শিশুদের কলিজা খেয়ে বাঁচতেন বাংলার বেগম! মুর্শিদাবাদে আজও রহস্যে মোড়া এই জ্যান্ত কবর

Azimunnisa Live Tomb: আজিমুন্নিসা বেগমের মসজিদটি প্রবল ভূমিকম্পে ধ্বংস হলেও এর কারুকার্য করা একটি দেওয়াল এখনও বর্তমান।

ঘটনাক্রম – ১

সময়টা অষ্টাদশ শতক। হঠাৎই নগর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল আতঙ্ক। নগরের কিছু শিশুকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কান্নায় শিশুদের মায়েদের বুক ভেঙে যাচ্ছে। বাবাদের চোখে ঘুম নেই। একের পর এক নিদ্রাহীন রাত কাটছে। অবশেষে পাওয়া গেল শিশুদের। নগর সংলগ্ন নবাবের মহলের কাছে। শিশুদের না বলে তাদের অর্ধভুক্ত মৃতদেহ বলাই ভালো। কোনও নির্মম মানুষ বা জানোয়ার সেই নিষ্পাপ শিশুদের কলিজা ছিঁড়ে খেয়েছে, তারপর তাদের কলিজাহীন মৃতদেহ ফেলে দিয়েছে সেই পরিত্যক্ত প্রান্তরে। কিন্তু কার কাজ হতে পারে এটা! মানুষ নাকি কোনও পশুর! নগর জুড়ে ছড়িয়ে পড়ল আতঙ্ক। সবার মনে একটাই আতঙ্ক এত নির্মম কাজ কার হতে পারে!

ঘটনাক্রম - ২

অত্যন্ত প্রভাবশালী এক নারী। তিনি হঠাৎই অত্যন্ত দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলেন। পরিবারের সবাই অনেক ডাক্তার, কবিরাজ, হাকিম ডেকে আনলেন তাঁকে সুস্থ করে তুলতে। তবে কোনও কিছুতেই তিনি সুস্থ হচ্ছিলেন না। অবশেষে এক হাকিম তাঁর এই দুরারোগ্য অসুখ সারাতে সমর্থ হন। ওষুধের পথ্য হিসেবে তিনি যা দিয়েছিলেন তা শুনলে সবারই গায়ে কাঁটা দেবে! এই নারীকে প্রতিদিন একটি করে শিশুর কলিজা খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। হাকিমের কথা অনুযায়ী, ওই নারী প্রতিদিনই একটি করে শিশুর কলিজা খেতে থাকেন। কিছুদিন পর তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যান। তবে শিশুদের কলিজা খাওয়া তাঁর নেশায় পরিণত হয়। তাঁর নাম আজিমুন্নিসা বেগম। প্রশ্ন হল, কে এই আজিমুন্নিসা বেগম? আর তাঁর সঙ্গে শিশুদের কলিজা খাওয়ার সম্পর্কই বা কী?

আজিমুন্নিসার পরিচয়

বাংলার ইতিহাসে ঐশ্বর্য আর বৈভবের পাশাপাশি রহস্যময়তার কমতি নেই। নবাব-বেগমদের জীবন যেমন রহস্যময় ছিল তেমনই বেশ কিছু নবাব এবং বেগম কুখ্যাত হয়েছিলেন তাঁদের নিষ্ঠুর স্বভাবের কারণে। তেমনই এক নিষ্ঠুর বেগম ছিলেন আজিমুন্নিসা। তাঁর অপর নাম জায়নাবউন্নিসা। সেই নারীর হৃদয় এতই কঠোর ছিল যে স্বয়ং তাঁর পিতা মুর্শিদকুলি খাঁ স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। বেগম আজিমুন্নিসা ছিলেন বাংলার প্রথম নবাব মুর্শিদকুলি খাঁর পালিত কন্যা। তাঁর বেগম নৌসেরী বানু ছিলেন সন্তানহীনা। তাঁদের কোনও পুত্র সন্তান ছিল না। একমাত্র কন্যা আজিমুন্নিসা। তিনি কন্যার বিয়ে দেন উড়িষ্যার নবাব সুজাউদ্দিনের সঙ্গে। বলা যায়, আজিমুন্নিসা ছিলেন সেই সময়ের সবচেয়ে প্রভাবশালী এবং ধনবান নারী। প্রচলিত আছে, তিনি ছিলেন একজন ধর্মপ্রাণ মহিলা।

কিন্তু কীভাবে একজন বেগম থেকে তিনি হয়ে উঠলেন ‘কলিজা বেগম’?

মুর্শিদকুলি খাঁর এই কন্যাকে নিয়ে প্রচলিত নানা কাহিনি আছে। তবে আসলে কোনটা সত্য তা বিচার করা যায় না। ইতিহাসের কথা অনুযায়ী, আজিমুন্নিসা সেই সময় অর্থাৎ অষ্টাদশ শতকের একজন ভয়াবহ নারী ছিলেন। একবার এক দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হন কিন্তু তাঁর কোনও চিকিৎসা পাওয়া যাচ্ছিল না। যখনই এই মারণব্যাধি তাঁকে গ্রাস করার পর্যায়ে সেই সময় এক হাকিম তাঁকে এক অদ্ভুত চিকিৎসার কথা বলেন। তাঁকে নাকি দীর্ঘ একমাস মানুষের বাচ্চা অর্থাৎ শিশুদের কলিজা খেতে হবে। তাতেই এই রোগ সেরে যাবে। তবে তিনি এও সাবধানবাণী দেন যে, এই কলিজা দীর্ঘ একমাস ধরে খেলে নেশার মতো হয়ে যাবে এবং তার পরিণতি খুব একটা ভালো হবে না।

যাই হোক, অদ্ভুত এই চিকিৎসার কথা শুনে বেগম একটু অবাক হন। কিন্তু তিনি তখন বেঁচে ওঠার মোহে আচ্ছন্ন। বাঁচার আকাঙ্খা নিয়ে তিনি এই অদ্ভুত চিকিৎসা পদ্ধতি মেনে নিয়েছিলেন। সেকালে তাঁর এতই ক্ষমতা ছিল যে কোনও কর্মচারীর পক্ষে তাঁকে অমান্য করা অসম্ভব ছিল না। তাঁর কর্মচারীরা তাঁকে তিন বছরের কম বাচ্চাদের কলিজা এনে দিতেন, আর তিনি তা পথ্য হিসেবে গ্রহণ করতেন। শোনা যায়, তাঁকে এই কলিজা লুকিয়ে এনে দেওয়া হত। তিনি প্রতিনিয়ত শিশুর কলিজা খেতে লাগলেন এবং খুব অদ্ভুতভাবেই তাঁর এই রোগটি সেরে যায়।

কিন্তু হাকিমের কথা অনুযায়ী, এই কাজটি একবার শুরু করলে নেশা লেগে যাওয়ার কথা। তাই বেগমেরও নেশা লেগে গিয়েছিল এবং তিনি সেই নেশা থেকে কিছুতেই বেরিয়ে আসতে পারছিলেন না। একবার সুস্থ হয়ে যাওয়ার পরেও তিনি প্রতিনিয়ত কলিজা খেতে থাকেন। ফলে গ্রামে বাচ্চা চুরির ঘটনাটা বেশ ভালোভাবে ছড়িয়ে পড়ে। কাজটি খুব গোপনে করা হলেও আজিমুন্নিসার এই নিষ্ঠুর কাজের ব্যাপারে এক সময় তাঁর পিতা নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ জেনে যান। তিনি তাঁর একমাত্র মেয়ের প্রতি এতটাই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন যে তাঁকে জীবন্ত কবর দেন।

আবার অন্য এক প্রচলিত কাহিনি অনুযায়ী, শিশুদের এই কলিজা খাওয়ার ব্যাপারটা তাঁর স্বামী নবাব সুজাউদ্দিন জেনে যান এবং তাঁকে শাস্তিস্বরূপ সিঁড়ির নিচে জীবন্ত কবর দেন।

আরও পড়ুন- শুধু মহিষাসুর নয়, নটরাজের পায়ে দলিত হয় এক বামন অসুর! কে এই মুয়ালাকা?

কিন্তু অনেকের মতেই এসব গুজব। তার কারণ, ইতিহাসের পাতায় এসবের কিছু উল্লেখ নেই। বেগম আজিমুন্নিসার ছেলে সরফরাজ খানের (নবাব পুত্র) জীবদ্দশায় তাঁর মায়ের মৃত্যু ঘটে। তাঁর সামনে তাঁর মাকে জীবিত কবর দেওয়া হবে আর তিনি সেটার প্রতিবাদ করবেন না, এরকমটা ঠিক মানা যায় না। আর তাছাড়া বেগম আজিমুন্নিসা খুব ধর্মপরায়ণ মহিলা ছিলেন। তিনি বেঁচে থাকতে অনেক ভালো কাজ করে গেছেন। একজন ধর্মপরায়ণ মানুষ এরকম ধিক্কারজনক কাজ করবেন, এটা বিশ্বাস করতেও মানুষের অসুবিধা হওয়ার কথা। তবে তিনি যেমনই ছিলেন না কেন, বাস্তবতা যেমনই হোক না কেন, লোক-বিশ্বাস অনুসারে তিনি পাপী ও কলঙ্কিনী।

আজিমুন্নিসার সমাধি নিয়ে বিতর্ক

আজিমুন্নিসাকে জীবন্ত কবর দেওয়া নিয়ে ইতিহাসে নানা রকম ঘটনার প্রচলন রয়েছে। জানা যায়, স্বামী থাকা সত্ত্বেও প্রতি রাতে কোনও না কোনও সুপুরুষের সঙ্গে দৈহিক মিলনে লিপ্ত হতেন তিনি। যাতে এই কথা কেউ জানতে না পারে সেইজন্য দৈহিক মিলনের পর খাবারে বিষ প্রয়োগ করে প্রতিটি পুরুষকেই হত্যা করতেন। নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ তাঁর মেয়ের এই হত্যালীলার কথা জানতে পারেন। পরে এই স্থানে মেয়েকে জীবন্ত সমাধিস্থ করেন।

আবার অন্য মতে, আজিমুন্নিসা অত্যন্ত স্বাধীনচেতা প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। তাঁর পিতার তৈরি কাটরা মসজিদের অনুকরণে তিনি একটি ছোট মসজিদ নির্মাণ করেন এবং সেই মসজিদের নিচেই নিজের সমাধি তৈরি করে রাখেন। পরবর্তীতে সেখানেই জীবন্ত সমাধি দেওয়া হয় তাঁকে। আজিমুন্নিসা মনে করতেন তাঁর সমাধির উপরে পুণ্যবান মানুষের পায়ের ছাপ পড়লে তাঁদের চরণস্পর্শে তাঁর সমস্ত পাপ মুছে যাবে এবং তিনি মুক্তি লাভ করবেন। মৃত্যুর পরে সেখানেই তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। পরবর্তীকালে প্রবল এক ভূমিকম্পে তা প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়।

আজিমুন্নিসা বেগমের সমাধির উপরে আরও একটি সমাধি দেখতে পাওয়া যায়। তবে এই সমাধিটি আসলে কার সেটি সঠিকভাবে জানা যায়নি। কেউ কেউ বলেন, সমাধিটি সেই হাকিমের আবার কেউ কেউ বলেন, সমাধিটি বেগমের বিশ্বস্ত এক অনুচরের। ২৮৫ বছর আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার অমীমাংসিত রহস্য আজও মুর্শিদাবাদের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ায়। আজিমুন্নিসা বেগমের মসজিদটি প্রবল ভূমিকম্পে ধ্বংস হলেও এর কারুকার্য করা একটি দেওয়াল এখনও বর্তমান।

মসজিদের বর্তমান অবস্থা

১৯৮৫ সালে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগ এই ভগ্নপ্রায় মসজিদটি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেয়। তারপরেই এটিকে সর্বসাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। ১৭৩৪ সালে নির্মিত এই মসজিদটিতে ঠিক কবে যে আজিমুন্নিসা বেগমকে জীবন্ত সমাধি দেওয়া হয়েছিল ইতিহাস তা মনে রাখার প্রয়োজন বোধ করেনি। তাই তাঁর মৃত্যুর সঠিক সময়টি আমাদের অজানাই থেকে গেছে।

আরও পড়ুন- মুসলিম কন্যাকে কুমারী রূপে পুজো করেছিলেন বিবেকানন্দ, কীভাবে বাংলায় শুরু হল কুমারী পুজো

মসজিদটি আজ পুরোই ধ্বংসস্তূপ। শুধু একটি দেওয়ালের অংশবিশেষ আজও দাঁড়িয়ে রয়েছে। মুঘল স্থাপত্যে গড়া প্রধান ফটক দিয়ে ভেতরে ঢুকলে সোজা একটি পথ উঠে গেছে উঁচু একটি মঞ্চের মতো ঢিবির উপর। এই ঢিবির উপর রয়েছে ফুলের বাগান। সিঁড়ি বেয়ে এই ঢিবি বা বাগানে উঠতে হয়। সিঁড়িতে উঠে বাঁদিকে সিঁড়ির নিচের দিকে এগোলেই দেখা যাবে একটি সমাধি। এটিই আজিমুন্নিসার সমাধি। অনেক ইতিহাসবিদের মতে, ১৭৩০ সালে আজিমুন্নিসার মৃত্যু হয়। আর ১৭৩৪ সালে এখানে এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। তাহলে কীভাবে সেখানে আজিমুন্নিসার কবর দেওয়া হয়? এই প্রশ্ন সবার মনেই! বাবার সমাধির মতো তিনিও প্রবেশ পথের সোপানের তলদেশে সমাহিত। ব্রিটিশ পূর্ববর্তী স্থাপত্যের মতো এখানেও রয়েছে মুঘল ছাপ।

এখনও মুর্শিদাবাদের লালবাগে আজিমুন্নিসা বেগমের জীবন্ত সমাধি দর্শন করতে বহু মানুষ আসেন। তাঁদের চরণস্পর্শে বেগমের মুক্তিলাভ ঘটেছে কিনা জানা নেই, কেনই বা ইতিহাস এক মহিলাকে কলিজাখেকো বলে দাগিয়ে দেয়, সেই কাহিনিও চিরকাল অজানাই থেকে যাবে।

More Articles