আলো দেখতে পারে তিস্তা চুক্তি? বাংলাদেশ যা চায়

এরকম অবস্থায় শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফর শেষে বাংলাদেশ ও ভারত কি অবশেষে তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়ন করতে পারবে? না কি আরও একবার হতাশ হয়ে ফিরতে হবে হাসিনাকে?

২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাস। ভারতের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং রাষ্ট্রীয় সফরে ঢাকায় এলেন, আর বাংলাদেশে তখন ক্ষমতায় আওয়ামি লিগ নেত্রী শেখ হাসিনা। সেই সফরেই দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা ছিল ঐতিহাসিক তিস্তা চুক্তি, যার জন্য সব প্রস্তুতি সেরে ফেলেছিল ঢাকা ও নয়াদিল্লি।

কিন্তু চুক্তির বয়ান পর্যন্ত তৈরি হয়ে থাকার পরেও শেষ মুহূর্তে সেই উদ্যোগ থেকে দিল্লিকে পিছিয়ে আসতে হয়, কারণ চুক্তি নিয়ে বেঁকে বসেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

তার মাত্র কয়েক মাস আগেই তিনি ক্ষমতায় এসেছেন, এবং মমতা দিল্লিকে সটান জানিয়ে দিলেন তিস্তা যেহেতু পশ্চিমবঙ্গ হয়েই বাংলাদেশে ঢুকেছে, তাই এখানে রাজ্য সরকারের সম্মতি নিতেই হবে– যা আগে নেওয়া হয়নি এবং তিনি এভাবে তিস্তার জল ভাগাভাগিতে রাজি নন। ভারতের তখনকার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন মুখ্যমন্ত্রীকে রাজি করানোর অনেক চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু ভবি ভোলেনি।

আরও পড়ুন: পদ্মা সেতু আবেগে কাঁপছে বাংলাদেশ! কেন নাশকতার ভয় হাসিনার মনে?

ব্যাস, তিস্তা চুক্তির সম্পাদন সেই যে আটকে গেল– তারপর প্রায় এক যুগ অতিক্রান্ত হতে চললেও সেই জটিলতার আর নিষ্পত্তি হল না। মনমোহন সিং সরে গিয়ে এরপর নরেন্দ্র মোদি দিল্লির মসনদে এলেন, তারপরও আট বছরের বেশি কেটে গেল– কিন্তু তিস্তা রয়ে গেল যে তিমিরে, সেই তিমিরেই।

বাংলাদেশের অংশে তিস্তা যে রংপুর জেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে, সেখানে তিস্তাপারের কৃষকরাও ক্রমশ আশা হারিয়ে ফেলছেন যে, ভারত সত্যিই একদিন জলের ‘ন্যায্য হিসসা’ দেবে।

গত চৈত্র মাসের গনগনে রোদে শুকনো তিস্তার চরে দাঁড়িয়ে তরমুজ-চাষি আজমল শেখ বলছিলেন, ‘আমার বুঝে আসে না ক্যান আমাগো হকের পানি দিতি চায় না। পানি নাই বইলা আমগো ক্ষেত সব শুকায়ে গেসে গা!’

শুধু তিস্তার অববাহিকাই নয়, রাজধানী ঢাকাতেও কান পাতলেই শোনা যায় না-হওয়া তিস্তা চুক্তি নিয়ে দীর্ঘশ্বাস।

শেখ হাসিনার গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে একটানা শাসন আমলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক দারুণ উচ্চতায় পৌঁছলেও তিস্তা চুক্তি সই করতে না-পারাটাই যে একমাত্র বড় ব্যর্থতা– তা নিয়েও দেশের সাধারণ মানুষ বা রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা একমত।

কিন্তু কী আছে এই হতাশা আর ব্যর্থতার মূলে? কেন তিস্তার জল ভাগাভাগি নিয়ে দুই দেশ আজও একটা স্থায়ী ফরমুলায় একমত হতে পারল না? এই প্রতিবেদন খতিয়ে দেখেছে তিস্তার সেই ইতিহাস, ভূগোল আর রাজনীতির ইতিবৃত্ত।

তিস্তা নিয়ে সংঘাত
হিন্দু পুরাণে ভিন্ন ব্যাখ্যা থাকলেও অবস্থানগত দৃষ্টিকোণে ‘ত্রিস্রোতা, মানে তিন প্রবাহ থেকে আসা নদীটিরই বাংলা নাম তিস্তা।

ভারতের সিকিম হিমালয়ের ৭২০০ মিটার ওপরে সোলামো লেক (চিতামু হ্রদ) থেকে তিস্তা নদীর সৃষ্টি। এই নদীটি ভারতের সিকিম থেকে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের রংপুর হয়ে প্রবেশ করে ব্রহ্মপুত্র নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে।

ভারত থেকে বাংলাদেশে মোট ৫৪টি নদীর প্রবেশ, যার মধ্যে তিস্তা একটি। ১৯৪৭ সালে তিস্তার ক্যাচমেন্ট এলাকাগুলো ভারতকে বরাদ্দ দেওয়ার পর থেকে তিস্তা নিয়ে সংঘাত শুরু হয়।

নদীটির সর্বমোট দৈর্ঘ্য ৩১৫ কিলোমিটার, যার মধ্যে ১১৫ কিলোমিটার রয়েছে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে। তিস্তা নদীর উৎপত্তি ভারতে হলেও একটা বড় অংশ বাংলাদেশে প্রবেশ করাতে তিস্তায় প্রবাহিত জল বন্টন চুক্তি ভাঁটির দেশ বাংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

কিন্তু দুই দেশের মতবিরোধের কারণে গত এগারো বছরেও সম্ভব হয়ে উঠেনি। এদিকে তিস্তা চুক্তি নিয়ে ভারতের বারবার আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও এখনও পর্যন্ত চুক্তি স্বাক্ষর না হওয়াতে বাংলাদেশেও হতাশা ক্রমেই বাড়ছে।

প্রতিবেশী দেশ ভারত-বাংলাদেশের আন্তঃসীমান্ত নদী তিস্তার পানি ভাগাভাগি নিয়ে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের বাংলাদেশ সফর-সময়কালে বহু সমালোচিত তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার কথা থাকলেও সেসময় ভারতের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধিতায় তা আটকে যায়।

এরপর ২০১৪ সালে ভারতের নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় আসেন নরেন্দ্র মোদি। ২০১৫ সালের মার্চে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর প্রথম বৈদেশিক সফরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে দুই দিনের জন্য বাংলাদেশে আসেন এবং বৈঠকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী সেসময় আশ্বস্ত করেন তিস্তা নিয়ে দ্রুতই একটা সমঝোতা করা হবে।

কিন্তু পাঁচ বছরেও প্রথম মোদি সরকার থাকা অবস্থায় তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি। দ্বিতীয়বারের মতো নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর ২০১৯ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতের রাজধানী দিল্লি সফরকালে তিস্তা নদীর জল বন্টন নিয়ে মীমাংসা হওয়ার তুমুল সম্ভাবনা থাকলে সেবারও কোনও চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়নি।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কয়েক দফার দিল্লির বৈঠকেও কোনও সমাধান বের হয়ে আসেনি তখন।

তিস্তা নিয়ে প্রথম ‘চুক্তি’
অথচ চার দশক আগেই তিস্তা নিয়ে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে একটি অস্থায়ী যৌথ সমঝোতা হয়েছিল। ওটাকে পুরোপুরি চুক্তি বলতে অনেকের আপত্তি থাকলেও তখনকার অস্থায়ী চুক্তি-নির্ধারিত ফরমুলা-মোতাবেক দীর্ঘ সময় ধরে সেভাবেই তিস্তার জল সুন্দরভাবে ভাগাভাগি করে আসছিল দু'দেশ।

যৌথ নদী কমিশনের আর্কাইভ থেকে পাওয়া দলিলের তথ্যমতে দিনটি ছিল ১৯৮৩ সালের ২০ জুলাই। সেসময় দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আর ঢাকার শাসনক্ষমতায় সামরিক জেনারেল হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ।

ঢাকায় তখন ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন বর্ষীয়ান সাবেক কূটনীতিবিদ ইন্দর পাল খোসলা। সেদিন ঢাকায় ভারত-বাংলাদেশের যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক শেষে দু'দেশই তিস্তা নদী নিয়ে একটি অস্থায়ী ফরমুলার প্রস্তাবে রাজি হয়। ভারতের সাবেক জলসম্পদ-মন্ত্রী রাজস্থানের প্রবীণ কংগ্রেস রাজনীতিবিদ রামনিবাস মিরধা ও বাংলাদেশের সাবেক জলসম্পদ মন্ত্রী এ. জেড. এম. ওবায়দুল্লাহ খান বৈঠক শেষে তখন ‘অ্যাড-হক’ বা অস্থায়ী চুক্তিপত্রটিতে স্বাক্ষর করেছিলেন।

সেই চুক্তির ফরমুলা অনুযায়ী তিস্তার জলপ্রবাহের ১০০ ভাগের ৩৬ শতাংশ বাংলাদেশ ও ৩৯ শতাংশ ভারত পাবে এবং বাকি ২৫ শতাংশ স্বাভাবিক নিয়মে বয়ে যেতে দেওয়া হবে এমনটাই লেখা ছিল জল ভাগাভাগির সমঝোতাপত্রে।

এই অস্থায়ী চুক্তিপত্রটি টিকেছিল ১৯৮৩ সালের জুলাই থেকে ১৯৮৫ সালের শেষ পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রায় আড়াই বছর। তিস্তা নিয়ে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে ওটাই এখন পর্যন্ত প্রথম ও শেষ চুক্তি।

১৯৮৩ সালের চুক্তির সময় বলা হয়েছিল এখন অস্থায়ীভাবে চলুক তিস্তা চুক্তি পরে ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে স্থায়ী চুক্তি করা হবে। ২৬ বছর পর ২০১১-তে দ্বিতীয়বারের মতো তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষরের মৌখিক উদ্যোগ নিয়েও লিখিত বাস্তবায়নে দুই দেশের সরকারের মধ্যে অসংখ্যবার বৈঠক হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সমাধানের কোনও কিনারায় পৌঁছতে যেন একরকম নাজেহাল অবস্থা!

কী আছে এখনকার না-হওয়া চুক্তিতে
২০১১ সালের জানুয়ারিতে ঢাকায় দুই দেশের জলসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবদের মধ্যে একদিনের বৈঠকে প্রথমবার ১৫ বছর মেয়াদের অন্তর্বর্তীকালীন তিস্তা চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছিল।

তখনকার খসড়া তৈরিতে প্রাধান্য পায় যেসব দিকগুলো, তা হলো দু'দেশ কতটা পানি পেয়ে আসছিল, এবং নদীর জলপ্রবাহের মাত্রা কী রূপ ছিল।

খসড়া-অনুযায়ী ২০১১ সালে ভারত তিস্তার জলের ৩৭.৫ শতাংশ শেয়ার করতে সম্মত হয়েছিল এবং শুষ্ক (ডিসেম্বর থেকে মার্চ) মরশুমে ৪২.৫ শতাংশ জল ধরে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। বাকিটা বাংলাদেশের ভাগে এসেছিল এবং বাংলাদেশও তাতে একমত ছিল।

চুক্তির খসড়াটি অনুমোদন ও স্বাক্ষরের জন্য রাজনৈতিক ওপরমহলে পাঠানো হয়েছিল। ওই বছরেরই সেপ্টেম্বরে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরে এলে তিস্তা চুক্তি নিয়ে সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা ছিল এবং খসড়া চুক্তি স্বাক্ষর হলে জরিপ ও সমীক্ষা চালিয়ে চূড়ান্ত চুক্তির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছিল।

কিন্তু ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কঠোর বিরোধিতা করলে সেসময় তিস্তা চুক্তি আলোর মুখ দেখেনি এবং এখনও পর্যন্ত চুক্তিটি অস্বাক্ষরিত অবস্থায় রয়েছে ।

তিস্তা চুক্তিতে কার লাভ কতটুকু
তিস্তা নদীর ওপর ভারত অনেক আগেই বেশ কয়েকটি বাঁধ বানিয়েছে এবং পরে বাংলাদেশও তিস্তা ব্যারেজ নামে বাঁধ তৈরি করে। বাঁধগুলো দুই দেশের ভিন্ন ভিন্ন সীমান্ত অঞ্চলে নিজ নিজ অংশের স্বাভাবিক জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে বানানো হয়েছে এবং দুই দেশের তিস্তার ধারের মানুষের জীবনযাত্রার কথা ভেবে তৈরি করা হয়।

২০১৩ সাল পর্যন্ত ভারতের জলপাইগুড়ির গাজলডোবা বাঁধ দিয়ে উল্লেখযোগ্য হারে জলপ্রবাহ আসতে দেওয়া হলেও ২০১৪ সাল থেকে শুষ্ক মরশুমে বাঁধটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। তাছাড়া বছরের বাকি সময়ে বাঁধটি প্রচুর জল টেনে নেওয়ার কারণে সারা বছরই সেখানকার বাংলাদেশ-সীমান্তবর্তী মানুষগুলো চাষবাস ও জীবন যাপন ব্যাপকভাবে দুর্ভোগের স্বীকার ।

বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক নদী-গবেষক ও পরিবেশ-বিজ্ঞানীদের মতে ভারতীয় কেন্দ্রীয় সরকারের তিস্তা চুক্তি করতে সম্মতি থাকলেও প্রদেশিক সরকার তা চাইবে না, কারণ জল প্রত্যাহারে সরাসরি লাভবান হচ্ছে প্রাদেশিক সরকার। ফলে প্রাদেশিক সরকারকে যুক্ত করে চুক্তি করতে হবে।

আর তিস্তা চুক্তিতে জল বন্টন করতে গেলে মূল প্রবাহ শেয়ার করা প্রয়োজন এবং গাজলডোবা ও অন্যান্য বাঁধ হওয়ার আগের মূল প্রবাহ চুক্তিতে আনা প্রয়োজন- এটাও মনে করেন বাংলাদেশের নদী-গবেষকরা ।

তিস্তা নদীর জল বন্টন অত্যন্ত জটিল বলে ভারতের কূটনীতিবিদ ও জলসম্পদ-বিশেষজ্ঞরা মনে করেন । তাদের অনেকের ভাষ্য মতে, "দু'দেশ ভিন্ন ভিন্ন ভাবে নিজেদের মতো করে সমীক্ষা করেছে, কিন্তু মতের কোনও মিল তাদের কখনও হয়নি । এমনকী, বৈঠকগুলোতে সমীক্ষা বিষয়ে দু'দেশের বক্তব্যে বিরাট ফারাক রয়েছে।"

১২-১৩ বছরের তিস্তার জলপ্রবাহ সমীক্ষার গড় দু'দেশ মিলিয়ে দেখেছে এবং তাতে সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিসংখ্যানে দু'দেশ উপনীত হয়েছে । এই ফারাক দূর করতে পৃথক নয়, যৌথ জলপ্রবাহ সমীক্ষা করার প্রয়োজন রয়েছে, অভিমত তাদের।

দিল্লিতে মন্ত্রিভার বৈঠকে এই সমীক্ষা করার কথাও হয়েছিল এবং স্থির হয়েছিল তা করা হবে পশ্চিমবঙ্গের গাজলডোবায়। কিন্তু পরে আর তা হয়নি।

তিস্তা নিয়ে কূটনীতি
ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লিতে বসে বেশ আগের দেওয়া এক যৌথ বিবৃতির ২৭ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে “তিস্তা নদীর জলবন্টনের বিষয়ে আলাপ আলোচনা দ্রুত শেষ করতে হবে। এই মর্মে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে ২০১০-এর প্রথমার্ধে মন্ত্রী পর্যায়ে যৌথ নদী কমিশনের বৈঠক করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়।”

তিস্তা চুক্তি নিয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের ইতিবাচক সাড়া থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকারের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বরাবরই অসম্মতি জানিয়ে এসেছেন। ভারতের সংবিধান-অনুযায়ী তিস্তা চুক্তির বিষয়টি রাজ্য সরকারের জলবিভাগের অধীনে। সুতরাং তিস্তার ব্যাপারে সিদ্ধান্তটি অনেকটাই রাজ্য সরকারের মুখ্যমন্ত্রীর হাতেই।

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিস্তা চুক্তি না হওয়া নিয়ে কথা প্রসঙ্গে সবসময় তাঁর দেশের কৃষকদের স্বার্থ ও তিস্তার জল কমে যাওয়াকে কারণ হিসেবে দেখিয়েছেন।

২০১৭ সালে কলকাতার বেসরকারি চ্যানেল এবিপি আনন্দকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তিস্তা চুক্তি নিয়ে তাঁর আপত্তির মূল কারণটা জানিয়েছিলেন। "তিস্তা নিয়ে আমার রাজ্যের স্বার্থে যা করার আমি তাই করব”, বলেন তিনি। তিনি আরও বলেছিলেন- “বাংলাদেশকে আমি খুবই ভালবাসি, রাজ্যকে বাঁচিয়ে যতটা সম্ভব বাংলাদেশকে সাহায্য করব।”

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ. কে. আব্দুল মোমেন এবছরের ২৮ ও ২৯ মে গৌহাটিতে অনুষ্ঠিত নদী সম্মেলনে ভারতের গণমাধ্যম এনডিটিভি-র সঙ্গে কথা বলার সময় বলেন, “এটা দুর্ভাগ্যজনক যে আমরা ১১ বছর ধরেও তিস্তার জলবন্টন চুক্তি করতে পারিনি। এটা লজ্জারও। আমরা প্রস্তুত ছিলাম, ভারতও প্রস্তুত ছিল- তবুও চুক্তিটি হয়নি। ভবিষ্যতে জলের জন্য বড় হাহাকার তৈরি হবে এবং আমাদের এর জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।”

“আমরা খুব আশাবাদী যে, ভারত চুক্তিতে এগিয়ে আসতে রাজি হবে এমনকী, পশ্চিমবঙ্গও সম্মত হবে। দুই দেশের মধ্যে অভিন্ন ৫৪টি নদী রয়েছে। সুতরাং, এই অভিন্ন নদীসমূহের যৌথ ব্যবস্থাপনায় আমরা ভারতের সঙ্গে অংশীদার হতে এবং এক সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। অববাহিকা এলাকার মানুষের কল্যাণের জন্য দুই পক্ষের যৌথ ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন,” তিনি বলেন।

১৯ জুন রাজধানী দিল্লিতে অনুষ্ঠিত কোভিড-পরবর্তী প্রথম ফিজিক্যাল ও এ-পর্যন্ত সপ্তমবারের মতো আয়োজিত জয়েন্ট সেন্ট্রাল কমিটি (জেসিসি)-র মিটিংয়ে বাংলাদেশ থেকে আগত পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ. কে. আব্দুল মোমেন ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রহ্মণ‍্যম জয়শঙ্কর বৈঠকে বসেছিলেন। বিকেল ৫টা ৩০-এ অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, সীমান্ত, রোহিঙ্গা, পদ্মা সেতুর সঙ্গে অমীমাংসিত তিস্তা চুক্তির বিষয়টিও আলোচনায় উঠে এসেছে।

এ-বছরের (২০২২) জুলাই বা সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রস্তাবিত ভারত সফরের সম্ভাবনাকে ঘিরে তিস্তা চুক্তি নিয়ে আলোচনা আবারও সক্রিয় হয়ে উঠেছে এবং দু'দেশের মন্ত্রিসভার বৈঠকে ইতিমধ্যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং ইতিবাচক সাড়াও পাওয়া যাচ্ছে।

কিন্তু গত এগারো বছরে তিস্তা চুক্তি নিয়ে দুই দেশের মধ্যে বৈঠক হয়েছে বহুবার, কিন্তু চুক্তির সমীক্ষা নিয়ে মত ভিন্নতা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকার কারণে সমস্যার সমাধান হয়নি একবারও। ১৯ জুনের জেসিসি বৈঠকেও সেই একই হতাশার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে।

এরকম অবস্থায় শেখ হাসিনার আসন্ন ভারত সফর শেষে বাংলাদেশ ও ভারত কি অবশেষে তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়ন করতে পারবে? না কি আরও একবার হতাশ হয়ে ফিরতে হবে হাসিনাকে? এটাই এখন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে সব চেয়ে দামি প্রশ্ন!

More Articles