রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে মুদ্রাস্ফীতি চরমে, রাশিয়া-প্রীতির পুরস্কার পাবে ভারত?

একবিংশ শতাব্দীতে রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে ঘটতে থাকা যুদ্ধ যে তৃতীয় বিশ্ব যুদ্ধের দামামা বাজিয়ে দিয়েছে তা এককথায় অনস্বীকার্য। করোনা বিধ্বস্ত বিশ্বে রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে সংঘর্ষ যে এক কথায় ভাবনাতীত তা স্বীকার করে নিয়েছে সকল বিশেষজ্ঞের দল। প্রায় এক মাস হতে চলল ইউক্রেনের বুকে রাশিয়ার বীভৎস আক্রমণ এবং সেই আক্রমণের ফলে বিপর্যস্ত সেখানকার মানুষ। শুধু তাই নয়, এই বিধ্বংসী হামলার ফলে প্রাণ গেছে রাশিয়া, ইউক্রেন এবং ইউক্রেনে থাকা একাধিক দেশের ছাত্রছাত্রী এবং অন্যান্য কাজে যুক্ত একাধিক মানুষের।

আর্থিক এবং খাদ্য সঙ্কটে থাকা মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে অন্যান্য সকল দেশ এবং রাষ্ট্রসংঘ। সকলে মিলে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনের সাথে। কিন্তু তাতে যে সেই সংকট পুরোপুরি ঘুচে গেছে তা বলা যায় না; সঙ্গে রাশিয়ার একের পর এক আক্রমণ তাদের অবস্থা আরো শোচনীয় করে তুলছে। বর্তমানে ইউক্রেন যুদ্ধবিধ্বস্ত অবস্থা থেকে অনেকটা ঘুরে দাঁড়ালেও পুরোপুরি এখনো সেরে উঠতে পারেনি। এক্ষেত্রে তাদের দেশের প্রেসিডেন্ট একাধিকবার ইওরোপীয় বিভিন্ন দেশ এবং ন্যাটো বাহিনীর সাহায্য চাইলেও তাদের কখনো পাশে পায়নি। এর বিরুদ্ধে তারা একাধিকবার অভিযোগ আনলেও তাতে কর্ণপাত করেনি বিশ্বের শক্তিশালী দেশ সমূহ। তবে সামরিকভাবে পাশে না থাকলেও আর্থিকভাবে এবং পরোক্ষভাবে তারা ইউক্রেনকে সঙ্গ দিয়েছে এবং রাশিয়ার বিরুদ্ধাচারণ করে এসেছে।

এ তো গেল ইউক্রেনের কথা। রাশিয়ার হাল যে খুব ভালো তা বলা যায়না। শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দিক থেকে রাশিয়াকে শেষ করে দেওয়া নয়, এছাড়াও রাশিয়াকে এক ঘরে করে দিয়েছে সব দেশ। যেমন খেলার দিক থেকে দেখতে গেলে ফিফা সমস্ত ফুটবল প্রতিযোগিতা থেকে রাশিয়ার জাতীয় দল এবং তাদের ক্লাবকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে ঠিক তেমনি ভাবে অন্যান্য বিভিন্ন মাধ্যম থেকে এমনকি সোশ্যাল মিডিয়া থেকেও বহু সংস্থা রাশিয়াকে নিষিদ্ধ করেছে। এক্ষেত্রে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন নিজের কড়া মনোভাব দেখিয়েছেন এবং এর বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলেছে। এক সাক্ষাৎকারে প্রতিপক্ষ দেশগুলিকে উল্লেখ করে তিনি প্রশ্ন করেন, তারা বিশ্বের অন্যান্য রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের সময় কেন চুপ ছিল এবং এছাড়া তিনি যে যুদ্ধবিধ্বস্ত পরিস্থিতির মধ্যে বড় হয়েছেন তা মনে করাতে ভোলেনি পুতিন। দমার পাত্র নয় তা তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন। ফলে একাধিক জায়গায় ব্যান হওয়া সত্ত্বেও তারা যুদ্ধ থামায়নি; অবশ্য সাময়িক যুদ্ধবিরতি ঘোষণা তারা করে তবে তা ছিল স্বভাবতই সাময়িক।

তবে আজকের বিষয় রাশিয়া এবং ইউক্রেনের মধ্যে যুদ্ধ নয় বরং তার থেকেও বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে যুদ্ধ পরবর্তী কালে রাশিয়া এবং ভারতের মধ্যে গড়ে ওঠা এক নতুন সম্পর্ক। রাশিয়া এবং ভারতের মধ্যে সম্পর্ক কোনোকালেই খারাপ ছিল তা বলা যায় না, তবে সম্প্রতি যখন বিশ্বের অন্যান্য দেশ গুলি রাশিয়ার বিরুদ্ধে গেছে এবং তাদের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে দিতে চলেছে তখন রাশিয়ার প্রতি ভারতের পরোক্ষ সমর্থন যে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সুনজরে রয়েছে তা বলা যায়। শুধু তাই নয় বর্তমানে রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক সংকট যে ভয়ঙ্কর দাঁড়িয়েছে তা বলা বাহুল্য। এর কারণ হিসেবে বলা যায় ইওরোপীয় দেশ গুলি তাদের আমদানি ও রপ্তানি বন্ধ করেছে রাশিয়ার সঙ্গে এবং এ ছাড়া বহু ব্যবসার পথও তারা ছিন্ন করেছে পুতিনের সঙ্গে। ফলে আর্থিক দিক থেকে বন্ধু হিসেবে তাদের পাশে ভারতকে যে পাবে সেই আশায় বুক বেঁধেছে প্রেসিডেন্ট পুতিন। রাশিয়াও যে তাদের বন্ধু ভারতকে ভুলে গেছে তা একদমই নয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেনে রাশিয়া ভারতীয় পড়ুয়া এবং সেখানকার মানুষদের শুধু যে কোন ক্ষতি করেনি তা নয় বরং সাহায্যের হাতও বাড়িয়ে দিয়েছে। সংবাদপত্রের খবর অনুযায়ী, ইউক্রেনের রাজধানী কিভ থেকে ভারতীয় পরিচয় দেওয়া ছাত্র-ছাত্রীরা নিরাপদে ফিরে এসেছে ভারতে যার থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় যে রাশিয়া কখনোই চায় না ভারত তাদের উপর চটে যাক এবং তারা সব সময় ভারতের কাছ থেকে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কই আশা করে। এছাড়াও দেখা যায় পাকিস্তানের নাগরিক পর্যন্ত ভারতীয় পতাকা হাতে নিয়ে সেই যুদ্ধবিধ্বস্ত ইউক্রেন থেকে পালাচ্ছে। 

তবে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক নিয়ে ভারত ও রাশিয়া দু'দেশই চুপ থাকলেও সূত্র মারফত জানা গিয়েছে রাশিয়া বর্তমানে অর্থনৈতিক সংকটে ভুগছে ফলে তারা ভারতের সঙ্গে অপরিশোধিত তেল এবং অন্যান্য মূল্যবান জিনিস আমদানি-রপ্তানি সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়। উল্লেখ্য যে যুদ্ধ পরবর্তী কালে বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের মুদ্রাস্ফীতি হওয়ায় অন্যান্য জিনিসের দাম হুহু করে বেড়ে চলেছে এবং এর ফলে বিশ্বের একাধিক দেশ আর্থিক সংকট এবং সামাজিক সংকটের সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে ভারত সরকার কোনভাবেই চায় না আমাদের জনগণের ওপর সেই সংকট দীর্ঘায়িত হোক। ফলে সূত্র মারফত জানা যাচ্ছে, ভারত সরকারও চায় কম দামে রাশিয়ার থেকে অপরিশোধিত তেল এবং অন্যান্য মূল্যবান জিনিস আমদানী করতে। বর্তমানে ভারত তাদের ৮০% জিনিস আমদানী করে অন্যান্য দেশ থেকে এবং সেই ৮০ শতাংশের মধ্যে মাত্র ২ থেকে ৩ শতাংশ আসে রাশিয়া থেকে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে রাশিয়া সস্তা দামে তেল ও অন্যান্য জিনিস ভারতকে বেচতে চায় এবং এই সম্পর্কে ভারতের এক সরকারি আধিকারিক জানিয়েছেন যে, বর্তমান অবস্থায় অন্যান্য দেশ রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করলেও তারা সস্তা দরে যদি রাশিয়ার কাছ থেকে জিনিসপত্র আমদানি করার সুযোগ পায় তবে তারা নিশ্চয়ই করবে তবে ইনসিওরেন্স সহ অন্যান্য জিনিসগুলি দেখে তবেই ভারত সরকার নিজেদের সিদ্ধান্ত ঠিক করবে বলে জানিয়েছেন তিনি।

এই ব্যবসা যদি ভবিষ্যতে দীর্ঘায়িত হয় তখন আশা করা যেতেই পারে বিশ্ববাজারে বাড়ন্ত পেট্রোল, ডিজেল, তেল এবং অন্যান্য মূল্যবান জিনিসের দামের প্রভাব আমাদের উপর খুব একটা পড়বে না এবং যেভাবে বিশ্ব একাধিক সংকটের সম্মুখীন হচ্ছে সেখান থেকে ভারতবাসী কিছুটা হলেও রেহাই পাবে। 

More Articles