশীলবরা নিজেদের দু'পায়ে অভিনয় করে। আর সেই নাটকের হাজারো-লাখো দর্শক স্টেডিয়ামে কিংবা বাড়ির বৈঠকখানায় বসে রুদ্ধশ্বাসে খেলা দেখে। এই নাটকের রচয়িতা কে? ম্যানেজার? ধুর মশাই, নাটক নিজেই নিজের সৃষ্টিকর্তাকে নিয়ে মস্করা করে, খেলোয়াড়ের দক্ষতার ওপর নির্ভর করে স্বেচ্ছাধীনভাবে ঘটনা পরম্পরাকে এগিয়ে যেতে দেয়। ভাগ্যের হাতও আছে, ভাগ্য ঝোড়ো হাওয়ার মতো সব এলোমেলো করে দেয় নিজের খুশিতে। তাই খেলোয়াড় হোক বা দর্শক, খেলার ফল দু'পক্ষের কাছেই বিস্ময়কর। যদি না ঘুষ খেয়ে ম্যাচ ছেড়ে দেওয়া হয় বা ভাগ্যদেবীর অনিবার্য কোনও ছলনায় নাটক অন্যদিকে বয়ে যায়।

কত ছোট ছোট নাটক মিলিয়ে ফুটবলের এই মহান নাট্য অভিনীত হয়? সবুজ ঘাসের আয়তক্ষেত্রের মধ্যে কতগুলো রঙ্গমঞ্চ ধরতে পারে? সব খেলোয়াড় অবিশ্যি শুধু নিজের দু'পায়ে ভরসা রেখে অভিনয়ের তরী ভাসায় না। কোনও কোনও ওস্তাদ অভিনেতা আবার সহ খেলোয়াড়দের অশেষ যন্ত্রণার কারণ। মুখে দিব্যি সাধু-সন্তের মতো মুখোশ এঁটে রাখে, এমন ভাব করে যেন ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানে না। অথচ এই লোকটাই বিপক্ষের মুখে থুতু ছেটায়, খিস্তি করে, ধাক্কিয়ে ফেলে দেয়, চোখে ধুলো-বালি ছোড়ে, থুতনিতে নির্ভুল কনুই মারে, কখনও কনুই চালায় পাঁজরা লক্ষ্য করে, চুল কিংবা জার্সি ধরে টানে, খেলোয়াড় বল নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে পায়ের পাতা থেঁতলে দেয় কিংবা মাটিতে পড়ে গেলে হাত মাড়িয়ে দেয়! সবই চলে রেফারির চোখে ধুলো দিয়ে। বেচারা লাইন্সম্যান হয়তো আক্ষেপ করে সময় কত দ্রুত চলে যায় ভেবে!

রেফারিকে ভাঁওতা দিয়ে সুবিধা নেবার ব্যাপারে কেউ কেউ আবার খলিফা বিশেষ। দুখী আত্মার মুখোশ পরে বোকা সাজার অভিনয় করলে কী হবে, সেই খেলোয়াড়ই তারপর পেনাল্টি মারতে আসে, বা ফ্রি-কিক নেয় কিংবা রেফারির দেখিয়ে দেওয়া জায়গা থেকে অনেকটা সরে গিয়ে লম্বা থ্রো করে। আর যখন গোলের সামনে দেওয়াল গড়তে হয়, ওরা দিব্যি জায়গা ছেড়ে মাটি থেকে একটুও পা না তুলে সামনের দিকে হড়কে আসে। যতক্ষণ না উড়ন্ত জাদু-গালচে তাকে ফ্রি-কিক নিতে আসা খেলোয়াড়ের একেবারে মুখের সামনে এনে ফেলে।

আবার এমন খেলোয়াড়ও আছে যে সময় নষ্ট করায় বিশ্বসেরা। তার মুখে থাকে সদ্য ক্রুশবিদ্ধ শহিদের মুখোশ, কাল্পনিক যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠে মাটিতে গড়াগড়ি খায়, দু'হাতে হাঁটু অথবা মাথা ধরে বসে পড়ে, শেষমেশ ঘাসের উপর শুয়েই পড়ে। ঘড়ির কাঁটা নিজের তালে ঘুরে চলে। তখন শামুকের গতিতে পেটমোটা মালিশওলা তার বহু কেরামতি দেখানো হাত দু'খানি দোলাতে দোলাতে মাঠে ঢোকে। সামান্য এটুকু ছুটে এসেই অঙ্গসংবাহক দরদর করে ঘামে। তার সারা গায়ে পুলটিসের গন্ধ। কাঁধে জড়ানো একটা তোয়ালে, একহাতে জলের ফ্লাস্ক অন্য হাতে কিছু অব্যর্থ ওষুপত্তর। মনে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায়, বুঝি বছরও ঘুরে যায়, যতক্ষণ না রেফারি ঘাসের ওপর পড়ে থাকা শরীরটা মাঠের বাইরে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। এমন সময় হঠাৎই পড়ে থাকা খেলোয়াড়টি গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। ফের দৌড়তে শুরু করে। চোখের সামনে যিশুর পুনরুজ্জীবনের গল্প সত্যি হয়ে যায়।

More Articles