বামেরা কি বিজেপির প্রতি 'দুর্বল'? জেলাস্তরে যে উত্তর খুঁজছে সিপিএম
CPIM: সত্যিই কি যাহা বাম, তাহাই রাম? সিপিএমের ভোটেই কি এই রাজ্যে দ্বিতীয় দল হিসেবে জায়গা করে নিল বিজেপি?
যাহা বাম, তাহাই রাম। এই মর্মে রাজ্যের শাসকদল ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে জোর প্রচার করেছিল। লক্ষ্য স্পষ্ট। বিরোধী শিবিরে ভোট ভাগ হয়ে যাওয়া আটকানো, আর সিপিএম বলে যে কিছু নেই, তা জনমানসে প্রমাণ করে দেওয়া। সিপিএম যে আসলে বিজেপি, তা মানুষকে বোঝাতে চেয়েছিল শাসকদল তৃণমূল। কারণ গেরুয়া আর লাল এই দুই শিবিরই সবুজ শিবিরের বিপরীত। বিপরীত শিবিরে যারা আছে তারা আসলে একই গোত্রীয়, বিশ্বাস করাতে চেয়েছিলেন নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। নৈতিকভাবে সিপিএম আর বিজেপি দুই মেরুতে। কিন্তু শত্রুর শত্রু যেহেতু সখা হয়েও যায়, তাই এই রাজ্যে অন্তত তৃণমূলকে আটকাতে বিজেপির হাত শক্ত করতে পারে সিপিএম- এমন ধারণাও অমূলক ছিল না। অমূলক যে ছিল না তার প্রমাণও রয়েছে ঢের। বিধায়ক থেকে শুরু করে স্থানীয় নেতা, বহু কমিউনিস্ট নেতানেত্রী 'আগে রাম-পরে বাম' বলে মোদি বন্দনায় শামিল হয়েছেন। সত্যিই কি যাহা বাম, তাহাই রাম? সিপিএমের ভোটেই কি এই রাজ্যে দ্বিতীয় দল হিসেবে জায়গা করে নিল বিজেপি? সিঙ্গুরে হুগলি জেলা সিপিএমের জেলা সম্মেলনে যে রাজনৈতিক-সাংগঠনিক খসড়া প্রতিবেদন পেশ করা হয়েছে, তাতে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, দলের একাংশ কি বিজেপির প্রতি ‘নরম’ ও ‘দুর্বল’?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেই বিশ্লেষণ করেছেন, সিপিএমের (বিশেষ করে জেলা স্তরে) অনেকেই বিশ্বাস করেন, যতদিন তৃণমূল ক্ষমতায় আছে, বামেদের ক্ষমতার ধারে কাছে আসার সম্ভবনা শূন্য। আর এই মুহূর্তে তৃণমূলকে একমাত্র ঠেকানোর ক্ষমতা রাখে বিজেপি। তাই, আগে বিজেপিকে ক্ষমতায় আনতে হবে, তারপর বিজেপিকে সিপিএম ক্ষমতাচ্যুত করতে পারবে। যেহেতু তৃণমূল নীতিভিত্তিক দল নয়। তাই বিজেপি ক্ষমতায় এলে বড় সংখ্যক তৃণমূল নেতারা শিবির বদলেই নেবেন বলে ধারণা সিপিএমের জেলাস্তরের অনেকেরই। গত কয়েকবছরে লালঝান্ডাধারী বহু মানুষ যেভাবে রামভক্ত হয়েছেন, তাতে বোঝা যায় এই ভাবনা মোটেও অলীক নয়। এবার সেই ধারণাগুলিকে সামনে রেখে খানিক আত্মসমালোচনার সুরেই যেন জেলা সম্মেলনে বিষয়টিকে আলোচনার জায়গায় নিয়ে এসেছে বামেরা। ওই প্রতিবেদনের ১৮ নম্বর পাতায় লেখা হয়েছে, ‘আমাদের একটা অংশের ভিতরেও বিজেপির প্রতি নরম মনোভাব ও দুর্বলতা কাজ করছে না কি, ভেবে দেখা দরকার"।
আরও পড়ুন- শূন্য শুধু শূন্য নয়, পরমতসহিষ্ণু হতে চাইছে সিপিএম
বিধানসভা ভোটের চেয়ে বেশি হিংসা দেখেছে এই রাজ্য পঞ্চায়েত নির্বাচনে। সেই সময় জেলা ও গ্রামীণ স্তরে সিপিএম করার অপরাধে বহু বহু নেতা কর্মী অকথ্য অত্যাচারের শিকার হয়েছেন তৃণমূলের দুষ্কৃতীদের হাতে। এই মানুষদের বাধ্য করা হয়েছে তৃণমূলে যোগ দিতে। বামেরা এতই দুর্বল হয়েছিল যে নিজের দলের কর্মীদের নিরাপত্তাও জোগাতে পারেনি। এমতাবস্থায় তৃণমূলের হাত থেকে বাঁচাতে আশ্রয় জুগিয়েছে গেরুয়া শিবিরই। ক্ষমতার বিপরীতে আরেক ক্ষমতা। সিপিএম পরে স্বীকারও করেছিল যে, তৃণমূলের অত্যাচার থেকে বাঁচতেই দলের অনেকে বিজেপি শিবিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
তবে সিপিএমের মাথাদের বরাবর বক্তব্য থেকেছে যে, "যাহা তৃণমূল, তাহাই বিজেপি"। দলের প্রচারে, ইশতেহারেও তৃণমূল-বিজেপি সেটিং তত্ত্বের কথাই বামেরা তুলে ধরেছে। তবে সে কথায় যে চিঁড়ে ভেজেনি তাও প্রমাণিত। সিপিএম বারবার বলেছে, বলছে তৃণমূল এত দুর্নীতি করেও পার পেয়ে যাচ্ছে একটিই কারণে। একের পর এক কেলেঙ্কারি-দুর্নীতির ক্ষেত্রে কেন্দ্রের সংস্থা ইডি-সিবিআই তদন্ত করলেও আখেরে তার পরিণতি দেখে স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে 'দিদি-মোদি' সেটিং আছে। যদিও তৃণমূলের প্রতি মানুষের ভোট প্রমাণ করে দিয়েছে, সিপিএমের তত্ত্বে বিশেষ আমল দিচ্ছেন না কেউই।
গ্রামীণস্তরে বিজেপির রমরমা ক্রমেই বাড়ছে। এর একমাত্র কারণ ব্যাপক পরিমাণে সাংগঠনিক কাজকর্ম। আরএসএস নীরবে বহুকাল ধরেই কাজ করে চলেছে এই বাংলায়। কোনও রাজনৈতিক ব্যানার ছাড়াই মানুষদের ক্রমে জোট বাঁধানোর খেলা চলছে। সিপিএম কি দেখেও অদেখা করছে? নাকি সিপিএম জানে, ঠেকানোর ক্ষমতাই নেই তাদের? জেলা সম্মেলনের খসড়া প্রতিবেদনে একাধিকবার দল স্বীকারও করেছে যে মানুষকে বিজেপি থেকে লালে ফেরানো যায়নি। মানুষ ক্রমেই একটি সাম্প্রদায়িক শক্তিকে মদত দিচ্ছেন। এককালে জঙ্গলমহলের মতো আদিবাসী এলাকা সিপিএমের গড় ছিল। সেখানে বিজেপির প্রাবল্য এখন নজর কাড়ে! তাহলে কি বিজেপির ক্ষেত্র আখেরে সিপিএমই প্রস্তুত করে দিয়েছে?
একথা অনস্বীকার্য, সিপিএম কলকাতাকেন্দ্রিক দল হয়ে উঠছে ক্রমশ। ব্যাপকহারে ক্ষমতাহীন হচ্ছে জেলায়। সাংগঠনিক শক্তি সেখানে নেই বললেই চলে। পাড়ায় পাড়ায় কোনও ইস্যুভিত্তিক বৈঠক নেই, স্থানীয় মানুষের অভাব-অভিযোগ জানার চেষ্টাও নেই, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডও নগণ্য। কেবল ফেসবুকে সক্রিয়তা দিয়ে ময়দানের রাজনীতি যে করা যায় না একথা সিপিএম জানে, মানেও। তবে তা থেকে শিক্ষা নিয়ে সংগঠন মজবুত করার লক্ষ্যে কতখানি অগ্রসর হয় তাতে প্রশ্নচিহ্ন রয়েছে। জেলা সম্মেলনের ওই প্রতিবেদনে উল্লিখিত হয়েছে "মতাদর্শগত ভাবে উন্নত বাহিনী গড়ে তোলাই এই পরিবেশ থেকে বেরিয়ে আসার একমাত্র পথ।" কিন্তু বাহিনী গড়বে কে? জেলায় জেলায় দলীয় 'মাথাদের' দাদাগিরি নিয়ে বিস্তর অভিযোগ আছে। সেখানে তরুণ মুখ বা নতুনদের চিন্তাকে আমলই দেওয়া হয় না তেমন। নেতৃত্ব দেওয়ার মতো মুখই বা কই?
আরও পড়ুন- সিপিএমে গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে সুজন চক্রবর্তী বনাম শমীক লাহিড়ী? যা ঘটছে দক্ষিণ ২৪ পরগনায়…
২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে এই রাজ্যে একটিও আসন জিতে পারেনি বামেরা। বামফ্রন্টের এই ভরাডুবিকালে একমাত্র মুর্শিদাবাদ আসনে দ্বিতীয় স্থানে ছিল সিপিএম। এবার ৩০টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল বামফ্রন্ট, পেয়েছে মটে ৬.৩৩% ভোট। ২০১৯ সালে ৪০টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৭.৪৪% ভোট পেয়েছিল। দল ভোটপরবর্তী আত্মসমালোচনায় বলেছিল, "ধর্মনিরপেক্ষ ভোটাররা, বিশেষ করে সংখ্যালঘুরা তৃণমূলের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে।"
বিজেপি গতবারের থেকে এবার ৬টি আসন কম পেয়েছিল। ১৮টি আসন থেকে কমে ১২টি আসন আসে তাদের দখলে। তবে আসন কমলেও, ভোট শতাংশ তেমন কমেনি। এবার বিজেপির ভোট ভাগ মাত্র ১.৫১ শতাংশ কমেছে। ২০১৯ সালে বিজেপি পেয়েছিল ৪০.২৫ শতাংশ ভোট। ২০২৪ সালে তা কমে হয়েছে ৩৮.৭৪%৷ উল্টে ২০২১ সালের তুলনায় বিধানসভা নির্বাচনে ভোটের হার কিছুটা বেড়েছেও।
রাজ্য কমিটি পর্যালোচনা করে জানিয়েছিল, ১২ থেকে ১৪ শতাংশ বুথে কোনও পোলিং এজেন্টই ছিল না সিপিএমের। সংগঠনের দুর্বল অবস্থা বোঝার এর চেয়ে সহজ উদাহরণ আর নেই। ফলে খুব সহজেই অনুমেয়, শাসক তৃণমূল আর বিরোধী বিজেপি- এই বাইনারিতে বাঁধা পড়ে আছে বাংলার রাজনৈতিক চালচিত্র। সিপিএম আছে, তবে না থাকার মতোই। দীর্ঘদিন ধরে সিপিএমকে ভোট দেওয়া মানুষ যখন বিজেপির হয়ে গলা ফাটান তখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে ৩৪ বছর ধরে শাসন করার পরেও যদি মানুষ বিজেপিকে বিকল্প ভাবে, তাহলে মানুষকে কীই বা বোঝাতে পারল নীতিবাদী এই দল? জেলা সম্মেলনে আত্মসমালোচনা করে কি এই ঘা শুকোবে কোনওদিন?