সত্যজিতের চিত্রনাট্য সত্যিই কি চুরি করেছিলেন স্পিলবার্গ?

accusation of plagiarism: সাদা চামড়ার মানুষের যে দায় স্পিলবার্গের ছবির সর্বত্র, তাও ওলটপালট হয়ে যেত। অন্তত সম্ভাবনা একটা ছিল। আর তার নেপথ্যে ছিলেন সত্যজিৎ রায় স্বয়ং। কী সেই ইতিহাস?

১৯৮২ সাল। ক্যালিফোর্নিয়ার অরণ্যে নেমে আসে এক উড়ন্ত চাকী। পৃথিবীতে পা রাখে কয়েকটি ভিনগ্রহী। উদ্দেশ্য পৃথিবীর কয়েকটি গাছগাছালি সংগ্রহ। তাদেরই মধ্যে একজন শহুরে চাকচিক্য দেখে চলে গিয়েছিল একটু দূরে। এদিকে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছয় মার্কিন সরকার। তাড়া করে ভিনগ্রহীদের। ভয়ে চাকতিতে উঠে চম্পট দেয় তারা। কেবল রয়ে যায় সেই প্রাণীটি, যে বাঁধাধরা গতের বাইরে গিয়ে বিস্মিত হয়েছিল। তাড়া খেয়ে সে গিয়ে আশ্রয় নেয় পাশের সান ফার্নান্দো ভ্যালিতে। আর সেখানেই তার আলাপ হয় এক মার্কিন সাদা চামড়ার কিশোরের সঙ্গে। স্পিলবার্গের 'ইটি' সিনেমার গল্প শুরু হয় এই বিন্দুটিতে। যা বিশ্বসিনেমার জগতে এক মাইল ফলক হিসেবে চিহ্নিত হবে অচিরেই। কিন্তু কেমন হত, যদি পরিচালকের চামড়ার রঙ হত শ্যামল? মার্কিন মুলুকের চোখ ধাঁধানো জগতে না নেমে যদি ভিনগ্রহীরা নেমে আসত বাংলার মাটিতে? সিনেমার জগতে হলিউডের যে 'কাউবয়' দাদাগিরি, তা কিছুটা নড়বড়ে হয়ে যেত কি? সাদা চামড়ার মানুষের যে দায় স্পিলবার্গের ছবির সর্বত্র, তাও কি ওলটপালট হয়ে যেত না? অন্তত সম্ভাবনা একটা ছিল। আর তার নেপথ্যে ছিলেন সত্যজিৎ রায় স্বয়ং। কী সেই ইতিহাস?

তৃতীয় বিশ্বের এক প্রান্তিক এলাকা আমাদের বাংলা। অথচ গত শতাব্দীর পাঁচের দশকেই তার সঙ্গে পরিচিত হয়ে গিয়েছিল সারা বিশ্ব। সত্যজিৎ রায়ের 'পথের পাঁচালী' ট্রায়ো বাংলার গ্রাম থেকে শহর, কাশীর প্রবাসী বাঙালি জীবন—তুলে ধরেছিল প্রায় সবটাই। সত্যজিতের খ্যাতি তখন গগনচুম্বী। এমন একটা পর্যায়ে এসে ঠিক করলেন, কল্পবিজ্ঞানে হাত দেবেন। আর্থার ক্লার্ক সত্যজিতের অত্যন্ত কাছের বন্ধু। তাঁকে খুলে বললেন ব্যাপারটা। একটি বাচ্চা ছেলে, তার সঙ্গে এক ভিনগ্রহীর বন্ধুত্ব হচ্ছে। প্লট শুনে ক্লার্ক খুবই উৎসাহিত। কথা হল প্রযোজক মাইক উইলসনের সঙ্গে। মাইক উইলসন, ক্লার্ক—দুজনেই সত্যজিৎ-কে হলিউডে এসে কাজটা শুরু করার জন্য উৎসাহ দিলেন। এমনকি পিটার সেলার্সকে রাজিও করিয়ে ফেলেছিলেন সত্যজিৎ একটা গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য।

আরও পড়ুন: টাইটানিক থেকে অবতার, সত্যজিৎ লুকিয়ে ছিলেন সর্বত্র

কিন্তু বিপত্তির শুরু এর পর থেকেই। মাইক উইলসন চিত্রনাট্যে নাকি একটা ছোট্ট ডায়লগ অদলবদল করেছিলেন, আর মহাকাশযানের রঙটা সোনালি করতে বলেছিলেন। শুধু মাত্র এই দুটি কাজের জন্য সত্যজিৎ-এর উপর ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করে চলেন মাইক। তাঁর দাবি সহলেখক হিসেবে নাম রাখতে হবে তাঁরও। বাধ্য হন সত্যজিৎ। স্টিভি ম্যাককুইন, মার্লন ব্র্যান্ডোর মতো ব্যক্তিত্বকে বিভিন্ন চরিত্রের জন্য কাস্ট করা হয়। অথচ কোনও অজ্ঞাত কারণে ছবির কাজ বারবার পিছিয়ে যায়। বহুবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তির পরে পুরো প্রোজেক্টটাকেই রদ করে দেওয়া হয়। কোনও দিনও আর তৈরি হয়ে ওঠে না সিনেমাটি। পরে সত্যজিৎ জানতে পারেন, তাঁর লেখা চিত্রনাট্য নাকি বিলিয়ে দিয়েছিল কলম্বিয়া পিকচার্স। এমন নানা ঘটনায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে পরিচালক দেশে ফিরে আসেন। সিনেমা তৈরি হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই তখন আর নেই। পরে বহু সাক্ষাৎকারে এই নিয়ে খেদ প্রকাশ করেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, কলম্বিয়া বহুবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু কোনও বারই কাজ শুরু করা যায়নি।

এরপর কেটে গিয়েছে অনেকগুলো বছর। ১৯৮২-তে ক্যালিফোর্নিয়ায় নেমে এল স্পিলবার্গের ইটি। সে বছরই বন্ধু ক্লার্কের ফোন। উত্তেজিত গলায় ক্লার্ক জানালেন, স্পিলবার্গের ইটি তিনি দেখে এসেছেন। সত্যজিৎ-এর চিত্রনাট্যের সঙ্গে সে ছবির আশ্চর্য মিল। এখুনি স্বত্বাধিকারের দাবি করা উচিত সত্যজিৎ-এর। উচিত মামলা করা। কিন্তু সত্যজিৎ তখন 'ঘরে-বাইরে' নির্মাণের কাজে ব্যস্ত। ফলে কিছুই করে উঠতে পারলেন না তেমন। পরের বছর, ইন্ডিয়া টুডে ম্যাগাজিনকে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে সবটা তুলে ধরলেন পরিচালক। "আপনি জানেন, নিদেনপক্ষে স্পিলবার্গ-লুকাসের দুটো সিনেমা, 'ক্লোজ এনকাউন্টার উইথ দ্য থার্ড কাইন্ড' এবং 'ইটি', তৈরিই হত না, যদি না আমার লেখা চিত্রনাট্যের নকল যত্রতত্র বিলি করত কলম্বিয়া। দিনকতক আগে আমার বন্ধু আর্থার ক্লার্ক ফোন করেছিল। ওর ইচ্ছে আমি যেন চুপ করে বসে না থাকি, যেন উপযুক্ত ব্যবস্থা নিই। এইটুকুই আমার অভিযোগ। কল্পবিজ্ঞানের জঁর নিয়ে যাঁরা সিনেমা বানাচ্ছেন, এমনি তাঁদের সঙ্গে আমার কোনও বিরোধ নেই। এটা খুব সম্ভাবনাময় একটা জঁর। তবে আমার মনে হয়, স্পিলবার্গ বা লুকাস ব্যাপারটাকে অত্যন্ত জটিল করে ফেলছে। আরও সহজ-সরল হওয়া দরকার গল্পগুলো।"

আরও পড়ুন: ‘জীবনের নোংরা দিকটা আমার ছবিতে যথেষ্ট উঠে এসেছে’: সত্যজিৎ রায়

স্পিলবার্গ অবশ্য এই অভিযোগ স্বীকার করেননি। তাঁর বক্তব্য, রায়ের চিত্রনাট্য যখন সর্বত্র বিলি করছিল কলম্বিয়া, তখন স্পিলবার্গ স্কুলের ছাত্র। যদিও যুক্তি হিসেবে তা এতটাই নড়বড়ে যে সন্দেহ কাটেনি অস্কারবোর্ডের। ফলে সে বছর ইটি-র ভাগ্যে তেমন পুরস্কার জোটে না। বিচারকেরা উল্লেখ করেন, 'ইটি'-র মুক্তি 'ইউনিভার্সালে' হলেও কাজ শুরু করেছিল 'কলম্বিয়া'ই। তাতে সন্দেহ বাড়ে বই কমে না। এই বাদ-প্রতিবাদে অত্যন্ত বিরক্ত হন স্পিলবার্গ। এড়িয়ে যান এই প্রসঙ্গ। যদিও শোনা যায় পরে সত্যজিৎ এবং স্পিলবার্গের মধ্যে মিটমাট হয়ে গিয়েছিল। স্পিলবার্গ, মার্টিন সরসেসে, জেমস আইভরি এবং ইসমায়েল মার্চেন্টের যৌথ প্রচেষ্টায় অস্কার পেয়েছিলেন সত্যজিৎ। শারীরিক ভাবে অক্ষম হয়ে পড়েছেন তখন পরিচালক। এই যাবতীয় ঘটনাই ঘুরেফিরে আঙুল তোলে মার্কিন দাদাগিরির দিকে। কেন বারবার পিছিয়ে দেওয়া হল ছবিনির্মাণের কাজ? কেন সত্যজিৎ রায়ের মতো পরিচালককে সুযোগ দেওয়া হল না? কার অনুমতি নিয়ে বিলিয়ে দেওয়া হল চিত্রনাট্য? কেবল কৌশলগত ত্রুটি? নাকি জাতিগত ভয়? সাদা চামড়ার উদ্ধারকর্তারা সেদিন মানসিক টানাপোড়েনে ভুগছিলেন? প্রশ্ন থেকেই যায়।

More Articles