কখনও বেঁচে থাকার মরিয়া চেষ্টা, কখনও মৃত্যু, গোটা বছর সমুদ্রেই কাটল রোহিঙ্গাদের জীবন

Rohingya Refugee issue Bangladesh Myanmar : নেই আনন্দ উদযাপনের সুযোগ। ‘আনন্দ’ – এই শব্দটাই হারিয়ে গিয়েছে রোহিঙ্গাদের জীবন থেকে।

২০২২-এর ক্রিসমাস পেরিয়ে গেল। উত্তর ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের মানুষরাও উন্মাদনা শেষে নিজেদের গুছিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু লাডং গ্রামের ইন্দ্রপত্র বিচের কাছে এসে সেই ছন্দ ভাঙল। একটি নৌকা মাটি, বালি, ঘাসের ওপর এসে থেমেছে। আর সেখানে জবুথুবু হয়ে পড়ে আছেন অনেক মানুষ। মলিন মুখ, কেউ কেউ চোখ তুলে তাকাতে পারছেন না। অশক্ত শরীরে ইন্দোনেশিয়ার এই বিচে এসে মুখ থুবড়ে পড়েছেন তাঁরা, রোহিঙ্গা শরণার্থীরা।

চলতি বছরের শেষের দিকে এমন ছবিই দেখা গেল। গোটা বিশ্ব দেখল রোহিঙ্গাদের মরণপণ অবস্থা। এক দু’জন নন, ৫৮ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী এসে আশ্রয় নিয়েছেন ইন্দোনেশিয়ার ওই বিচে। সঙ্গী কেবল একটি অকেজো নৌকা। তবে চমকের এখানেই শেষ নেই। জানা গিয়েছে, দীর্ঘ এক মাস ধরে তাঁরা সমুদ্রে ছিলেন। চারিদিকে জল থইথই, কিন্তু সে জল খাওয়া যায় না। সঙ্গে থাকা খাবারও শেষ। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত শরীর; তার ওপর নৌকার ইঞ্জিনও খারাপ হয়ে যায়। কোনওরকমে ভাগ্যের ফেরে ভাসতে ভাসতে আচেহ প্রদেশের এই সমুদ্র সৈকতে চলে আসা।

ইন্দোনেশিয়ার পুলিস প্রশাসন জানিয়েছে, ওই রোহিঙ্গাদের তড়িঘড়ি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। গত ২৫ নভেম্বর তাঁরা বাংলাদেশ থেকে রওনা দিয়েছিলেন। তবে একটি নয়, গত দুই মাসে এরকম পাঁচটি নৌকা বোঝাই হয়ে রোহিঙ্গারা অন্যত্র চলে যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলির পাশাপাশি জাতিসংঘেরও আশঙ্কা, সবাই হয়তো বেঁচে নেই। ইতিমধ্যেই জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা UNHCR (ইউএনএইচসিআর) সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি পোস্ট করেছিল। সেখানেই বলা হয়েছে, এরকমই একটি নৌকায় প্রায় ১৮০ জন রোহিঙ্গা ছিলেন। খারাপ হয়ে যাওয়ায় নৌকাটি মাঝ সমুদ্রেই ভেঙে যায়। ফলে মারা যান ওই ১৮০ জন রোহিঙ্গা।

অবশ্য ঘটনা পরম্পরা আজকের নয়। শরণার্থী সমস্যা এই মুহূর্তে বিশ্বের অন্যতম চিন্তার বিষয়। বিশ্বের নানা জায়গায় যুদ্ধ, বিবাদ, হিংসার জেরে লাখ লাখ মানুষ নিজেদের ঘরবাড়ি হারাচ্ছে। ইউক্রেন, সিরিয়ার পাশাপাশি সেই মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছে মায়ানমার, বাংলাদেশ। ২০১৭ সালে মায়ানমারে সেনা অভ্যুত্থানের সময় শুরু হয় রোহিঙ্গা সমস্যা। প্রায় সাত লাখেরও বেশি মানুষ শরণার্থী হয়ে চলে যান বাংলাদেশে। মায়ানমারে শুরু হয় রোহিঙ্গা নিধন ও অত্যাচার।

বাংলাদেশে চলে এলেও মুসলিম সম্প্রদায়ের এই মানুষরা ছিলেন ব্রাত্য। শরণার্থী শিবিরের অবস্থা ভালো ছিল না একদমই। স্বাস্থ্যের পরিকাঠামো একেবারে বেহাল, শিক্ষার কোনও সুযোগ নেই। তাঁদের নাগরিকত্বও দেওয়া হয়নি। একপ্রকার বহিরাগত হয়েই শরণার্থী শিবিরগুলিতে পড়ে রয়েছেন রোহিঙ্গারা। শেষমেশ আর উপায় না দেখে নদীতে, সমুদ্রে নৌকা ভাসানোই একমাত্র উপায় হিসেবে দেখেন এই মানুষগুলো। উদ্দেশ্য, অন্যান্য মুসলিম প্রধান অঞ্চলে গিয়ে যদি খানিক সুযোগ সুবিধা মেলে। দিনের শেষে তাঁরাও তো মানুষ! মানবাধিকার প্রতিনিয়ত বিঘ্নিত হচ্ছে, অথচ সঠিক ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে না।

বিগত দু-তিন বছর ধরে নৌকা করে সমুদ্রে নেমে পড়ছেন রোহিঙ্গারা। সাগরের নোনা জলই তাঁদের ভবিতব্য – বিলক্ষণ বুঝে নিয়েছেন তাঁরা। কিন্তু UNHCR জানাচ্ছে, এই বছর যেন সেই সংখ্যা আরও বেড়ে গিয়েছে। জানুয়ারি থেকে নভেম্বর অবধি প্রায় ১৯২০ জন রোহিঙ্গা মায়ানমার এবং বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গিয়েছেন। প্রত্যেকের উপায় একটাই, সমুদ্র আর নৌকা। কেউ কোনওমতে শ্বাস টুকু নিয়ে কোথাও পা রাখতে পেরেছেন, কেউ সেই সুযোগটুকুও পাননি। অথচ গত বছর, ২০২১ সালেই এই সংখ্যাটা ছিল মাত্র ২৮৭। ২০২২-এ এক ধাক্কায় সেই সংখ্যাটা বেড়ে গিয়েছে পাঁচ গুণ!

২০২২ জুড়ে নানা ঘটনা পরম্পরার মুখোমুখি থেকেছে বিশ্ব। বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় গোটা পৃথিবীই মেতে উঠেছিল। উৎসবে, আনন্দে পেরিয়ে গেল একটা গোটা বছর। হাতে আর মাত্র কয়েকটা দিন। ক্রিসমাসের উদযাপন শেষ হয় চলছে বর্ষবরণের প্রস্তুতি। আতসবাজি প্রস্তুত, রঙিন জামাকাপড় পরে অনুষ্ঠান করার প্ল্যানও তৈরি। এসবের মাঝে গোটা বছর জুড়ে একদল মানুষ স্রেফ সমুদ্রে ভেসে কাটিয়ে দিল। পরিবার নেই, আত্মীয় নেই, নেই আনন্দ উদযাপনের সুযোগ। ‘আনন্দ’ – এই শব্দটাই বিগত কয়েক বছরে হারিয়ে গিয়েছে রোহিঙ্গাদের জীবন থেকে। পৃথিবী জুড়ে যারা বসবাস করছে, তাঁরাও তো মানুষ। রোহিঙ্গারাও মানুষ। অথচ খাবার, পানীয় জল ছাড়া তাঁরা ভেসে রইল সমুদ্রের বুকে। অনেকে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার মতো জায়গায় পৌঁছতে পেরেছেন। অনেকে আবার সেই সুযোগটুকুও পাননি। সমুদ্রেই সলিল সমাধি হয়েছে তাঁদের।

রাষ্ট্রপুঞ্জ থেকে বারবার ঘোষণা করা হচ্ছে, সমুদ্রে ভেসে থাকা রোহিঙ্গাদের যত দ্রুত সম্ভব উদ্ধার করতে হবে। UNHCR ঘোষণা করেছে, ১৯০ জন মানুষ এখনও সমুদ্রে ভেসে রয়েছেন। জীবন বাঁচানোর জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে রোহিঙ্গারা। যে করেই হোক, সমুদ্রে ভেসে অন্য জায়গায় যেতে হবে। আর সেই কাজ করতে গিয়েই বিপদে পড়ছেন তাঁরা। UNHCR-এর তরফ থেকে বলা হচ্ছে, শীঘ্রই কোনও একটা ব্যবস্থা করতে হবে। নয়তো কামিকাজি বিমান চালকদের মতো এই রোহিঙ্গারাও বেপরোয়া হয়ে ক্রমশ মৃত্যুর দিকে ঝাঁপ দেবেন।

এতদিন মালয়েশিয়ায় তাঁদের নৌকা ভিড়লেও, এখন ইন্দোনেশিয়াও অন্যতম গন্তব্য হয়েছে। নভেম্বরে ২১৯ জন রোহিঙ্গা ইন্দোনেশিয়ার আচেহ প্রদেশের সমুদ্র সৈকতে উপস্থিত হন। তারপর থেকে আরও বেশ কয়েকটি নৌকা উপস্থিত হয়েছে। আরও কত নৌকা মাঝ সমুদ্রে রয়ে গিয়েছে, জানে না কেউ। নৌকা ভেঙে সমুদ্রে পড়ে গিয়েছেন হয়তো অনেকে। উদ্ধার পাওয়ার আশা নেই, জানেন তাঁরা। স্রেফ মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গোনা। বছর পেরিয়ে মানব সভ্যতা এমনই কলঙ্কজনক কিছু দৃশ্যের সম্মুখীন হল। আমাদের প্রবল উদযাপনের মাঝে সমুদ্রে ভেসে রইল একদল মানুষ।

More Articles