লক্ষ্মীর ভান্ডার থেকে লাডলি বহেনা— কীভাবে মহিলাদের ভোট নিশ্চিত করছে প্রকল্পগুলি?
Lakshmir Bhandar: অনুদানের রাজনীতি সংসদীয় রাজনৈতিক দলগুলো উপর থেকে চাপাতে শুরু করল ২০০০ সালের পর থেকে। কিন্তু কেন?
সাম্প্রতিক সময়ে অনুষ্ঠিত মহারাষ্ট্র ও ঝাড়খণ্ড বিধানসভার ফলাফল আরেকবার মহিলাদের নগদ অনুদান কেন্দ্রিক প্রকল্পগুলির অনিবার্যতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। এই দুটো রাজ্যে, বিশেষ করে মহারাষ্ট্রে লোকসভা নির্বাচনে শাসকদলের (বিজেপি ও ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা) বিপর্যয়ের পর বিধানসভায় ঘুরে দাঁড়াবার পেছনে নগদ অনুদানের রাজনীতি নির্ণায়ক ভূমিকা পালন করেছে বলে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। মহারাষ্ট্রে 'লাডকি বহিন যোজনা' (মাসে ১৫০০ টাকা) এবং ঝাড়খণ্ডে 'মুখ্যমন্ত্রী মাইয়া সম্মান যোজনা' (মাসে ১০০০ টাকা) নির্বাচনের ময়দানে শাসকদলকে দারুণভাবে শক্তি যুগিয়েছে। সংসদীয় নির্বাচন সংক্রান্ত ওয়াকিবহাল মানুষদের কাছে এটা নতুন কোনও ঘটনা নয়। ২০২১ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনের আগে লক্ষ্মীর ভান্ডার প্রকল্প কিছুটা কোণঠাসা তৃণমূল কংগ্রেসের বিশাল জয়ের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা নিয়েছিল। সোশ্যাল মিডিয়ায় এই ভাতা-নির্ভর রাজনীতির বিরুদ্ধে এক শ্রেণির মানুষের যতই বজ্রনির্ঘোষ শোনা যাক না কেন, একথা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার যে লক্ষ্মীর ভান্ডারের মতো প্রকল্প এই মুহূর্তে ভারতের সংসদীয় রাজনীতির মূল এজেন্ডার মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। এই অনুদানকে বেছে নেওয়ার কারণটা অনুসন্ধানের সঙ্গে সঙ্গে এই রাজনীতি পিতৃতন্ত্রের পেষণে পিষ্ট নারীর ক্ষমতায়নের প্রশ্নে কোনও নতুন দিশা দেখাচ্ছে কি না, সেটাও আলোচনায় আসা জরুরি।
নারীকেন্দ্রিক প্রকল্পগুলো কীভাবে রাজনৈতিক দলকে ফায়দা দিচ্ছে, তার এক সংক্ষিপ্ত ইতিহাস প্রথমে উল্লেখ করা দরকার। এক্ষেত্রে প্রথমে পশ্চিমবঙ্গের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। লক্ষ্মীর ভান্ডারের আগেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মহিলাদের ভোট নিশ্চিত করার জন্য কন্যাশ্রী প্রকল্প (২০১৩), রূপশ্রী প্রকল্প (২০১৮) চালু করেন। তাই দেখা যাচ্ছে একাধিক প্রমাণিত দুর্নীতি, মহিলাদের উপর হওয়া অপরাধের সংখ্যা বৃদ্ধি সত্ত্বেও মহিলারা ভোটবাক্সে তৃণমূলকে ছেড়ে চলে যাননি। লক্ষ্মীর ভান্ডারে সাধারণ শ্রেণিতে মাসে ১০০০ টাকা ও তপশিলি জাতি ও উপজাতিদের জন্য মাসে ১২০০ টাকা পাচ্ছেন ২.২ কোটি মহিলা। এক্ষেত্রে আমাদের মনে রাখতে হবে, রাজ্যের মোট ভোটারের সংখ্যা ৭.২ কোটি, যার মধ্যে ৪৯ শতাংশ মহিলা।
আরও পড়ুন- লক্ষ্মীর ভাণ্ডার বা লড়কি বহিন! কেন মহিলাদের অনুদান দিলেই ভোটে জেতা সহজ?
এক্ষেত্রে নীতীশ কুমারের বিহার আরেকটি আলোচনাযোগ্য উদাহরণ। ২০০৭ সালে সেখানে চালু হয় নবম শ্রেণির ছাত্রীদের জন্য মুখ্যমন্ত্রী বালিকা সাইকেল যোজনা। ২০১৮ সালে মুখ্যমন্ত্রী কন্যা উত্থান যোজনা, যাতে দ্বাদশ শ্রেণি উত্তীর্ণদের জন্য ১,০০০ টাকা, স্নাতক হলে ৫০,০০ টাকা এবং সমস্ত মেয়েদের স্যানিটারি ন্যাপকিনের জন্য বার্ষিক ২,০০০ টাকা বরাদ্দ করা হয়। ২০২০ সালে মদ নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তও সেই অর্থে মহিলা স্বার্থ সংক্রান্ত প্রকল্প। দক্ষিণ ভারতের দুটো রাজ্যেও এই নারীকেন্দ্রিক প্রকল্পের রাজনীতির সফল প্রয়োগ দেখা যায়। ২০২৩ সালে কর্ণাটকে কংগ্রেসের বিধানসভা নির্বাচনে জয়ের ক্ষেত্রে বহু আলোচিত ৫টি গ্যারান্টি যোজনার দুটো ছিল সরাসরি মহিলা সম্পর্কিত। প্রথমটি হলো শক্তি (সরকারি বাসে মহিলাদের নিখরচায় ভ্রমণ) এবং দ্বিতীয়টি গৃহলক্ষ্মী যোজনা (পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলার জন্য ২,০০০ টাকা মাসিক ভাতা)। বাকি তিনটিতেও মহিলারা পরোক্ষভাবে উপকৃত হবেন। গৃহজ্যোতি (প্রত্যেক বাড়ির জন্য ২০০ ইউনিট বিদ্যুৎ ফ্রি), অন্নভাগ্য (দারিদ্রসীমার নীচে থাকা মানুষের জন্য মাসিক ১০ কিলোগ্রাম চাল) এবং যুবানিধি যোজনা (বেকার স্নাতকদের জন্য ৩,০০০ টাকা এবং ডিপ্লোমা হোল্ডারদের জন্য ১৫০০ টাকা)। পাশের রাজ্য তামিলনাড়ুতে প্রতিদিন ৬০ লক্ষ মানুষ (মহিলা, রূপান্তরকামী এবং সিনিয়র সিটিজেন) বিনামূল্যে সরকারি পরিবহণ ব্যবহার করে। এছাড়া রয়েছে মহিলাদের জন্য বার্ষিক ১২,০০০ টাকা অনুদান। তথ্যের খাতিরে একথা উল্লেখ করা দরকার যে, মহিলাদের জন্য নগদ সুবিধা বা তাদের জন্য বিভিন্ন উপহার প্রকল্প সারা দেশের মধ্যে এ রাজ্যে প্রথম চালু হয় প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতার সৌজন্যে।
মজার কথা হলো, বিজেপি যতই এই ধরনের মহিলাকেন্দ্রিক প্রকল্পকে 'রেউরি সংস্কৃতি' বলে বিদ্রূপ করুক না কেন, ফলিত রাজনীতিতে তারা একই পথের শরিক। এক্ষেত্রে প্রথম নাম অবশ্যই মধ্যপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান। ২০২৩ সালের মধ্যপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রচারপত্রের কেন্দ্রে ছিল দুটো প্রকল্প। প্রথমটি লাডলি বহেনা (মেয়েদের জন্য মাসে ১২৫০ টাকা) এবং দ্বিতীয়টি ছিল অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবারের মেয়েদের শিক্ষা ও বিয়ের জন্য আর্থিক অনুদানের লাডলি লক্ষ্মী যোজনা। কেন্দ্রীয় স্তরে নরেন্দ্র মোদির জনধন যোজনা (২০১৪), প্রধানমন্ত্রী উজালা যোজনা (২০১৬) এবং প্রধানমন্ত্রী মাতৃ বন্দনা যোজনা (২০১৭) একই রাজনীতির অনুসারী।
স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতের নারীকেন্দ্রিক রাজনীতি কিন্তু কখনও আর্থিক অনুদান বা এই ধরনের প্রকল্পের দাবি করেনি। সত্তর ও আশির দশকের নারীবাদী রাজনীতি বা সংসদীয় রাজনীতির মহিলা সংক্রান্ত এজেন্ডা ছিল মূলত অধিকারকেন্দ্রিক। সেক্ষেত্রে সুরক্ষা ছিল একটা বড় বিষয়। গৃহ হিংসা ও যৌন হিংসা থেকে মুক্তি, শিক্ষার দাবি, কর্মক্ষেত্রে সম মজুরি, যৌন শোষণের থেকে রক্ষা, নারী স্বাস্থ্যর মতো বিষয়গুলো ছিল প্রধান। আরেকটি বিষয় ছিল, সংসদীয় ব্যবস্থায় মহিলাদের অধিক অংশগ্রহণের নিশ্চয়তার জন্য সংরক্ষণের দাবি। এই অনুদানের রাজনীতি সংসদীয় রাজনৈতিক দলগুলো উপর থেকে চাপাতে শুরু করল ২০০০ সালের পর থেকে। কিন্তু কেন? উত্তরটা লুকিয়ে আছে সংসদীয় রাজনীতির পাটিগণিতে।
এই পাটিগণিত বুঝতে হলে আমাদের নির্বাচনী সংখ্যাতত্ত্বের দিকে নজর ফেরাতে হবে। ১৯৫৭ সালের লোকসভা নির্বাচনে ৩৯ শতাংশ মহিলা ভোট দিয়েছিলেন, পুরুষ ভোটার ছিলেন ৫৬ শতাংশ। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে দেখা যাচ্ছে পুরুষ ও মহিলা- উভয় ক্ষেত্রেই শতাংশের পরিমাণ ৬৬। ১৯৬২ সালের সংসদীয় নির্বাচনে ৪১ শতাংশ মহিলা ভোট দেন। এমনকী ১৯৮৪ সালে মহিলা ভোটারের হার ছিল ৪৪ শতাংশ। ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে ভোটের হারের পার্থক্য ছিল ১২ শতাংশ কিন্তু তারপর থেকে ছবিটা দ্রুত পাল্টাতে শুরু করে। শুধুমাত্র ভোটের শতাংশের বিচারে নয়, ভোটার তালিকাতেও মেয়েদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। শেষ দুটো লোকসভার আগে প্রস্তুত ভোটার তালিকায় দেখা যায় যে, সেখানে মহিলা ভোটারদের বৃদ্ধির হার পুরুষ ভোটারদের চেয়ে বেশি।
আরও পড়ুন- ফের লক্ষ্মীর ভাণ্ডারেই আস্থা! কেন মমতাকে সবচেয়ে বেশি ভোট দেন মহিলারা?
নির্বাচন কমিশন প্রদত্ত পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, দেশের বেশ কিছু রাজ্যে শেষ নির্বাচনে মহিলারা পুরুষদের চেয়ে বেশি সংখ্যায় ভোট দিয়েছেন। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, স্থানীয় স্তরের নির্বাচনে মেয়েদের অংশগ্রহণ এবং নির্বাচন কমিশনের ধারাবাহিক প্রচার এক্ষেত্রে সদর্থক ভূমিকা পালন করেছে। সংসদীয় দলগুলোর কাছে ভোট একমাত্র বিবেচ্য হওয়ার কারণে তারা এটা উপলব্ধি করেছে যে, মহিলারা একটা ব্লক ভোট হিসাবে নির্ণায়ক হয়ে উঠতে পারে। আর যেহেতু এই ধরনের প্রকল্পের টাকা ডিজিটাল ট্রান্সফারের মাধ্যমে সরাসরি উপভোক্তার অ্যাকাউন্টে পাঠানো সম্ভব, তাই মহিলাদের কাছে পৌঁছনোর জন্য তাদের আর মধ্যবর্তী এজেন্ট হিসাবে পুরুষদের প্রয়োজন নেই। স্বাভাবিকভাবেই নির্বাচনের লড়াইতে মহিলাদের উত্তরোত্তর গুরুত্ব বৃদ্ধি পাছে। আগামীদিনে এই ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক পপুলিস্ট রাজনীতি আড়ে-বহরে বাড়বে।
এখন প্রশ্ন হলো, মহিলাদের জন্য একের পর এক অনুদান প্রকল্প, মহিলা ভোট নিশ্চিত করার জন্য সংসদীয় রাজনৈতিক দলগুলোর এই প্রতিযোগিতা কি নারীর ক্ষমতায়নের রাজনীতিকে সাহায্য করতে পারছে? উত্তরটা কিন্তু সদর্থক নয়। একথা ঠিক এই মাগ্গিগন্ডার বাজারে নগদ টাকা মহিলাদের বেঁচে থাকতে কিছুটা হলেও সাহায্য করে। বিনামূল্যে পরিবহণ, শিক্ষাক্ষেত্রে আর্থিক সাহায্য কার্যকরী কিন্তু সাম্প্রতিক সমস্ত পরিসংখ্যানে স্পষ্ট যে, মহিলাদের উপর সংঘটিত অপরাধের পরিমাণ উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। নারী সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলো যে সমস্ত আইন এনেছে তা বাস্তবে খুব একটা কার্যকরী হচ্ছে না। কর্মক্ষেত্রে একই কাজের জন্য মেয়েরা, পুরুষদের চেয়ে কম মাইনে পাচ্ছেন। এমনকী লোকসভা ও বিধানসভায় মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার আইন এখনও বিশ বাঁও জলে। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ যে, মহারাষ্ট্রে মহিলাদের জন্য অনুদান প্রকল্প নিয়ে এত আলোচনা, সেখানে এবারের বিধানসভা নির্বাচনে ৪,১৩৬ জন প্রার্থীর মধ্যে ৩৬৩ জন মাত্র মহিলা। আজ ভারতীয় রাজনীতিতে ভোটার হিসাবে মহিলাদের গুরুত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে, লক্ষ্মীর ভান্ডারের মতো প্রকল্পের সংখ্যা বৃদ্ধি তার প্রমাণ। কিন্তু নারীর ক্ষমতায়ন ও নারীমুক্তির প্রশ্নটি আসলে পিতৃতন্ত্রকে আঘাত করার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। সেই রাজনীতির অনুসরণ বিনা মহিলারা সংসদীয় রাজনীতিতে উপভোক্তা হিসাবেই থেকে যাবেন। এই পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে এই প্রকল্পগুলোকে সমর্থন ও আরও বিস্তৃত করার দাবি যেমন নারীবাদী রাজনীতিতে থাকবে তেমনই বেনিফিসিয়ারি পরিচিতির উর্ধ্বে উঠে ক্ষমতায়নের রাজনীতির নতুন ভাষ্য নির্মাণ করাটাও আজ এক বড় চ্যালেঞ্জ।