বাংলাদেশ ২০২৪: আওয়ামী যুগকে পেছনে ফেলে সামনের দিকে তাকাবার সময়
Bangladesh 2024: জুলাই সংগ্রামে বাংলাদেশ সমাজের জেগে ওঠা এক ঐতিহাসিক ঘটনা। তাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া নিঃসন্দেহে প্রতিক্রিয়াশীল কাজ।
বছরের শেষ অথবা শুরু কিংবা বছরের যে কোনও শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা— সবসময়ই বাংলাদেশ আমার কাছে প্রবল ঝলমলে, রঙিন, বর্ণময়। কোনও এক অজানা টানে আমি ছুটে ছুটে যাই ওদেশের জানা-অজানা অজস্র জনপদে। বাংলাদেশ কখনও আমার কাছে এক রহস্যময়ী নারী। কখনও চিরকালের প্রেয়সী। নতুন নতুন কত কিছু দেখি, আর পথের পাঁচালীর অপু-দুর্গার প্রথম ট্রেন দেখার মতো আনন্দে বিহ্বল হয়ে যাই। গভীর রাতে নদী পথে ঢাকা থেকে বরিশাল গেছি কতবার তার ইয়ত্তা নেই। খুলনার রূপসা নদী বড় চেনা। অথবা টাঙ্গাইল হয়ে সন্তোষ যাবার পথে ছোট্ট, তিরতির বয়ে চলা লৌহ জং আমাকে প্রাণিত করে। দেখতে দেখতে দশ-বারো বছর হয়ে গেল ওই দেশকে দেখছি। তবে এবারের দেখা এক অন্য অভিজ্ঞতা।
জুন-জুলাই মাসে গেলাম সাতক্ষীরা। আমার এক বন্ধুর আদি ভিটের খোঁজে। তালা উপজেলার অখ্যাত গ্রামে। তালা ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ঘাঁটি। কৃষক-শ্রমিকদের মিলিত শক্তি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কাছে ছিল আতঙ্ক। সেখান থেকে ঢাকা হয়ে বরিশাল। ফিরে আসছি, তখনই কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হয়েছে। তখন বিন্দুমাত্র ভাবিনি যে আমার চেনা বাংলাদেশ বড় দ্রুত বদলে যাবে। আশা করতাম, আপাত ঝাঁ চকচকে ঢাকা ওপরে-ওপরে শান্ত হলেও একদিন সে বিপুল ক্রোধে ফেটে পড়বে। ঊনসত্তরে, তারও আগে ৫২-তে, ৫৪-য় যেমন সে দৃপ্ত ভঙ্গিতে জেগে উঠেছিল আয়ুব শাহী, সাবেক মুসলিম লীগারদের বিরুদ্ধে। তারও পরে ১৯৭১। মুক্তিযুদ্ধ। ততদিনে আমি ট্যুরিস্ট চোখের বদলে খোলা চোখে দেখতে দেখতে ঢাকাকে, বাংলাদেশকে ভালোবাসতে আরম্ভ করেছি। হায়দার আকবর খান রনো, বুলবুল খান মাহবুব, জাফরুল্লাহ চৌধুরী বা আমার দিদি দীপা দত্তের কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষিত শুনছি। আসাদের মৃত্যু, সারা পুব-বঙ্গ জুড়ে কৃষক আন্দোলন, টুঙ্গি শ্রমিকদের লড়াই শুনতে শুনতে আমিও যেন সেই সব আগুনঝরা দিনগুলোতে ফিরে গেছি। আমি নিচু হয়ে কদমবুসি করছি, তিনি বিপুল স্নেহে আমাকে টেনে তুলে জানিয়ে দিলেন— গোল টেবিল না রাজপথ! আমরা সবাই আমাদের জননায়ক, বাংলাদেশের জাতির পিতা মওলানা ভাসানীর সঙ্গে গলা মিলিয়ে সমস্বরে গর্জে উঠলাম– গোলটেবিল না রাজপথ! রাজপথ রাজপথ। বলে উঠলাম– শ্রমিক কৃষক অস্ত্র ধরো, সমাজতন্ত্র কায়েম করো।
আরও পড়ুন- ফেলানি খাতুন থেকে স্বর্ণা দাস! যেভাবে সীমান্তে বারবার প্রাণ যায় সাধারণ বাংলাদেশিদের…
কখনও ঊনসত্তরে, কখনও দু'হাজার চব্বিশে- একা একা ঢাকার রাস্তায় হাঁটছি। ধানমণ্ডি, লালমাটিয়া, সাত মসজিদ, মীরপুর, মহম্মদপুর, জেনিভা ক্যাম্প, যাত্রা বাড়ি, হাতীর ঝিল... চব্বিশ তখনও সুবোধ। স্কাই স্ক্রাপার, মেট্রো রেল, হাইওয়ে, উঁচু উঁচু শপিং মল, হাড়-জিরজিরে রিকশাওয়ালা, এতিম বাচ্চা, ভিখারি মা, কিন্তু ভেতরে ভেতরে চাপা ক্রোধ, তখনও জানি না কী হতে চলেছে। শেখ হাসিনার হাসি মুখ সর্বত্রই। তিনিই দেশ, সরকার, রাষ্ট্র। ৭ মার্চ বা ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠার দিন ভোর থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের উচ্চ নিনাদে হাজারও প্রতিশ্রুতি। ভার্সিটির দেওয়ালে, পথের আনাচে কানাচে, হোর্ডিং, ফেস্টুন, ব্যানারে শুধু, শুধুই হাসিনা রেজিমের ক্ষমতার আস্ফালন। বিভিন্ন মহলে যোগাযোগ বাড়ছে। সরকারি স্তরেও। ততদিনে অবশ্য সুশীল বাংলাদেশের বাইরে এক নিষ্ঠুর, হিংস্র বাংলাদেশ লুকিয়ে রয়েছে। এ এক হীরক রাজার দেশ। গণতন্ত্র-টনতন্ত্র অলীক কল্পনা মাত্র। বিরোধী দলের স্বাধীনতা এখানে কষ্ট কল্পনা। একদিন আকাঙ্খিত অগ্নুৎপাতের জেরে ঢাকা ফের জায়গা করে নিল পৃথিবীর সংবাদ মাধ্যমে। এখন অনেকেই এমন ভাব করছেন যে, শেখ হাসিনা সরকারের অপসারণ ছিল চরম নির্বুদ্ধিতা। আমি দুঃখিত, তাঁদের সঙ্গে একমত হতে পারছি না বলে।
আরও পড়ুন- সীমান্তে মায়ানমারের সশস্ত্র গেরিলা অভ্যুত্থান আদৌ বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কিত?
জুলাই অভ্যুত্থান সোজাসাপ্টা দু'ভাগে ভাগ করে দিয়েছে দুই পারের জনগণ, বুদ্ধিজীবীদের। পশ্চিমবঙ্গের নব্বই শতাংশ মানুষ নতুন বাংলাদেশের বিপক্ষে। আসলে আওয়ামী লীগের প্রতি এই সহমর্মিতা নির্মাণ কোনও আকস্মিক বিষয় নয়। ধীরে ধীরে, কোটি কোটি টাকা খরচ করে জনমনে আওয়ামী ভক্তি নির্মিত হয়েছে। অনেকেই বলছেন, জুলাই অভ্যুত্থানের ঠিক কোন বিষয়টি আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ? আমি বলব, ইতিহাস পুনর্নির্মাণ বা পাঠের সম্ভাবনা। এত বছর বাংলাদেশে, তার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আদ্যন্ত মিথ্যা। ইচ্ছাকৃতভাবে সত্যকে বাদ দেওয়া। একটি পরিবারকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে অন্যান্য সব গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র, উপাদানকে বাদ দেওয়ার ষড়যন্ত্র। মহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের ভুলত্রুটি যথেষ্ট চোখে পড়ছে। ছাত্ররা বদলে যাচ্ছে। মৌলবাদ দেশের সমাজকাঠামোয় প্রভাব বাড়াতে সক্রিয় — এসব কথা এখন আর অস্বীকার করে লাভ নেই। কিন্তু তার মানে এটাও না যে, শেখ হাসিনা সরকারের যাবতীয় অপকর্ম আড়াল করতে হবে। আমি এই সরকারের সমালোচনা যদি করিও তাহলেও দীর্ঘ দিনের এক জগদ্দল শাসকদের সঙ্গে মাত্র কয়েকমাসের সরকারের কাজের তুলনা টানব না। করলে গঠনমূলক সমালোচনা করব। বাংলাদেশ, তার সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি নিয়ে খোলা চোখে প্রশ্ন তোলার সময় এসেছে। আওয়ামী যুগকে পেছনে ফেলে এখন সামনের দিকে তাকাবার সময়।
জুলাই সংগ্রামে বাংলাদেশ সমাজের জেগে ওঠা এক ঐতিহাসিক ঘটনা। তাকে ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া নিঃসন্দেহে প্রতিক্রিয়াশীল কাজ। নতুন সবসময়ই স্বাগত। সে নতুন বছর হোক বা নতুন সমাজ। নতুন বাংলাদেশের দিকে পড়শি দেশের এক সামান্য তথ্যচিত্র নির্মাতা অনেক আশা নিয়ে তাকিয়ে থাকল। জুলাই মাসের মাঝামাঝিও সেভাবে কিছু বলিনি। রাষ্ট্রের দানবিক সন্ত্রাস দেখেও রাতে ঘুমোতে পারতাম না। মৃত তরুণদের মুখ চোখের সামনে ভাসত। গুলি, হাহাকার, বিষাদ সবসময় অবসন্ন করে রাখত। নেট যতদিন ছিল ততদিন ওপার থেকে ফোনে কাকুতি ভেসে আসত, "দাদা স্পিক আউট। কিছু বলো, আর চুপ করে থেক না"। আমি বললাম। যেটুকু যা জানি। প্রতিবাদ করলাম হাসিনা রেজিমের। কত পুরনো বন্ধু ধমকাতে লাগলেন। কেউ ব্লক করলেন। কেউ আকুতি জানালেন, যেন কিছু না বলি। আমি পারলাম না। পুরনো অনেক বন্ধু সরে গেলেন আমার থেকে। কেউ বলতে লাগলেন, আমি জঙ্গিদের কাছ থেকে টাকা পেয়ে লিখছি। পাশাপাশি বাংলাদেশের কত কত অতি সাধারণ লোকজন পাশে এসে দাঁড়াতে লাগলেন। নিন্দে, স্তুতি কোনও কিছুর তোয়াক্কা না করে আমি ঠিক করলাম আগামী বছরেও আমি আগের মতোই বাংলাদেশের পথে পথে হাঁটতে থাকব। কাঁটাতারের বাধা সরিয়ে, রোদে কিংবা বর্ষায়, শীতে, বসন্তে শুধুমাত্র সত্যের খোঁজে। ওই দেশ, বাংলাদেশকে সত্যিই যে আমি ভালবেসে ফেলেছি।