অদম্য লড়াই মানে ইউক্রেন, রাশিয়ার প্রতিটি আঘাতে জন্ম নিচ্ছে ভালবাসার আখ্যান

চারিদিকে গোলাবর্ষণ চলছে অনবরত। আকাশে ক্ষণে ক্ষণে পাক খাচ্ছে রুশ সেনাবাহিনীর যুদ্ধবিমান। রাস্তার দখল নিয়েছে শত্রুপক্ষের ট্যাঙ্কার। ছোট্ট ইউক্রেন দেশটি ধারে ভারে কোনো দিক থেকেই রাশিয়াকে টক্কর দেবার মত নয়। কিন্তু দেশবাসীর উদ্যম, মনোবল দেখে তা বোঝার জো নেই। বরং কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করছেন দেশের ঊর্ধ্বতন নেতমন্ত্রী থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিক- সকলেই। এই দুঃসময়ে ইউক্রেনবাসীদের হৃদয়ের ভরপুর দেশপ্রেমের টুকরো টুকরো ছবিও প্রথম দিন থেকেই ছড়িয়ে পড়েছে সমাজমাধ্যমে। স্বতঃস্ফূর্ত  দেশপ্রেমের এই ছবিই বোধহয় রাষ্ট্রনেতা জেলেনস্কিকে সাহস যোগাচ্ছে নিরন্তন। সম্মুখসমরেই তাই বুঝে নিতে চাইছেন রুশ হানাদারদের। যুদ্ধের পঞ্চম দিনেও জেলেনস্কির গলায় ভয়ের লেশমাত্র নেই বরং দৃপ্ত কণ্ঠে জানিয়ে দিয়েছেন যে যুদ্ধক্ষেত্র ছাড়ার কোনো প্রশ্নই নেই। শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়াই করবেন দেশের জন্য।

এই মুহূর্তে দেশের ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সি পুরুষদের দেশ ছাড়তে মানা করেছেন ইউক্রেন সরকার। দেশের স্বার্থে সেনাবাহিনীতে স্বেচ্ছায় যোগদানের জন্য আহ্বান করেছেন  সরকার। রাষ্ট্রপতিকে সেনাবাহিনীর উর্দি পড়ে রাস্তায় নামতে দেখে ইউক্রেনবাসীরাও ঘরে বসে নেই কেউই। দেশকে রুশ বাহিনীর হামলা থেকে বাঁচাতে নিজেদের সাধ্যমতো মাঠে নেমে পড়েছেন সকলেই।  সমাজমাধ্যমে ইউক্রেনের এক ৮০ বছরের বৃদ্ধের ছবি ছড়িয়ে পড়েছে যা দেশপ্রেমের নজির হয়ে থাকবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে। একটি ছোট ব্যাগে দুটি জামা,একজোড়া অতিরিক্ত প্যান্ট, টুথব্রাশ ও কিছু স্যান্ডউইচ নিয়ে এসেছেন সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে। তার কথায় তিনি পরবর্তী প্রজন্মের কথা মাথায় রেখেই এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।

তরুণ এক ইউক্রেন সৈনিকের কথাও ভেসে এসেছে সমাজমাধ্যমে। তাঁর নাম ভিতালি স্কাকুন ভোলোদিমিরোভিচ। পদমর্যাদায় ইউক্রেনের নৌ সেনার ব্যাটালিয়ন ইঞ্জিনিয়ার। শরীরে মাইন বেঁধে নিজেকে উড়িয়ে দিয়ে আটকেছেন রুশ সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্কার। রাশিয়া অধিকৃত ক্রাইমিয়া থেকে ইউক্রেনের মূল ভূখণ্ডে প্রবেশের জন্য যে রাস্তা রয়েছে তা খেরসন প্রদেশ হয়ে যায়। রাস্তার উপর রয়েছে হেনিচেস্ক সেতু। রাশিয়ার ট্যাঙ্কারগুলি সেই পথ ধরেই এগোতে শুরু করেছিল ইউক্রেনের মূল ভূখণ্ডের দিকে। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ান ভিতালি স্কাকুন ভলোদিমিরোভিচ। সেতু লক্ষ্য করে রুশবাহিনীর ট্যাঙ্কের সারি এগিয়ে আসতে দেখেই গায়ে মাইন বেঁধে নিজেকেই উড়িয়ে দিলেন। মুহূর্তে ধসে পড়ে চার লেনের সেই সেতু। থমকে গেল রাশিয়ার ট্যাঙ্ক বাহিনী।  

সংবাদসংস্থা সূত্রে জানা গিয়েছে, সেতু ভেঙে পড়ায় রুশ ট্যাঙ্ক বাহিনীকে ঘুরপথে আরও অনেকটা বেশি সময় নিয়ে ঢুকতে হয়েছে ইউক্রেনের মূল ভূখণ্ডে। অতিরিক্ত এই সময়ের সুযোগে নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আরও খানিকটা মজবুত ও দুর্ভেদ্য করার জন্য  মূল্যবান সময় পেয়েছে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী। ভিতালির দুঃসাহসিক এই কাণ্ড এখন সকলের মুখে মুখে ঘুরছে। বীরের মর্যাদা দিয়ে তাঁকে সম্মান জানিয়েছেন ইউক্রেন সরকার।

দেশের দুর্দিনে ভালোবাসার মানুষকে সঙ্গী করে যুদ্ধে নেমেছেন ইউক্রেনের সদ্য বিবাহিত এক দম্পতি। রাশিয়রা আক্রমণের খবর কানে পৌঁছতেই চার্চে ছোটেন ইরয়ানা আরিয়েভা ও সাভিৎসলোভ ফুরসিন। বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এই তরুণ-তরুণী। কিন্তু আর পাঁচটা নবদম্পতির মতো সুখে সংসারের বদলে আরিয়েভা-ফুরসিন ঝাঁপিয়ে পড়েন দেশকে বাঁচাতে। বিয়ে সেরে উঠেই নবদম্পতি সারাদিন ধরে যুদ্ধের জন্য জোগাড় করেছেন রাইফেল। দুজনেই নাম লিখিয়েছেন টেরিটোরিয়াল ডিফেন্স বাহিনীতে। রাইফেল হাতে দু'জনের ছবি সমাজমাধ্যমে এই মুহূর্তে ভাইরাল। আরিয়েভা বলেছেন,” এই মুহূর্তে আমাদের একটাই লক্ষ্য দেশের জন্য যা কিছু করা সম্ভব সেটাই করা। এখনও অনেক কাজ বাকি”। হাসিমুখে নবম্পতির  প্রত্যাশা  যে একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।

দেশের সেনাবাহিনীতে যোগদান করেছেন প্রাক্তন মিস ইউক্রেন আনাস্তিয়া লেনাও। নিজের ইন্সটাগ্রাম হ্যান্ডেলে দেশের জন্য সকলের কাছে সাহায্যও প্রার্থনা করেছেন সুন্দরী।সমাজ মাধ্যমে আরও এক ভিডিও দেখে বিশ্ববাসীর মন কেঁদে উঠেছে। এ মুহূর্তে ভাইরাল সেই ভিডিওতে দেখা গেছে এক ব্যক্তি রুশ ট্যাঙ্কারের প্রবেশ রুখতে হাঁটু গেঁড়ে রাস্তায় বসে পড়েছেন ট্যাঙ্কের সামনে। ছোট এক ক্ষুদেও তেড়েফুঁড়ে এগিয়ে গিয়েছেন রুশবাহিনীর দিকে। ঘুসি দেখিয়ে রীতিমত হুঙ্কার ছাড়ছে সেই মেয়ে।

 অন্য একটি ভিডিয়োতে চোখে পড়েছে, দক্ষিণ ইউক্রেনের শান্ত শহর হেনিচেস্কের রাস্তায় টহলদারি রুশ সেনার কথা বলছেন ইউক্রেনের এক মহিলা। সেনার মুখোমুখি হয়ে জিজ্ঞাসা করছেন, ”তোমরা কারা? এখানে কী করছ?” দৃপ্ত স্বরে মহিলা বলছেন,” তোমরা দখলদার। তোমরা ফ্যাসিস্ট!” এরপর নিজের কোটের পকেট থেকে সূর্যমুখী ফুলের বীজ বার করে তা এগিয়ে দেন রুশবাহিনীর দিকে। তিনি বলেন, “এই বীজগুলি পকেটে রাখো। তোমরা যখন শেষ হয়ে যাবে সেদিন এই বীজগুলি থেকে নতুন গাছ বেরোবে”। উল্লেখ্য ইউক্রেনের জাতীয় ফুল সূর্যমুখী। মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল হয়েছে এই কথোপকথন। শরীর ঝাঁঝরা করে দেওয়া বুলেটের সামনে অস্ত্র একমুঠো সূর্যমুখীর বীজ।

এমন অদম্য সাহসের জেরেই বোধহয় অনেকখানি ব্যাকফুটে রুশবাহিনী। বিশেজ্ঞদের মতে এতটা প্রতিরোধ আশাই করেনি পুতিনের সেনাদল। ইউক্রেনবাসীরাও বদ্ধপরিকর দেশকে নতুন প্রজন্মের বাসযোগ্য ভূমি করে তুলতে।            

More Articles