অর্থনৈতিক উদারীকরণের স্থপতি হিসেবে মনমোহন সিংকে মনে রাখবে দেশ

Manmohan Singh Death: ১৯৯০-এর দশকে দেশের অর্থনীতিকে সবচেয়ে খারাপ সঙ্কট থেকে বের করে আনার ক্ষমতা দেখিয়েছিলেন মনমোহনই।

১৯৮৪ সালের নভেম্বরে ইন্দিরা গান্ধিকে হত্যা করেছিলেন তাঁরই দেহরক্ষী। ভারতের প্রথম এবং এখনও পর্যন্ত একমাত্র শিখ প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মনমোহন সিং সংসদে বলেছিলেন, লজ্জায় তাঁর মাথা হেঁট হয়ে যায় কারণ তাঁর নিজের রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত কিছু মানুষ তাঁর নিজের শিখ সম্প্রদায়ের মানুষদের নির্বিচারে হত্যা করেছিল ইন্দিরা হত্যার বদলা নিতে। মনমোহনের এই স্বচ্ছ অবস্থানই সম্ভবত ভারতের রাজনীতির ইতিহাসে তাঁকে এমন এক স্থানে নিয়ে যাবে, যেখানে শুধুই একজন রাজনীতিবিদ নন তিনি, মনমোহন একজন রাজনৈতিক দার্শনিক।

১৯৩২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর পশ্চিম পঞ্জাবের গাহ নামক একটি জায়গায় জন্মগ্রহণ করেন মনমোহন। গাহ বর্তমানে পাকিস্তানের অংশ। স্বাধীনতার পর ভারত ভাগ হয়ে গেলে তাঁর পরিবার ভারতে চলে আসে। যুক্তরাজ্যের কেমব্রিজ এবং অক্সফোর্ডে বৃত্তি পেয়ে পড়াশোনা করেছেন মনমোহন। বাণিজ্য মন্ত্রকের একজন উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। অর্থ মন্ত্রকের প্রায় প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ পদেই অধিষ্ঠিত ছিলেন। পরিকল্পনা কমিশনের প্রধান ছিলেন মনমোহন এবং বাণিজ্য এবং উন্নয়ন বিষয়ক জাতিসংঘের সম্মেলনের অংশ ছিলেন তিনি। ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর হিসাবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

সাউথ কমিশনের প্রধান মনমোহন সিংয়ের দর্শনে বামপন্থার ছাপ ছিল স্পষ্ট। পি ভি নরসিমহা রাও সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসাবে, ভারতের অর্থনৈতিক নীতির গতিপথকে এক নতুন দিশা দেখানোর কাজটি করেছিলেন মনমোহনই। ১৯৯১ সালের জুলাইয়ে দেশ যখন বৈদেশিক মুদ্রার চরম সংকটের মুখে, তখন ভারতীয় মুদ্রার দাম কমিয়েছিলেন তিনিই।

আরও পড়ুন- ভারতের প্রধানমন্ত্রীর ইতিহাসে কটূক্তিতে সেরা মোদিই! উত্তরসূরিকে নিয়ে যা বললেন মনমোহন

২০০৪ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর ভার সামলেছিলেন মনমোহন। সমালোচকরা এই দীর্ঘ দশ বছরের মেয়াদে মনমোহনকে বারেবারেই সনিয়া গান্ধির হাতের পুতুল প্রমাণ করতে কার্পণ্য করেননি। নিন্দুকেরা বারেবারে উপহাস করেছে যে মনমোহন সিং আসলে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অত্যন্ত দুর্বল। তিনি সনিয়ার অধীনস্থ প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন তাঁর শেষ কিছু সাংবাদিক সম্মেলনের একটিতে তিনি জোর দিয়ে বলেছিলেন, সমসাময়িক মিডিয়া এবং যে দলগুলি তখন সংসদে বিরোধী অবস্থানে ছিল, তারা যেভাবে মনমোহনের ভূমিকাকে দেখেছে, ইতিহাস এর চেয়ে অনেক বেশি সদয়ভাবে বিচার করবে তাঁর ভূমিকা। হয়তো, রাজনীতির আস্ফালনময় ভবিষ্যৎ, ঔদ্ধত্যময় সংখ্যাগরিষ্ঠতাবাদে দীর্ণ ভারতকে বহুবছর আগেই দেখতে পেয়েছিলেন তিনি।

একজন অরাজনৈতিক আমলা হিসাবেই কাজের শুরু তাঁর। অথচ তুখোড় রাজনৈতিক সচেতনতা ছিল তাঁর। ভারতীয় রাজনীতিতে বারেবারেই মনমোহন সম্বন্ধে একটি কথা ব্যবহৃত হয়েছে— অনিচ্ছুক রাজনীতিবিদ। ১০ বছরের দীর্ঘ প্রধানমন্ত্রিত্বে সম্ভবত সবচেয়ে বিতর্কিত ছিল ভারত-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক চুক্তির সিদ্ধান্ত। ২০০৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পরমাণু চুক্তির কারণে বামপন্থীরা তাঁর সরকার থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। সেই প্রথম ইউনাইটেড প্রগ্রেসিভ অ্যালায়েন্স সরকারকে বাঁচাতে সমাজবাদী পার্টিতে জোটে জুড়ে নিয়েছিলেন মনমোহন। ততদিন পর্যন্ত, কংগ্রেস এবং এসপির মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের সম্পর্কই ছিল। ১৯৯৬ সালে মুলায়ম সিং যাদব অটল বিহারী বাজপেয়ীর ১৩ দিনের সরকারের পতনের পর কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারকে সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও তা থেকে সরে এসেছিলেন। সেই বিশ্বাসঘাতকতা ভোলেনি কংগ্রেস। মনমোহন না থাকলে, বর্তমান গৈরিক উত্তরপ্রদেশে ইন্ডিয়া জোটের দুই শরিক সপা আর কংগ্রেসের এই বিজয়রথ এগোতে পারত কিনা সন্দেহ আছে। প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাও একবার মনমোহনের প্রশংসা করে বলেছিলেন, "এই প্রধানমন্ত্রী যখন কথা বলেন, মানুষজন তাঁর কথা শোনেন।"

১৯৯০-এর দশকে দেশের অর্থনীতিকে সবচেয়ে খারাপ সঙ্কট থেকে বের করে আনার ক্ষমতা দেখিয়েছিলেন মনমোহনই। বিরোধীরা তাঁকে 'পুতুল' ভাবতেই ভালোবেসেছে। অথচ দলীয় প্রধানের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই ২০০৮ সালে পারমাণবিক চুক্তিকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন মনমোহন। প্রবল বিরোধিতার মাঝেও সরকারের টিকিয়ে রাখার ঝুঁকি নিয়েছিলেন। বাম দলগুলি সাফ জানিয়ে দিয়েছিল যে মনমোহন সিং যদি পারমাণবিক চুক্তি করেন তবে তারা রাজনৈতিক সমর্থন প্রত্যাহার করবে। তাও দার্শনিক মনমোহনের সিদ্ধান্তই সম্ভবত ২০২৪ সালের ইন্ডিয়া জোটের ভিত্তিও গড়ে দিয়েছিল সেই সময়েই!

আরও পড়ুন- ছিলেন কংগ্রেসের স্তম্ভ, তাও কেন আরএসএসের সভায় গিয়েছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়?

১৯৯২ সালে হর্ষদ মেহতার কুখ্যাত স্টক-মার্কেট কেলেঙ্কারির জন্য মনমোহন সিংকে ব্যাপক আক্রমণ করা হয়েছিল। পরে, যখন তিনি প্রধানমন্ত্রী হন, টেলিযোগাযোগ এবং কয়লা খনি বিষয়ে তাঁর সরকারের দূরদর্শী চিন্তাভাবনার জন্য ভারতের কম্পট্রোলার এবং অডিটর জেনারেল মনমোহনের ইউপিএ সরকারকে সমর্থন করেছিল। দিল্লিতে কমনওয়েলথ গেমস পরিচালনার সময়ও তীব্র সমালোচিত হন মনমোহন। রাহুল গান্ধি প্রকাশ্যে তাঁর সরকার প্রবর্তিত একটি অধ্যাদেশ ছিঁড়ে ফেলেন।

নরেন্দ্র মোদি সরকার যখন ২০১৬ সালের নভেম্বরে নোটবাতিল ঘোষণা করে, তখন এই সিদ্ধান্তকে সংগঠিত লুট এবং আইনমাফিক তছরুপ হিসেবেই দেখেছিলেন মনমোহন। তবু, মৃদুভাষী এবং শান্ত স্বভাবের মনমোহন সিং কোনও অসংসদীয় বা কটু কথা উচ্চারণও করেননি কোনওদিন, কখনও না। বিরোধী হিসেবেও না, সরকার হিসেবেও না। 

More Articles