হিন্দুও গায়, গায় মুসলিমও, ভোরের টহলগান ঘুচিয়েছে ধর্মের ভেদ

এই প্রভাতী সঙ্গীতে এক সময় ঘুম ভাঙত বাঙালির, এখন সে সব অতীত। রাঢ় বঙ্গের সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে এই প্রভাতী সঙ্গীত।

কার্তিক মাসের ভোরবেলা। বাতাসে হালকা শীতের আমেজ। লেপমুড়ি দেওয়ার সময় হয়নি তখনও, হালকা চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নিতেই হঠাৎ শুনতে পেলেন খঞ্জনীর মিষ্টি গুঞ্জরণ। ওই গুঞ্জরণ চলতে চলতেই কার যেন দরদি গলায় ঘুমভাঙানিয়া ভোরাই গান-

জাগো গো শ্যামের কমলিনী রাই।

পূবদিকে চেয়ে দেখ আর নিশি নাই।।

শ্যামের অঙ্গে অঙ্গ দিয়া,

কত সুখে রও ঘুমাইয়া।

 

এই প্রভাতী সঙ্গীতে এক সময় ঘুম ভাঙত বাঙালির, এখন সে সব অতীত। রাঢ় বঙ্গের সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িয়ে এই প্রভাতী সঙ্গীত। রাধাগোবিন্দের মন্দিরে গিয়ে এই গান গেয়ে দেবতার প্রভাতী নিদ্রাভঙ্গ করে নগর ভ্রমণে বেরিয়ে পড়তেন ভক্তরা। কৃষ্ণভক্ত বৈষ্ণবদের কাছে কার্তিক মাস গুরুত্বের বিচারে প্রথম সারিতে। সারা বছর না হলেও এই মাস জুড়ে চলত প্রভাতী এই ঈশ্বর কীর্তন। যুগ পরিবর্তন হলেও বঙ্গ সংস্কৃতির অঙ্গ থেকে এখনও উবে যায়নি এই সঙ্গীতের ধারা। কোথাও কোথাও স্থানীয় ভাষায় একে 'টহল' বলে।

খুব প্রাচীন রীতিনীতির এই সাধন সংগীত ‘টহল’! তাঁদের একটি নিজস্ব মাটির সংস্কৃতিও রয়েছে, সম্পূর্ণ লৌকিক ঘরানায় গাথা! অসম্ভব সুন্দর কথা, সাধনার কথা, দেহাতি মাটির ভিতর তাঁদের অনুভবি চলন! উপলব্ধি করা শক্ত! বৈষ্ণব সাধকরা করেন, নিজস্ব যাপনে। সে যুগের অবসান ঘটেছে অন্ধকারের ভেতরে, সামাজিক মনের দূরত্বের বন্দি রং করা ঘরে আটকে থেকে, এখন মায়াভরা মানুষের সময় হারানো খেলা। ছন্দ নেই, শাসন নেই, সাধনা নেই।

ভজগৌরাঙ্গ কহগৌরাঙ্গ, লহগৌরাঙ্গের নামরে/

যে জনা কৃষ্ণভজে সে হয় আমার প্রাণরে..

মূলত গৃহী বৈষ্ণব সাধক সমাজের পাশাপাশি, আখড়াধারী বৈষ্ণব বাবাজিরাও করতেন সে যুগে টহলের গান। আজ সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সেই রীতিনীতিরও বদল ঘটেছে। ভাব ও ভাবনার নির্জন জগৎকে ছুঁয়ে ফেলেছে সাধনার আধুনিক রসায়ন। শারীরবৃত্তের নানা রকম সংস্কৃতিতে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে টহলের আপন আধুনিক রসায়নের দেহবিদ্যার রহস্য। সম্যক পরিচয় না দিয়েই, সেই রহস্য রসায়নকে আত্মস্থ করার নেশায় ছুটছে সাধক কূল। কিনারায় দাঁড়িয়ে রয়েছে বৈষ্ণব বৈরাগী, টহল গানের চর্চা নিয়ে! তাঁর খোঁজেই হেঁটেছে বহু মানুষ, দীর্ঘ পথের পথিক হতে। সময়ের বসে নয়, এমন কথার বসে আটকে থাকা মানুষরাই সাধক। আর সেই মানুষের মনের আনন্দেই বৈষ্ণব জীবনের পরম্পরায় প্রবাহিত হচ্ছে ধীরে ধীরে টহলের সুপ্ততাপ। তাঁদের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে নানাবিধ পথ। কার্তিক মাসের সূচনা থেকে সংক্রান্তি পর্যন্ত চলে।

কাকভোরের আগে খঞ্জনির খঞ্জনের সঙ্গে সঙ্গে গ্রাম্য পথে সুরেলা কণ্ঠে গান গেয়ে বেড়ায় টহলদার। ভগবানের নামগান শুনে ঘুম ভাঙে গৃহস্থের। তার বিনিময়ে নবান্নের দিন গৃহস্থের বাড়িতে চাল ডাল সহযোগে সিধে মেলে টহলদারের।

বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে পূর্ব বর্ধমানের দেনুড় অঞ্চলের দেনুড়, পাতুন, দাউকাডাঙা, ভুরকুন্ডা গ্রামে এই রীতি চালু আছে বহুদিন। এই চার গ্রামে টহল দেন এখনও টহলদাররা। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই রীতি ভুলতে বসেছে মানুষ। বর্তমান প্রজন্ম এই স্বাদ নিতে ততটা আগ্রহী নয়। টাচস্ক্রিনে চোখ রাখতে রাখতে ঘুমিয়ে পড়া নাগরিকের কাছে টহল কতটা মনোগ্রাহী হতে পারে, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।

আরও পড়ুন-প্রবল ঝড়ে ডুবন্ত নৌকো রক্ষা পেল লোকনাথের অলৌকিক মহিমায়, আজও যে আখ্যান মুখে মুখে ফেরে

সাধারণত কার্তিক মাসের পয়লা থেকে শুরু করে সংক্রান্তি পর্যন্ত পূর্ব বর্দ্ধমান, বাঁকুড়া, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ জেলার বিভিন্ন গ্রামের বৈষ্ণব গায়কেরা ভোরবেলায় পল্লীর পথে পথে রাধাকৃষ্ণ ও গৌরসুন্দর বিষয়ক ছোট ছোট গানগুলি গেয়ে থাকেন। বৈষ্ণব মতের কৃষ্ণকীর্তন বা গৌরকীর্তনের একটি অংশ হিসেবে এই গান গাওয়া হয়। আবার অনেকের মতে পদাবলী কীর্তনের ‘কুঞ্জভঙ্গ’ এর প্রথম পর্বগুলি টহল গানে পরিবেশিত হয়।

এক একটা গ্রামে বিভিন্ন জাতির বাস। তাঁদের মধ্যে যাঁরা বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী বা চলতি কথায় বৈরাগী তাঁরাই সাধারণভাবে এই টহল গান গেয়ে থাকেন। তবে বৈরাগীর অভাবে বা ইচ্ছা থাকলে অন্য জাতির লোকও গান গাইতে পারেন। এতে কোনও সামাজিক বাধা নেই। গাইয়ে ধুতি পরে, নগ্ন পায়ে, মাথায় পাগড়ি পরে, কপাল থেকে নাক অবধি তিলক কেটে, ভালো করে চাদরখানা জড়িয়ে হাতে খঞ্জনী নিয়ে ভৈরব রাগে গাইতে থাকে:-

নিশি হলো ভোর ওরে মাখন চোর!

বলাই দাদা তোরে ডাকিছে।

ওরে নীলমণি, উঠে খাওসে ননী-

দিনমনির উদয় হতেছে।

লাইনের শেষাংশটা লম্বা করে টেনে গেয়ে যায়। এক আশ্চর্য মাদকতা থাকে। তবে শুধু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বা চৈতন্য মহাপ্রভুর ঘুম ভাঙানোর জন্যই গান রচনা করা হয়নি; শ্রীরাধিকার ঘুম ভাঙাতেও গান বাঁধা হয়েছে। কৃষ্ণপ্রাণা রাধিকা তাঁর কৃষ্ণের কোলে মহাসুখে নিদ্রারত। তাঁদের পোষ্য আদরের পাখীদ্বয় শুক-সারি রাধাকে ডেকে তুলছে সেটাই গান আকারে ব্যক্ত হচ্ছে। যেমন-

রাই জাগো রাই জাগো বলে

শুক-সারি ডাকে।

কত নিদ্রা যাও হে তুমি

কালো মানিকের কোলে।

-টহল গান মুসলিম সমাজেও দেখা যায়।

তবে তার স্থান কাল পাত্র আলাদা। টহুলে ফকির নামে একদল ফকির আছেন যাঁরা, বছরের বিশেষ সময়ে রাত্রি বেলায় বাড়ি বাড়ি গান গেয়ে ভিক্ষা করে বেড়ান। যেমন পূর্ব বর্দ্ধমান জেলার কেতুগ্রাম থানার অন্তর্গত রাইখ্যা ও বিরুরি গ্রামে এই টহুলে ফকিরের দল আছে। যেমন বিরুরির একজন ফকির ইদুল ফিতর ও বখরি ঈদের আগের দিন মুরগ্রামে এসে রাত এগারোটা থেকে ভোর পর্যন্ত গ্রামের রাস্তায় রাস্তায় আল্লা নবির কিস্যা গেয়ে বেড়ান। লোকবিশ্বাস এই গান যে যে বাড়িতে পৌঁছাবে সেই সেই বাড়ি সৌভাগ্যশালী হয়ে উঠবে। গান শেষে ভোরবেলায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে সিধে তোলেন।

এবার প্রশ্ন জাগতেই পারে যে এত মাস থাকতে কার্তিক মাসের ভোরগুলোতেই কেন টহল গান গাওয়া হয়? কিছু গবেষক মনে করেন, আগে বছরের শুরু হত অগ্রহায়ণ মাস দিয়ে। পরবর্তী কালে মুঘল সম্রাট আকবর খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে বৈশাখ মাস থেকে নতুন বছর শুরু করেছিলেন। কিন্তু তার আগে অগ্রহায়ণ মাসই বছরের প্রথম মাস ছিল। তাহলে কার্তিক মাস হচ্ছে বছরের শেষ মাস। নতুন বছর ধান কাটার মধ্য দিয়ে শুরু হবে। তাছাড়া কার্তিক ঠাকুর প্রজননের দেবতা। নতুন বছরকে আবাহনের জন্যই বোধহয় বছরের শেষ মাসের ভোরগুলোতে ভগবানের নাম স্মরণ করা শুরু হয়েছিল। যাতে গ্রামের সকল অশুভ শক্তি দূর হয়ে শুভ শক্তির প্রবেশ ঘটে। কার্তিক মাসের ভোরবেলা জুড়ে ভগবান কৃষ্ণের নাম গান করা হয় যাতে শ্রীহরি তাঁর নিজের নামগান শুনেই ঘুম থেকে উঠতে পারেন। এরপর নতুন দিনের সূর্যের আবাহন।

More Articles