দ্বিতীয় দফার নোটবন্দি হয়ে গেছে চুপিসারেই! বিভীষিকার দিন ফিরবে আবারও?
Demonetisation: সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে যখন শলা-পরামর্শ নেওয়া হয়নি কারও, ছ’বছর পর তার ব্যর্থতা স্বীকারের দায়বদ্ধতাই বা থাকবে কেন!
স্বাধীনতাপ্রাপ্তি দেখাতে না পারলেও, ভারতবাসীকে সুদিন দেখানোর স্বপ্ন ফেরি করেছিলেন তিনি। কিন্তু কথায় এবং কাজে আকাশ-পাতাল তফাৎ থাকাই রাজনীতির দস্তুর। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও তার ব্যাতিক্রম নন। তাই ‘অমৃতকাল’ চলছে বলে ঘোষণা করলেও, স্বর্ণযুগে ভারতের পদার্পণের জন্য আরও ২৫ বছরের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছে তিনি। কারণ মসনদে আট বছর কাটিয়ে দিলেও, সুদিন ফেরানোর প্রতিশ্রুতি যে অধরাই থেকে গিয়েছে, তা বিলক্ষণ জানেন তিনি। তাই কথায় কথায় পূর্বসূরিদের ‘ভুলভ্রান্তি’-র ফিরিস্তি দিলেও, ছ’বছর পূর্তিতে নিজের নোটবন্দি ‘কীর্তি’ এড়িয়ে গিয়েছেন সযত্নে। কারণ তাতে স্বর্ণযুগের মায়াস্বপ্নের ভিত বড়ই নড়বড়ে ঠেকে। তাঁর অনন্যসাধারণ প্রতিভা ও ভাবমূর্তির অধিকারী ভাবমূর্তির সঙ্গেও ঠিক খাপ খায় না।
দেশের প্রশাসনিক প্রধান হলেই অর্থনীতি-বিশারদ হতে হবে, এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। তাই গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোয় অর্থনীতি থেকে পরিকাঠামো, সব বিভাগের জন্য উপযুক্ত পদাধিকারী থাকেন। কিন্তু ২০১৪ সাল থেকে ভারতীয় গণতন্ত্রে সরকারের এক এবং অদ্বিতীয় মুখ হয়েই থেকেছেন মোদি। তাই মেঘলা আকাশে র্যাডারের নজরদারি এড়ানো থেকে বায়ুযন্ত্রের ব্যবহারে জলের উৎপাদনের তত্ত্ব দিতে কখনওই কুণ্ঠা করেননি। তাই তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির পরিবর্তে, ২০১৬-র ৮ নভেম্বর নোটবন্দির ঘোষণাও করেন নিজেমুখেও। রাতারাতি পুরনো ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট বাতিলের সুফলও তুলে ধরেন নাগরিকদের সামনে। তবে রাজা হয়ে প্রজার সামনে জবাবদিহিতে বরাবরই অনীহা দেখা গিয়েছে। স্বভাবতই অতর্কিত ঘোষণা নিয়ে সাফাই দেওয়ার প্রয়োজনও বোধ করেননি। সমালোচনা, বিশ্লেষণে কর্ণপাত করতে দেখা যায়নি তাঁর সরকারকেও।
সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে যখন শলা-পরামর্শ নেওয়া হয়নি কারও, ছ’বছর পর তার ব্যর্থতা স্বীকারের দায়বদ্ধতাই বা থাকবে কেন! তাই আইটি সেলের সৈনিকগণ ছাড়া, সমালোচনা, কটাক্ষের ঝড় প্রতিহত করতে এগিয়ে আসেননি সরকারের ছোট-বড়-মাঝারি কোনও মন্ত্রীই। মিতভাষী পূর্বসূরিকে একসময় যে অস্ত্রে নিত্য ঘায়েল করেছেন, গুরুগম্ভীর প্রসঙ্গ উঠলে আজকাল সেই মৌনতা অবলম্বন করতে দেখা যায় মোদিকেও। নোটবন্দিও তার ব্যাতিক্রম নয়। কিন্তু চুপচাপ সমালোচনা, অপমান গিলে নেওয়ার বদনাম নেই তাঁর সরকারের। তাই ছ’বছর আগের নোটবন্দিতেই তারা আটকে গিয়েছে বলে ভাবলে ভুল হবে। শেষ মুহূর্তে হলেও, ছ’বছর আগে যাহবা সিদ্ধান্তের ঘোষণা হয়েছিল, আজকের দিনে চুপিসারেই আরও একদফা নোটবন্দি হয়ে গিয়েছে। প্রথম দিকে একটুআধটু খটকা ঠেকলেও, কানাঘুষো হয়েই থেকে গিয়েছে গোটা বিষয়টি। চোখের সামনেই, অত্যন্ত কৌশল ঘটিয়ে ফেলা হয়েছে দ্বিতীয় দফার নোটবন্দি।
আরও পড়ুন: ছ’বছরে সর্বত্র শুধুই ক্ষতি! নোটবন্দির কালো ছায়া আজও ঢেকে রেখেছে দেশকে
দ্বিতীয় নোটবন্দি কবে হলো, কেন ঘোষণা হলো না, প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। তবে উত্তর রয়েছে হাতের কাছেই। শেষবার কবে গোলাপি রংয়ের ২,০০০ টাকার নোট হাতে উঠেছে মনে করলেই, মিলবে উত্তর। নোটবন্দির পর কার্যত থালা-বাসন বাজিয়েই আনা হয়েছিল গোলাপি রংয়ের ২,০০০ টাকার নোট। কিন্তু বর্তমানে বাজার থেকে তা গায়েবই হয়ে গিয়েছে। এটিএম থেকে বেরোয় না একেবারেই। ব্যাঙ্কে গেলেও পাওয়া যায় না। বরং একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে, বড় অঙ্কের নোট জমিয়ে নির্ঘাত কালো টাকা মজুত করছে দুর্বৃত্তরা! কিন্তু আসল কথা হল, ২,০০০ টাকার নোট ছাপানোই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সেই সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়েছে সকলের অগোচরে, কাউকে কিছু না জানিয়ে। অর্থাৎ, মোদ্দাকথা হলো, জনগণের টাকায় বড় অঙ্কের নোট ছাপানোর কথা মনে হয়েছিল সরকারে। আবার পরে মনে হয়েছে সিদ্ধান্ত ঠিক নয়, তাই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ছাপানো। জনগণের ভোটে সরকার নির্বাচিত হলেও, জনগণের টাকায় দেশ চললেও, জনগণকে হিসেব বা জবাবদিহির কোনও দায় নেই সরকারের।
ভারতের ইতিহাসে ২,০০০ টাকার নোটই সর্বকালীন সবচেয়ে বড় অঙ্কের ছাপনো মুদ্রা। তাই বাজার থেকে ২,০০০ টাকার নোট উঠে যেতে দেখে কৌতূহলবশতই তথ্য জানার অধিকার আইনে সরকারের কাছে জবাব চেয়েছিলেন জনৈক নাগরিক। তাতেই ২,০০০ টাকার নোট ছাপানো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বলে জানা যায়। ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক নোট মুদ্রণের তরফে জানানো হয় যে, ২০১৯-’২০, ২০২০-’২১ এবং ২০২১-’২২ অর্থবর্ষে একটিও ২ হাজার টাকার নোট ছাপানো হয়নি। শুধু তাই নয়, বাজার থেকেও ২ হাজার টাকার নোট তুলে নেওয়া হচ্ছে বলেও ইঙ্গিত মেলে ওই জবাবেই। জানা যায়, ২০১৬-’১৭ অর্থবর্ষে ৩,৫৪২.৯৯১ মিলিয়ন ২ হাজার টাকার নোট ছাপানো হয়। ২০১৭-’১৮ সালে তা নামিয়ে আনা হয় ১১১.৫০৭ মিলিয়নে। ২০১৮-’১৯ সালে তা ৪৬.৬৯০ মিলিয়নে নামিয়ে আনা হয়।
এর আগে, ২০২১ সালে সংসদে সওয়াল-জবাব চলাকালীন প্রশ্নের মুখে পড়ে সরকার। সেই সময় সাংসদ অবিনাশ গণেশমূর্তি বাজারে ২,০০০ টাকার নোটের জোগান কমে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ব্যাঙ্ক এবং এটিএম থেকেও ২,০০০ টাকার নোট বেরোচ্ছে না বলে জানান তিনি। উত্তরে তৎকালীন অর্থ প্রতিমন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর জানান, বাজারের চাহিদা অনুযায়ী রিজার্ভ ব্যাঙ্ক এবং সরকার মিলে ঠিক করে কোন নোট, কত সংখ্যক ছাপা হবে। ২০১৯-’২০ এবং ২০২০-’২১ অর্থবর্ষে ২ হাজার টাকার নোট ছাপার কোনও নির্দেশ দেওয়া হয়নি। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার এবং রিজার্ভ ব্যাঙ্ক প্রদত্ত তথ্য মিলছে না বলে দাবি করেছেন সমাজকর্মী মনোরঞ্জন এস রায়। বাজার থেকে ২,০০০ টাকার নোট গায়েব হয়ে যাওয়ার কারণ অনুসন্ধানে সরাসরি মোদি, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর শক্তিকান্ত দাস, অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামণকে চিঠি লিন তিনি। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে দিয়ে গোটা বিষয়টি খতিয়ে দেখার আর্জি জানান।
মনোরঞ্জন জানিয়েছেন, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বার্ষিক রিপোর্ট বলছে, ২০১৭ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত বাজারে ১,২১৭.৩৩ কোটি ২,০০০ টাকার নোট ছাড়া হয়। ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক মুদ্রণ প্রাইভেট লিমিটেড বেঙ্গালুরু, নাসিক কারেন্সি নোট প্রেস এবং ব্যাঙ্ক নোট প্রেস দেবস— এই তিন টাঁকশালে ছাপা হয় সেগুলি। কিন্তু ওই তিনটি টাঁকশালে যত নোট ছাপা হয়, তার চেয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তরফে বাজারে ছাড়া নোটের পরিমাণ বহু গুণ বেশি। সরকারি হিসেবও অন্য কথা বলছে। কারণ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ প্রদত্ত হিসেব অনুযায়ী, ২০১৮ সালের ৩০ মার্চ পর্যন্ত বাজারে ২ হাজার টাকার নোটের সংখ্যা ছিল ৩,৩৬২ মিলিয়ন। ২০২১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি বাজারে ২ হাজার টাকার নোটের সংখ্যা ছিল ২,৪৯৯ মিলিয়ন। তাই মনোরঞ্জনের প্রশ্ন, বাকি নোট কোথায় গেল? নষ্ট হয়ে যাওয়ায় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যদিও বা কিছু নোট তুলে নিয়ে থাকে, তাতেও বাজারে ২ হাজার টাকার নোটে ঘাটতি পড়ার কথা নয় বলে দাবি তাঁর।
এর আগে, ২০১৯ সালে বম্বে হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেন মনোরঞ্জন। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকের অধীনস্থ সেন্ট্রাল ইকোনমিক ইনভেস্টিকেশন ব্যুরো আবেদনে সাড়া না দেওয়ায় আদালতে যান তিনি। জানান, নোটবন্দির সময় বাজারে জোগানের তুলনায় ঢের বেশি পুরনো ৫০০ এবং ১০০০ নোট সংগ্রহ করে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। ২০০০ সালের ১ এপ্রিল থেকে ২০১৮-র ৩১ মার্চ পর্যন্ত রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বার্ষিক রিপোর্টে পুরনো ৫০০ এবং ১ হাজারের নোট মিলিয়ে বাজারে ১৪.১১ লক্ষ কোটি টাকা ছিল বলে দেখান তিনি। কিন্তু নোটবন্দির পর যে হিসেব তুলে ধরে তারা, তাতে বাজার থেকে ১৫.২৮ লক্ষ কোটি টাকার পুরনো ৫০০ এবং ১ হাজার টাকার নোট উঠে এসেছে বলে দেখানো হয়। এই বাড়তি ১.১৬ লক্ষ কোটি নোট কোথা থেকে এল, প্রশ্ন তোলেন মনোরঞ্জন। বিষয়টির নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেন তিনি। তাতে রিজার্ভ ব্যাঙ্ককে মামলায় পক্ষ করার নির্দেশও দেয় আদালত।
নোটবন্দির সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সম্প্রতি মামলা দায়ের হয় সুপ্রিম কোর্টেও। তাতে হলফনামা জমা দিতে পারেনি কেন্দ্রীয় সরকার। আরও কিছুটা সময় চেয়ে আদালতে আবেদন জানান সরকারের আইনজীবী। তাতে পাঁচ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চের কাছে তিরস্কৃত হয় সরকার। প্রকারান্তরে আদালতকে অপমান করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন বিচারপতি বিভি নাগরত্ন। সাংবিধানিক বেঞ্চকে এ ভাবে শুনানি স্থগিত রাখতে আগে কখনও বাধ্য করার নজির নেই বলে মন্তব্য করেন আবেদনকারীর আইনজীবী শ্যাম ধীবন। কিন্তু ১৯২৪ সালের রিজার্ভ ব্যাঙ্ক আইনের আওতায় আদৌ নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকার নোট বাতিলের অধিকার সরকারের রয়েছে কি না, তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। গোটা বিষয়টি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছে আদালত। আদালতের সাফ বক্তব্য, ‘‘সরকার অবশ্যই বুদ্ধিমান। কিন্তু লক্ষ্ণরেখা জানা আছে তাদেরও। যে ভাবে নোটবন্দি করা হয়েছে, তা খতিয়ে দেখা যেতেই পারে।’’ যদিও শেষমেশ হলফনামা জমা দেওয়ার সময়সীমা বাড়ানোর সরকারি অনুরোধ মেনে নেয় আদালত।