হাসিনার প্রশংসা মমতার মুখে, তিস্তা চুক্তির ভবিষ্যৎ কোন পথে?

Mamata-Hasina relation: হাসিনা-মমতা সম্পর্কের আবহে আলো দেখবে তিস্তা চুক্তি?

তিস্তা তুমি কার, হাসিনার না মমতার! ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এবং দুই দেশের মধ্যে তিস্তা জলবন্টন চুক্তির টানাপড়েনে পশ্চিমবঙ্গের ভূমিকা নিয়ে ঠাট্টা করেই একথা বলেন অনেকে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাহিদা পূরণে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তি যে বাধা সৃষ্টি করছে এমন দাবিও করেন কেউ কেউ। কিন্তু এই জল চর্চার আবহেই বিতর্ক উসকে দিয়েছে হাসিনার ভারত সফর। ৫ সেপ্টেম্বর থেকে চলা এই সফরের মূল কেন্দ্র এবার নয়া দিল্লি। কে সফরে উল্লেখযোগ্যভাবে নেই পশ্চিমবঙ্গের উপস্থিতি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত, বাণিজ্য থেকে শুরু করে সমস্ত ক্ষেত্রেই সর্বাধিক ভূমিকা পালন করে পশ্চিমবঙ্গ।

এখানেই শুরু হয়েছে বিতর্ক। সোমবার নয়া দিল্লিতে পা দিয়ে মমতা প্রসঙ্গে হাসিনা বলেন, ''মমতা আমার বোনের মতো, চাইলেই দেখা করতে পারি!'' আর এই মন্তব্যকে হাতিয়ার করে বিজেপি তথা কেন্দ্রকে ফের আক্রমণ শানিয়েছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। বৃহস্পতিবার নেতাজি ইন্ডোরে তৃণমূল কংগ্রেসের জেলার নেতাদের নিয়ে পঞ্চায়েত নির্বাচন সংক্রান্ত বৈঠকে মমতা বলেন, ‘'হাসিনাজি নয়া দিল্লিতে এসেছেন। আমার সঙ্গে ওঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক খুব ভাল। দুর্গাপুজোর সময়ে আমি ওঁকে চিঠি দিই। উনি আমাকে শাড়ি পাঠান। আম পাঠান, কখনও ইলিশ পাঠান। আমি শুনেছি, উনি এই সফরে আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু দিল্লি তা শোনেনি। এই প্রথম দেখলাম বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দিল্লিতে এসেছেন, অথচ বাংলাকে বাদ দেওয়া হল।'' মমতার এই মন্তব্যের পরেই হাসিনা সফরে বাংলাকে ইচ্ছাকৃত বাদ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে। যেখানে শিকাগো, রোম এমনকী, চিনে মমতাকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও কেন্দ্রের বাধায় সেই সফর করতে পারেননি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, এই অভিযোগও ওঠে। ফের হাসিনার সঙ্গে মমতার সাক্ষাৎ না হওয়া নিয়েও সেই বিতর্কই চরমে উঠেছে। যদিও দেশের বিদেশ মন্ত্রকের তরফে মমতার এই অভিযোগ নিয়ে এখনও পর্যন্ত কোনও প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি।

আরও পড়ুন: আলো দেখতে পারে তিস্তা চুক্তি? বাংলাদেশ যা চায়

মমতার এই সাক্ষাৎ আবহেই কড়া নাড়ছে অন্য ইঙ্গিতও। যেখানে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে দেখা গিয়েছে, সোমবার দিল্লিতে কূটনৈতিক পর্যায়ের এক সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। যেখানে অতিথিদের বসার এক একটি টেবিলের নাম বাংলাদেশের বিভিন্ন নদীর নামে দেওয়া হয়। পদ্মা, মেঘনা, তিস্তা... সেই অনুষ্ঠানেই ঘনিষ্ঠ বৃত্তে মজার ছলে হাসিনা বলেন, ''ভারত পর্যাপ্ত জল দিচ্ছে না তাই ইলিশও পাঠাতে পারছি না। যদিও পুজোয় ইলিশ পাঠাতে অসুবিধা নেই!'' কূটনৈতিক মহলের একাংশ বলছেন, এই মজার ছলেই হাসিনা ব্যক্ত করেছেন ভারত বাংলাদেশের জল বণ্টন চুক্তি আটকে থাকার আবহ। যেখানে তিস্তার জলের উপর কৃষিকাজ নির্ভরশীল, এমন বহু জায়গা বাংলাদেশে রয়েছে। তিস্তা তীরবর্তী ওই অঞ্চলে জলের অভাব মেটানো সম্ভব এই চুক্তির ফলে। তাতে বাংলাদেশের লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অন্যদিকে বাংলাদেশ তিস্তার জলের একটা বড় অংশ লাভ করলে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর অংশের জেলায় অসুবিধা হবে। অনেক ক্ষেত্রেই সেচ অথবা কৃষিকাজে জলের একটা অভাব পরিলক্ষিত হতে পারে, এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে তিস্তা নিতে আপত্তি ব্যক্ত করেছেন মমতা। যেখানে বারবার কেন্দ্রের তরফে সদিচ্ছা থাকলেও মমতার আপত্তিতে সেই চুক্তি সম্পন্ন হচ্ছে না, পরোক্ষে এইরকম একটা অবস্থা তৈরি করতে পেরেছে কেন্দ্র। যদিও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে উপেক্ষা করে তিস্তা নিয়ে এগোনো যে সম্ভব নয়, একথা বলেছিলেন প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ।

অনেকেই বলছেন, এই আবহেই প্রকাশ্যে বোনের মতো সম্পর্ক বললেও মমতা আর হাসিনার ব্যক্তিগত সম্পর্ক আগের মতো আর না থাকার সম্ভাবনা বেশি! দুই নেত্রীই নিজের ক্ষমতার বৃত্তের জনগণের স্বার্থে কাজ করলেও বাংলাদেশের না তিস্তার জল পাওয়ার জন্য মমতার দোষ, এই বিষয়টি খানিকটা প্রতিষ্ঠিত পেয়েছে। আর সেই আবহেই উপহার দেওয়া নেওয়া অথবা দুই নেত্রীর প্রকাশ্য সম্পর্কে কোনও বিভেদ না ঘটলেও কূটনীতিক দিক থেকে কি সন্তর্পণে মমতাকে এড়িয়ে গেলেন হাসিনা! এই প্রশ্নের আবহেই জোরালো ভূমিকা পালন করছে, হাসিনার ৪ দিনের ভারত সফরের গতিপ্রকৃতি। দিল্লিতে দাঁড়িয়ে হাসিনা রোহিঙ্গা-ইস্যুতে বড় দেশ ভারতের অনেককিছু করার ক্ষমতা আছে বলেছেন। দুই দেশের সীমান্তে বয়ে চলা নদীর প্রবাহমানতা নিয়েও দুই দেশের ভূমিকার কথা বলেছেন তিনি। পাশাপাশি নরেন্দ্র মোদি-শেখ হাসিনা দীর্ঘক্ষণ বৈঠক হয়েছে মঙ্গলবার। দুই দেশের মধ্যে ৭টি মউ স্বাক্ষর হয়েছে।

এদিকে ভারত সফরের প্রথম দিন সোমবার নয়া দিল্লির নিজামউদ্দিন দরগাহ ও মাজারে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন হাসিনা। তাঁর বাবা শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যার পরে দিল্লিতে নির্বাসনে থাকার সময় তিনি প্রথম এই দরগাহ পরিদর্শন করেন। বৃহস্পতিবার রাজস্থামের আজমের শরিফ পরিদর্শনে যান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু 'বোনের মতো মমতা, চাইলেই দেখা করতে পারি,' বললেও বিশেষ ইচ্ছার বশে দীর্ঘ সময়ের ভারত সফরে মমতার সঙ্গে সাক্ষাতের কথা জানাননি হাসিনা। অর্থাৎ প্রকাশ্যে দেখা করার ইচ্ছা ছিল, করতে পারিনি বা করব; এমন একটা ইন্ধন দিলেও আসলে মমতা এই সফরে গৌণ, এই বার্তাও দিয়েছেন হাসিনা। অর্থাৎ জল-বিবাদ যে ব্যক্তিগত সম্পর্কের এগিয়ে চলার পথে একটা ভূমিকা পালন করছে, তা-ও প্রকাশ পেয়েছে হাসিনার যাবতীয় কার্যকলাপে, এমনও মনে করছেন কেউ কেউ।

More Articles