যুদ্ধ থামেনি! শীতে মরছে ভুখা মানুষ! মৃত ৪৫,৫৪১! বর্ষশেষে যেখানে দাঁড়িয়ে গাজা
Israel Gaza War: এই যুদ্ধের মধ্যে গাজার মানুষের কাছে আরেক বিপদ হয়েছে চরম শৈত্য! গাজায় প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৭। যার ৬জনই শিশু!
গাজার যুদ্ধ ১৫ মাস পেরিয়ে যাচ্ছে। ইজরায়েল এবং হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতির জন্য আন্তর্জাতিক আহ্বান জনানো হয়েছে ঠিকই কিন্তু অবরুদ্ধ ভূখণ্ডে আটকে পড়া সাধারণ ফিলিস্তিনিরা সেই আশাটুকুও আর রাখেন না। গত ১১ ডিসেম্বর, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ গাজায় অবিলম্বে, নিঃশর্ত এবং স্থায়ী যুদ্ধবিরতির পাশাপাশি সমস্ত বন্দিদের অবিলম্বে এবং নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে দু’টি মূল প্রস্তাব গৃহীত হয়। এর আগেও যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব এসেছিল। গাজা দু’টি শীত পার করতে চলল, যুদ্ধ তবু থামল না। যুদ্ধ, খাবার নেই, জল নেই, আশ্রয় নেই, শিশুরা মরছে- এই ভূখণ্ডেই ১৫ মাস ধরে জীবন এমনই!
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনি জঙ্গি গোষ্ঠী হামাস দক্ষিণ ইজরায়েলে মিসাইল হামলা চালায় যাতে ১,২০০ জন নিহত হন এবং ২৪০ জনকে বন্দি করে রাখা হয়। এই হামলার বদলা নিতে গিয়ে ইজরায়েল গাজাকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকেই প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার মুখে! ইজরায়েলি সামরিক বাহিনী গাজায় বোমাবর্ষণ করে এবং সেখানে প্রাণের মৌলিক চাহিদাগুলির সরবরাহ সীমিত করে দেয়। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রকের মতে, এই টানা এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা হামলায় কমপক্ষে ৪৫,৫৪১ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। বাড়িঘর ভেঙে গুঁড়িয়ে গিয়েছে, স্বাস্থ্য, শিক্ষা এবং নিকাশী পরিষেবা ধ্বংস হয়ে গেছে এবং জনসংখ্যার প্রায় ৯০ শতাংশই বাস্তুচ্যুত।
গাজায় মানবাধিকার সংস্থা বা অন্যান্য দেশ যে যে ত্রাণ পাঠিয়েছে ইজরায়েল তার অন্তত ৮৩ শতাংশ আটকে দিয়েছে। সেই সাহায্যকারী কনভয়গুলিতে লুটপাট চালিয়েছে ইজরায়েল যার ফলে মারাত্মক খাদ্য সঙ্কট এবং অনাহারের সমস্যা দেখা দিয়েছে। প্রায় ২০ লক্ষ মানুষ ভুগছেন খাবারের অভাবে। প্রাণে মারার পাশাপাশি পেটে মারার খুব নিকটেই দাঁড়িয়ে ইজরায়েল। ডিসেম্বরের গোড়ার দিকেই ওয়ররল্ড ফুড প্রোগ্রাম সতর্ক করেছে যে, “গাজার খাদ্য ব্যবস্থা ধ্বংসের দোরগোড়ায়।”
আরও পড়ুন- এক কক্ষপথ পার, নতুন সূর্যের অপেক্ষায় আজও যুদ্ধক্লান্ত গাজা
গাজার উত্তরে প্রায় তিন মাস ধরে কোনও সাহায্য আসেনি, সেখানে প্রায় ৬৫,০০০ ফিলিস্তিনি দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন। গাজার স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ ১ এপ্রিল জানিয়েছিল, ২৮জন শিশু সহ ৩২ জন উত্তরাঞ্চলের হাসপাতালে অপুষ্টি এবং জলশূন্যতার কারণে মারা গেছেন। মার্চ মাসে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কামাল আদওয়ান এবং আল-আওদা হাসপাতালে শিশুদের অনাহারে মারা যাওয়ার ঘটনা নথিভুক্ত করে। গাজার দক্ষিণেও সাহায্য অপর্যাপ্ত। জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থাগুলি ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে জানিয়েছিল, ২ বছরের কম বয়সের ৫ শতাংশ শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে।
গাজার যুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যান্য যুদ্ধাপরাধের পাশাপাশি এই নৃশংসতার কারণে ইজরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু এবং প্রাক্তন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের ১২৪ সদস্য রাষ্ট্রের যে কোনও একটিতে ভ্রমণ করলেই গ্রেফতারের হুমকি দেওয়া হয়েছে। নভেম্বরের শেষের দিকে ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট (আইসিসি) নেতানিয়াহু, গ্যালান্ট এবং হামাস কমান্ডার মহম্মদ দেইফের বিরুদ্ধে এই গ্রেফতারি পরোয়ানা ওয়ারেন্ট জারি করে। ইজরায়েল অবশ্য দাবি করেছে, জুলাই মাসেই তারা হামাস কমান্ডার দেইফকে হত্যা করেছে। আইসিসি অবশ্য বলছে, মহম্মদ দেইফকে হত্যা করা হয়েছে নাকি তিনি বেঁচে আছেন তা নির্ধারণ করার মতো অবস্থানে নেই আইসিসি।
আইসিসি জানিয়েছে, নেতানিয়াহু এবং গ্যালান্ট “যুদ্ধের একটি পদ্ধতি হিসাবে অনাহারকে হাতিয়ার করে যুদ্ধাপরাধ ঘটিয়ে চলেছে”। হত্যা, নিপীড়ন এবং অন্যান্য অমানবিক কাজের উদাহরণ তো অজস্র। দেইফের বিরুদ্ধে আইসিসি নির্যাতন, ধর্ষণ এবং আরও বিভিন্ন যৌন হিংসার পাশাপাশি হত্যা, নিষ্ঠুর আচরণ, নির্যাতনের যুদ্ধাপরাধ; বন্দি করা; ব্যক্তিগত মর্যাদার উপর আক্রোশ ইত্যাদি অপরাধকে সামনে রেখেছে।
বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, ইজরায়েলের বোমাবর্ষণ গাজার অন্তত ৭০ শতাংশ ইউএনআরডব্লিউএ স্কুল ধ্বংস করেছে। এর মধ্যে ৯৫ শতাংশ স্কুল যুদ্ধ চলাকালীন বাস্তুহারা মানুষদের আশ্রয়কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিল। ইজরায়েল বলেছে, সে দেশের বাহিনী সাধারণ নাগরিকদের হত্যা করতে চায় না। কিন্তু হামাসই নাগরিকদের পরিকাঠামো ব্যবহার করে যুদ্ধ চালাচ্ছে। ফলে হামাসকে নিকেশ করতে গিয়ে সাধারণ মানুষের প্রাণ যাচ্ছে।
আরও পড়ুন- মৃত্যু উপত্যকা গাজা | এত লাশ রাখব কোথায়?
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি বলছে, গাজার একটি জায়গাও নিরাপদ নয় - এমনকী ইজরায়েল যে যে স্থানগুলিকে ‘নিরাপদ অঞ্চল’ বলে ঘোষণা করেছে সেগুলোও নয়। দক্ষিণ গাজার আল-মাওয়াসি ক্যাম্পে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা গত ৪ ডিসেম্বরে ইজরায়েলি বোমা হামলার শিকার হয়। অথচ ইজরায়েল এই অঞ্চলটিকে নিরাপদ মানবিক অঞ্চল বলে দাবি করেছিল।
মধ্য গাজায়, গত ১৪ অক্টোবর দেইর আল-বালাহতে আল-আকসা শহিদ হাসপাতালে ইজরায়েলি বিমান হামলায় আগুন লেগে যায়। উত্তরে, বেইট লাহিয়ার কামাল আদওয়ান হাসপাতালেও ইজরায়েলি সেনা হামলা করেছে। কামাল আদওয়ানে কিন্তু কোনও হামাস জঙ্গি উপস্থিত ছিল না বলেই জানা গিয়েছে। স্থানীয় চিকিত্সকরা এবং হামাসও বিষয়টি অস্বীকার করে। তা সত্ত্বেও, ইজরায়েল ভারী বিমান হামলা চালায়। ডিসেম্বরের শেষের দিকে, ইজরায়েলি বাহিনী হাসপাতালের পরিচালক হুসাম আবু সাফিয়াকে গ্রেফতর করে।
অনেকেই ভেবেছিলেন, ১৭ অক্টোবর বুঝি যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটবে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের হামলার মূল পরিকল্পনাকারী ইয়াহিয়া সিনওয়ার দক্ষিণ গাজার রাফাহতে ইজরায়েলি সেনার হাতে নিহত হন সেদিন। গত বছর ইজরায়েলের হাতে নিহত হন একাধিক হামাস নেতা — হামাসের গাইডিং কাউন্সিলের ডেপুটি চেয়ারম্যান সালেহ আল-আরৌরি, বৈরুতে সন্দেহভাজন ইজরায়েলি হামলায় নিহত হন তিনি; মারওয়ান ইসা, আল-কাসাম ব্রিগেডের ডেপুটি কমান্ডার গত মার্চ মাসে মধ্য গাজার নুসিরাত ক্যাম্পে নিহত হন; এবং দেইফ, সিনওয়ারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী, আল-মাওয়াসিতে জুলাই মাসে নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। হামাসের রাজনৈতিক নেতা ইসমাইল হানিয়াহ জুলাই মাসে ইরানের রাজধানী তেহরানের একটি সরকারি গেস্ট হাউসে তাঁর শোওয়ার ঘরে বোমা বিস্ফোরণে নিহত হন।
সিনওয়ারের মৃত্যুতে নেতানিয়াহু স্পষ্ট করে জানিয়েছিলেন যে সংঘাত শেষ হয়নি। এক্স-এ লিখেছিলেন, “যদিও এটি গাজার যুদ্ধের শেষ নয়, এটি শেষের শুরু।” যুদ্ধ মন্ত্রিসভার সদস্য বেনি গ্যান্টজ বলেই দেনন, ইজরায়েলি বাহিনী গাজায় “আগামী কয়েক বছর ধরে” অভিযান চালিয়ে যাবে।
আরও পড়ুন- একদিনের শিশু, ৩০০০ ভ্রুণকে হত্যা ইজরায়েলের! গাজায় আর শিশুদিবস আসবে?
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের একটি সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইজরায়েল “অধিকৃত গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা করেছে এবং তা চালিয়েও যাচ্ছে।” গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে গণহত্যার চালানোর জন্য ইজরায়েলের বিরুদ্ধে প্রথম যে দেশগুলি অভিযোগ তোলে, তাদের মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা। স্পেন, বেলজিয়াম, তুর্কিয়ে, মিশর এবং চিলি সহ বিশ্বের অন্তত ১৪টি দেশ ইজরায়েলের বিরুদ্ধে গিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার পাশে দাঁড়িয়েছে৷
২০২৩ এর ৭ অক্টোবর ইজরায়েলে হামলা হওয়ার পর আমেরিকাকে পাশে পেয়েছিল ইজরায়েল। পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল ব্রিটেন, ফ্রান্সের মতো দেশগুলিও। হামাসকে সবক শেখাতে গিয়ে গাজায় কাতারে কাতারে মানুষকে শেষ করে দেয় ইজরায়েল। শেষ করে দিচ্ছে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে। জল সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া হয়, খাদ্য ও জ্বালানি আটকে দেওয়া হয় গাজায়। প্রাণে যারা মরে যাচ্ছে, তাঁদের হয়তো বা মুক্তিই মিলছে। যারা এই অবস্থাতেও আহত হয়ে বেঁচে যাচ্ছেন বা এখনও বেঁচে আছেন, তাঁদের জীবনকে কীসের সঙ্গে তুলনা করা যায় সেই উদাহরণ সম্ভবত তৈরিই হয়নি বিশ্বে।
View this post on Instagram
যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব তো নতুন নয়! এর আগেও তা পাশ হয় রাষ্ট্রপুঞ্জে। রাষ্ট্রপুঞ্জের সাধারণ পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব উত্থাপন করে জর্ডন। প্রস্তাবপত্রে ভোট দেয় ১২০টি সদস্য-দেশ। বিপক্ষে ভোট দেয় ১৪টি রাষ্ট্র। ভারত-সহ ৪৫টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। ততদিনে সাড়ে ৬ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে গাজায়। যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব কানেও তোলে না ইজরায়েল। ২০২৩ সালের ২৪ নভেম্বর। যুদ্ধের ৪৮ দিনের মাথায় ইজরায়েল ও হামাস, দু'পক্ষই সম্মত হয় এক মাসের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে। হামাসের কবল থেকে মুক্ত করা হয় ১০০ জন পণবন্দিকে। অন্যদিকে ইজরায়েল তাদের জেল থেকে মুক্তি দেয় ২৪০ জন ফিলিস্তিনি বন্দিকে। তবে যুদ্ধবিরতির আড়ালেই আগ্রাসন জারি রাখে ইজরায়েল। শরণার্থী শিবিরে বোমা ফেলতে থাকে ইজরায়েল।
এই যুদ্ধের মধ্যে গাজার মানুষের কাছে আরেক বিপদ হয়েছে চরম শৈত্য! গাজায় প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৭! এই প্রবল শীতে তাঁবুতে বসবাসকারী বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের অবস্থা অকল্পনীয়। শৈত্য ও তুষারপাতের" কারণে মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এর সঙ্গে ভারী বৃষ্টিপাতের আশঙ্কাও থাকছে। আশ্রয় শিবিরের ওই পাতলা তাঁবুতে এই প্রবল ঠান্ডায় নিরাপদে থাকা সম্ভবও না। মৃত সাত জনের মধ্যে ছয়জনই শিশু! ১৪০০০-এরও বেশি শিশুর প্রাণ গেছে গাজায়। ৩০০০ ভ্রুণ নষ্ট হয়ে গেছে! তবু যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধবিরতির মৃদু প্রস্তাবকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে একটি দেশ আরেকটি দেশকে শেষ করে দিচ্ছে। মানবাধিকার গুঁড়িয়ে গেছে। আর আমরা সম্মিলিতভাবে এগিয়ে যাচ্ছি ২০২৫ সালের দিকে, যুদ্ধের ঘা মগজে নিয়েই।