১২ কোটি টাকা হাতিয়ে চলন্ত প্লেন থেকে সম্পূর্ণ উধাও! আজও খোঁজ মেলেনি সেই মারাত্মক অপরাধীর
D.B Cooper Mystery: মার্কিন জনমানসে বেশ প্রভাব ফেলেছিল ডি. বি. কুপার অন্তর্ধান রহস্য। ঠিক কী ঘটেছিল?
তরুণী এয়ার হোস্টেস মেয়েটিকে কাছে ডেকে একটি চিরকুট দিলেন মধ্য-চল্লিশের ভদ্রলোক। ডাকসাইটে সুন্দরী এয়ার হোস্টেস ফ্লোরেন্স শ্যাফনার এরকম প্রস্তাব এর আগে বহুবারই পেয়েছিলেন। স্বভাবতই বিশেষ পাত্তা না দিয়ে কাগজটা নিজের ব্যাগে রেখে দিলেন শ্যাফনার। কিন্তু এ কী! লোকটা যে আবার কাছে ডাকছে। এবার খানিকটা মেজাজ নিয়েই লোকটার কাছে গেলেন শ্যাফনার। তিনি কিছু বলতে যাবেন, তার আগেই ওই ভদ্রলোক বলে উঠলেন, “মিস, আপনি কাগজটি একবার খুলে দেখলে ভালো হয়। আমার কাছে বোমা আছে। প্লেন হাইজ্যাক হয়ে গেছে।”
প্রতি বছর নভেম্বর মাসের চতুর্থ বৃহস্পতিবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পালিত হয় ‘থ্যাঙ্কসগিভিং ডে’। এই দিন সেই দেশের মানুষ নিজের আত্মীয়-পরিজন, বন্ধু-বান্ধবদের ধন্যবাদ জানান এবং উপহার দেন। ১৯৭১ সালের থ্যাঙ্কসগিভিং ডে ছিল ২৫ নভেম্বর। এর ঠিক আগের দিন, অর্থাৎ ২৪ নভেম্বর পোর্টল্যান্ড আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ঢোকে প্রায় ছ'-ফুট লম্বা এক মধ্য-চল্লিশের ভদ্রলোক। তার পরনে ছিল কালো রঙের স্যুট, সাদা শার্ট, কালো রঙের টাই, মুক্তোর টাইপিন এবং হাতে কালো সুটকেস। তবে সবচেয়ে অদ্ভুত যেটা নজর টানে, সেটা হলো কালো রেনকোট। বৃষ্টি না হলে সাধারণত কেউ রেনকোট পরেন না, কিন্তু এই ভদ্রলোক পরেছিলেন। লোকটি ঢুকেই সোজা হাঁটা লাগাল নর্থ ওয়েস্ট ওরিয়েন্ট এয়ারলাইন্সের কাউন্টারের দিকে। টিকিট কাটার সময় নিজের পরিচয় দিল ‘ড্যান কুপার’ নামে। সেখান থেকে সিয়াটেল যাওয়ার জন্য ২০ ডলার নগদ দিয়ে একটি টিকিট কাটলেন তিনি।
কুপারের প্লেনটি ছিল একটি বোয়িং ৭২৭-১০০ মডেলের প্লেন। প্যাসেঞ্জার কেবিনের পিছনের দিকে ১৮-সি নম্বর সিটে বসেছিলেন কুপার। দুপুর ২টো ৫০ মিনিট নাগাদ যাত্রী এবং কেবিন ক্রিউ-সহ মোট ৪২ জন নিয়ে সিয়াটেলের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় এরোপ্লেনটি। জানা যায়, প্লেনটির দুই-তৃতীয়াংশই খালি ছিল। এর কিছুক্ষণ পর কুপারের কাছাকাছি একটি জাম্প সিটে খানিকটা বিশ্রাম নিতে আসেন ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্ট ফ্লোরেন্স শ্যাফনার। এরপরই কুপার গিয়ে মহিলার হাতে একটি চিরকুট ধরিয়ে দিয়ে চলে আসেন। ফ্লোরেন্স তাতে বিশেষ আমল না দিয়ে সেই চিরকুটটি নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে দেন। এরপরেই ঘটল সেই ঘটনা।
সেই চিরকুট পড়ে যথেষ্ট ভয় পেয়ে যান ফ্লোরেন্স শ্যাফনার। ফ্লোরেন্স তার বন্ধু টিনা মাকলো-কেও চিঠিটি দেখালেন। তাঁদের ভয়ের মাত্রা আরও বৃদ্ধি পেল, তখন তাঁদের দু'জনকে ডেকে কুপার তার ব্রিফকেসে থাকা চারটি ডায়নামাইট স্টিকের দু'টি বান্ডিল দেখাল। দু'জন এয়ার হোস্টেস-ই ততক্ষণে বুঝতে পেরেছেন, প্লেন হাইজ্যাক হয়ে গেছে, কিন্তু এই কথা কিছুতেই যাত্রীদের কানে পৌঁছতে দেওয়া যাবে না। এর মধ্যেই হিমশীতল কণ্ঠে নিজের দাবিগুলি জানাতে শুরু করল ড্যান কুপার। তার দাবি ছিল, ২,০০,০০০ ডলার (বর্তমান হিসেবে যা প্রায় ১২ কোটি ভারতীয় টাকা) মুক্তিপণ, চারটি প্যারাশুট এবং সিয়াটেলে প্লেন নামার সময় সেটিকে রিফিল করার জন্য একটি ফুয়েল ট্যাঙ্ক। যথারীতি শ্যাফনার চলে গেলেন ককপিটে, সেখানে গিয়ে পাইলটদের সব জানালেন বিস্তারিত। টিনা মাকলো বসে রইলেন কুপারের পাশের সিটে।
কুপারের দাবি-দাওয়া শুনে তো মাথায় বাজ পড়ল প্লেনের পাইলট উইলিয়ামস স্কটের। সঙ্গে সঙ্গে তিনি যোগাযোগ করলেন সিয়াটেল-টাকোমা এয়ারপোর্ট এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের (ATC) সঙ্গে। তৎক্ষণাৎ ATC যোগাযোগ করে FBI-এর সঙ্গে এবং FBI তড়িঘড়ি ফেডারেল ব্যাঙ্ক থেকে ২ লক্ষ ডলারের ব্যবস্থা করে। এক্ষেত্রে আরেকটি জিনিস জানিয়ে দেওয়া ভাল, কুপার উইলিয়াম স্কটকে কড়া নির্দেশ দিয়েছিল, যতক্ষণ না টাকা, প্যারাশুট এবং অয়েল ট্যাঙ্ক এয়ারপোর্টে আসছে, ততক্ষণ প্লেন ল্যান্ড করানো যাবে না। পোর্টল্যান্ড থেকে প্লেনে করে সিয়াটেল যেতে লাগে আধঘণ্টা। কিন্তু সেদিন টানা দু'-ঘন্টা সিয়াটেলের আকাশে চক্কর কেটেছিল প্লেনটি। যাত্রীদের বলা হয়েছিল, সামান্য যান্ত্রিক গোলযোগের কারণে ল্যান্ড করানো যাচ্ছে না। অবশেষে সন্ধে ৫টা ৪৫ মিনিট নাগাদ সিয়াটেল এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করে নর্থ ওয়েস্ট ওরিয়েন্ট এয়ারলাইন্সের বোয়িং ৭২৭-১০০ প্লেনটি। একমাত্র বোয়িং প্লেনেই পিছন দিকে দরজা খোলা যায়। সেই দরজা দিয়েই তোলা হলো টাকার বস্তা, রিফিল করা শুরু হলো বোয়িং ৭২৭-১০০। অবশ্য টাকাগুলি বস্তায় ঢোকানোর আগে সেগুলির সিরিয়াল নম্বর নোট করে রাখা হয়েছিল ব্যাঙ্ক এবং এফবিআই-এর তরফে যাতে পরবর্তীকালে এই টাকা কেউ ব্যবহার করলে তাকে চিহ্নিত করা যায়।
পূর্ব প্রতিশ্রুতিমতো কুপার প্লেন থেকে সকল যাত্রী ও ফ্লোরেন্স শ্যাফনার-সহ দু'জন ফ্লাইট অ্যাটেন্ডেন্টকে নেমে যাওয়ার অনুমতি দেয়। সবাই নেমে যাওয়ার পর প্লেনে রইল খোদ ড্যান কুপার, পাইলট উইলিয়াম স্কট, এয়ারহোস্টেস টিনা মাকলো-সহ মোট ৬ জন। প্লেনটি রিফিল করার সময় নিজের পরবর্তী প্ল্যানের কথা ক্রিউ মেম্বারদের জানায় কুপার। নির্দেশ পরিষ্কার, গতিবেগ না কমিয়ে ২০০ মাইল প্রতি ঘণ্টা বেগে, ১০ হাজার ফিট উচ্চতা রেখে মেক্সিকোর দিকে উড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে প্লেনটিকে। কুপার নির্দেশ দিয়েছিল, প্লেনের ল্যান্ডিং গিয়ার খুলে রাখতে, উইং ফ্ল্যাপগুলি ১৫ ডিগ্রি কোণে নামিয়ে আনতে এবং প্লেনের পিছন দিকের দরজা খোলা রাখতে। এসব শুনে প্লেনের কো-পাইলট উইলিয়াম রাটাজ্যাক কুপারকে জানিয়ে দেন তিনি যেভাবে চালাতে বলছেন, ওই ভাবে চালালে সরাসরি মেক্সিকো যাওয়া যাবে না। মাঝখানে অ্যারিজোনা বা নেভাদায় নেমে রিফিল করাতে হবে। এছাড়াও প্লেন টেক-অফের সময় পিছন দিকের দরজা খোলা রাখা যাবে না, তবে হাওয়ায় ওড়া শুরু করলে ওই দরজা খুলে দেওয়া যেতে পারে। ঠিক হল নেভাদার রেনো শহরে প্লেনটি ল্যান্ড করবে, ফুয়েল রিফিল করবে এবং তারপর ফের মেক্সিকোর উদ্দেশ্যে রওনা দেবে। এরপর সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা নাগাদ নেভাদার উদ্দেশ্যে রওনা দেয় বোয়িং ৭২৭-১০০। বোয়িং বিমানের ওপর নজর রাখার জন্য নিকটবর্তী ম্যাকডর্ফ বিমানবন্দর থেকে রওনা দেয় দু'টি এফ-১০৬ ফাইটার জেট। একটি নিচে, আরেকটি উপরে নজর রাখতে থাকে বোয়িংয়ের ওপর।
বোয়িং ৭২৭-১০০ আকাশে ওড়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই কুপার টিনা মাকলো-কে নির্দেশ দেয়, তিনি যেন ককপিটের ভেতরে গিয়ে সেটি ভেতর থেকে আটকে দেন এবং কোনওভাবেই যেন প্যাসেঞ্জার কেবিনে না আসেন। যাবার আগে মাকলো দেখতে পান, কুপার তার কোমরে টাকার বস্তা বেঁধে নিচ্ছে। হঠাৎ রাত আটটা নাগাদ ককপিটে অ্যালার্ম বেজে উঠল। বোঝা গেল, বিমানের পিছন দিকের দরজা খুলে দিয়েছেন কুপার। হঠাৎ ৮টা ১৩ মিনিটে একটি ঝাঁকুনি খায় বিমানটি। কিন্তু তাও কেউ প্যাসেঞ্জার কেবিনে ঢোকার সাহস করে না যেহেতু কুপারের নিষেধ আছে। রাত দশটা নাগাদ নেভাদার রেনো শহরের বিমানবন্দরে পৌঁছয় প্লেনটি। ল্যান্ড করার সঙ্গে সঙ্গেই প্লেনটিকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে, এফবিআই, রেনো পুলিশ ডিপার্টমেন্ট এবং মার্কিন সেনাবাহিনী। অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনী বিমানের ভেতর ঢুকল। ঢুকে তারা যা দেখল, তা ছিল অনভিপ্রেত। কোথায় কুপার, কোথায় টাকা, কোথায় বোম! প্লেনের ভেতর ড্যান কুপারের রেশমাত্র নেই! শুধুমাত্র দেখা গেল যে, ড্যান কুপারের সিটে পরে রয়েছে দু'টি প্যারাশুট, আটটি সিগারেটের বাট এবং একটি কালো টাই।
FBI-এর প্রাথমিক অনুমান ছিল, পিছনের দরজা খুলে প্যারাশুট নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন কুপার। ম্যাপ দেখে বোঝা গেল, কুপার যদি ঝাঁপ দিয়ে থাকেন, তাহলে তিনি পড়বেন পোর্টল্যান্ড থেকে ৬৪ কিলোমিটার উত্তর দিকে অবস্থিত এরিয়াল ওয়াশিংটন এবং লুইস নদীর মধ্যবর্তী কোনও এলাকায়। পরদিন সকাল থেকে শুরু হল অপারেশন NORJAK। লক্ষ্য একটাই, কুপারকে যেন-তেন প্রকারেণ খুঁজে বার করা। আগামী পাঁচ মাস পুরো এলাকা চষে ফেলে এফবিআই এবং পুলিশ, কিন্তু কুপার বা সেই টাকার কোনও খোঁজ মেলে না। এমনকী, কুপারের দেহ-ও পাওয়া যায়নি। এমনিতে ওই এলাকাটি ছিল ঘন জঙ্গলে ভর্তি। এহেন অঞ্চলে একজন মানুষকে খোঁজা, খড়ের গাদায় সুচ খোঁজার মতো কঠিন। তবুও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার কোনও কসুর রাখেনি। জল-আকাশ-মাটি তিন জায়গাতেই খোঁজা হয়েছে ড্যান কুপার-কে, মেলেনি কিছুই। সেই সময় সংবাদপত্রের মাধ্যমে আমেরিকায় দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছিল ড্যান কুপার অন্তর্ধান রহস্য। একটা সময় বাধ্য হয়ে সরকার সেই নোটগুলির সিরিয়াল নম্বর জনসমক্ষে নিয়ে আসে এবং ঘোষণা করা হয়, কেউ যদি একটিও নোট খুঁজে বার করতে পারেন তাকে নগদ ৫ হাজার ডলার পুরস্কার দেওয়া হবে। তাতেও কোনও লাভ হয়নি। এর মধ্যেই এক সংবাদপত্রের ছাপার ভুলে ‘ড্যান কুপার’ হয়ে যান ‘ডি. বি. কুপার’। এই ভুল সংবাদটি সবদিকে ছড়িয়ে পড়ায় লোকে তাকে ডি. বি. কুপার নামেই চিনতে শুরু করে। এরপর সুদীর্ঘ ৪৫ বছর তদন্ত চালায় বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা। কিন্তু কিছুতেই কোনও সমাধান মেলেনি এই কেসের।
তবে তদন্তে গতি এসেছিল একবার। ১৯৮০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পরিবারের সঙ্গে পিকনিক করতে গিয়ে কলম্বিয়া নদীর তীরে এক বালক ৫৮০০ ডলার ভর্তি একটি প্যাকেট পায়। এই ডলারগুলির সিরিয়াল নম্বরের সঙ্গে মুক্তিপণের ডলারের সিরিয়াল নম্বরগুলি সম্পূর্ণ মিলে গিয়েছিল। জানা যায়, ডলারের এই প্যাকেটটিকে এরিয়ালের থেকে ২০ মাইল দূরে নর্থ পোর্টল্যান্ডের কলম্বিয়া নদীর তীরেই পুঁতে রাখা হয়েছিল। ব্যাস এতটুকুই, এই তথ্য ছাড়া ডি. বি. কুপার বা ড্যান কুপার সম্পর্কিত কোনও তথ্য এফবিআই উদ্ধার করতে পারেনি বা পারলেও তা জনসমক্ষে আনেনি। অবশেষে ২০১৬ সালের ৮ জুলাই হাল ছেড়ে দেয় এফবিআই। তারা জানিয়ে দেয়, অনেক হয়েছে, আর সময় নষ্ট করা যাবে না এই কেসে। কুপারের অন্তর্ধান রহস্যর চেয়েও আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অর্থ ও শ্রম বিনিয়োগ করতে হবে তাদের। সেদিনই আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্তি ঘটে যায় অসমাপ্ত এক রহস্যের।
অসমাপ্ত রহস্যের সমাপ্তি হলেও মার্কিন জনমানসে বেশ প্রভাব ফেলেছিল ডি. বি. কুপার অন্তর্ধান রহস্য। ডি. বি. কুপার-কে নিয়ে অনেক সিনেমা-সিরিজ তৈরি হয়েছে ইতিমধ্যেই, গানও লেখা হয়েছে বিস্তর। তবে অনেক প্রশ্ন থেকেই যায়, ভদ্রলোকের নাম আসলেই কি ড্যান কুপার ছিল? টাকাগুলি কোথায় লুকিয়েছিলেন তিনি? না কি সত্যি ঝাঁপ দিতে গিয়ে মারা যান তিনি! এইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন একজনই, ‘The Man, The Myth, The Mystery- D. B. Cooper’।