'আমিত্ব' ভারতীয় সংবিধানের মূল নয়, মনমোহনের জয় ও পরাজয় সেই মূলেই লুকিয়ে
Manmohan Singh Death: ১০ বছরের শাসনকালে মনমোহন সিংহ জননেতা বা তথাকথিত রাজনৈতিক নেতা বা একনায়ক হয়ে উঠতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু নিজের ও সংবিধানের মর্যাদা রক্ষা করেছেন একজন শিক্ষিত ও রুচিশীল ব্যক্তি হিসেবে।
আমরা অনেকই তাঁর নীরবতা, অন্যের হাতের 'পুতুল' হয়ে থাকা ও কড়া সিদ্ধান্ত নিতে না পারার দুর্বলতাকেই বড় করে দেখে এসেছি। বিশেষত, মনমোহন সিংহের প্রধানমন্ত্রিত্বের শেষের দিকে সেই নীরবতাকে ভেঙেই যেন 'সরব' ও শক্তিশালী প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে নরেন্দ্র মোদীর আত্মপ্রকাশ। শেষে ২০১৪ সালে মনমোহন সিংহ সরকারের পতন ও নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে '৫৬ ইঞ্চি ছাতির' বিজেপির সরকার গঠন।
মনমোহন সিংহের প্রধানমন্ত্রীত্বের শেষের কয়েক বছর তাঁর সরকার বিদ্ধ হয়েছে সীমাহীন দুর্নীতির অভিযোগে। তা সে কয়লা ব্লক বণ্টন বা টু-জি স্পেক্ট্রাম বা কমনওয়েলথ গেমস নিয়ে তাঁর সতীর্থদের দুর্নীতির অভিযোগের কালি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর গায়ে লেগেছিল। নিজের সততা প্রশ্নাতীত হলেও, কেন তিনি এই দুর্নীতি আটকাতে ব্যর্থ হয়েছেন সেই প্রশ্নই বড় হয়ে উঠেছিল।
২০০৪-এ প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে যে তিনি তৎকালীন কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর ইচ্ছাতেই বসেছিলেন, তা কারও অজানা নয়। তাঁর বিরুদ্ধে 'বিদেশিনী' ইস্যুকে ভোঁতা করতেই সোনিয়া গান্ধী তুরুপের তাস হিসেবে মনমোহন সিংহকে প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন। কিন্তু অভিযোগ ছিল, তার পরবর্তী ১০ বছর সোনিয়াই 'সুপার পিএম' হিসেবে ইউপিএ সরকার চালিয়েছেন। সব গুরুত্বপূর্ণ ফাইল নাকি রেস কোর্স থেকে জনপথ ঘুরে সাউথ ব্লকে পৌঁছতো।
মনমোহন সিংহ আশা করেছিলেন একের পর এক অভিযোগে বিদ্ধ প্রধানমন্ত্রীর সঠিক মূল্যায়ন সমসামিয়ক মিডিয়ার থেকে ইতিহাসই একমাত্র ঠিক ভাবে করতে পারবে। সেই অভিযোগগুচ্ছের ডামাডোলে মৃদুভাষী, নীরব, দুর্বল, অন্যের হাতের পুতুল একজন প্রধানমন্ত্রীর নিরপেক্ষ মূল্যায়ন সত্যিই সম্ভব ছিল না।
কিন্তু আজ তাঁর মৃত্যুর পরে ফিরে তাকিয়ে দেখলে বোঝা যায়, মনমোহনীয় শাসনকাল আসলে ভারতীয় সংবিধানের মূলকেই রক্ষা করেছিল।
গণতন্ত্রের মূল ক্ষমতার উৎস জনগণ। তারাই ভগবান, ভূত ও ভবিষ্যৎ। যে গণতান্ত্রিক কাঠামোটি আমরা দেখি তা আসলে জনগণের প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা। কোটি কোটি নাগরিকের সবার মতামতের উপর ভিত্তি করে সব সিদ্ধান্ত নিতে গেলে তো বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। তাই ভোট, বিধায়ক-সাংসদ নির্বাচন ইত্যাদি। তাঁরাই জনগণের প্রতিনিধি। সেই প্রতিনিধিদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতাই প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
ভারতীয় সংবিধানের ৭৫ নম্বর ধারা অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী অন্যান্য মন্ত্রীদের বাছাই করে নেন। আর সেই ধারার ৩ নম্বর উপধারা বলছে, মন্ত্রিসভা 'সম্মিলিত দায়িত্বে' চলবে। প্রধানমন্ত্রী সব মন্ত্রীদের মতোই সমান, শুধু তিনি সবার আগে থাকেন।
ভারতীয় গণতন্ত্রের পরিহাস এই যে আমরা এই সব কথাকে তত্ত্ব বলে উড়িয়ে ব্যক্তি পূজায় বিশ্বাসী হয়ে উঠেছি। আমরা সেই 'লার্জার দ্যান লাইফ' হয়ে ওঠা নেতাকেই খুঁজি। যাঁর শক্তিশালী ইমেজটাকে আমরা খুব ভালবাসি। শুধু নরেন্দ্র মোদীকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী, অটলবিহারি বাজপেয়ী থেকে শুরু করে জয়ললিতা, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ব্যক্তিপুজো ভারতীয় গণতন্ত্রের সত্য।
সেই ব্যক্তিপুজোর অধিকারী হতে পারেননি মনমোহন। একজন আপাদমস্তক ভদ্র, শিক্ষিত, বুদ্ধিমান, পড়ুয়া প্রধানমন্ত্রীকে আমরা 'হিরো' হিসেবে দেখতে পাইনি। কারণ তিনি 'আমিত্বে' বিশ্বাস করেননি। তাঁর পিতৃপরিচয় বা বাল্যপরিচয় বড় হয়ে উঠেনি। তাঁর সাধারণ জীবনচর্যা প্রচারের আলোয় আসেনি। তিনি জননেতার মতো জনমোহিনী ভাষণ দিতে পারেননি নির্বাচনী জনসভায় গিয়ে। শুধু সবার উপরে নয়, তিনিই যে একমাত্র নায়ক — তা কোনওদিন প্রমাণ করার চেষ্টাই করেননি ১০ বছর ধরে দেশ চালানো একজন নেতা।
যতই বিতর্ক থাকুক, নিজের সরকারকে বাজি রেখে তিনি ২০০৮ সালে আমেরিকার সঙ্গে পরমাণু চুক্তি করতে দ্বিধা করেননি। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্রিকস, জি-২০র মতো একের পর এক গোষ্ঠীতে ভারতকে সামিল করেছেন। কিন্তু তা নিয়ে ঢক্কানিনাদ করতে হয়নি নিজেকে জাহির করার জন্য।
যা ভুল বা যা ঠিক, তা ভারতীয় সংবিধানের যৌথ দায়িত্বের মতো করেই তিনি পালন করেছেন। সেখানে প্রধানমন্ত্রী এক-নায়কে পরিণত হননি।
অনেকেই মনমোহন সিংহের দুর্বলতার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী না হয়েও সোনিয়া গান্ধী যে ভাবে ইউপিএ সরকারের উপর খবরদারি চালিয়েছেন তাকে এক করে দেখেন। জাতীয় উপদেষ্টা পর্ষদ তৈরি করে তার মাথায় বসে সোনিয়া গান্ধী ও তাঁর পার্ষদেরা ছড়ি ঘুরিয়েছেন মনমোহনের উপর। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, সোনিয়া এটি করেছেন পরিকল্পিত ভাবেই।
কিন্তু এই ব্যবস্থার একটি উপকারিতাও ছিল। পশ্চিমী ব্যবস্থায় শিক্ষিত মনমোহন ভারতীয় অর্থনীতির উদারীকরণের জনক ছিলেন। ১৯৯১ সালে তৎকালীন-অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাঁর হাত ধরেই ভারতীয় অর্থনীতির দরজা পুঁজিপতি পশ্চিমী দুনিয়ার জন্য খুলে গিয়েছিল। সেই সময়ের অর্থনৈতিক অবস্থার জন্য সেটিই হয়ত অন্যতম সঠিক পথ ছিল। কিন্তু সেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উপর মনমোহনের অগাধ বিশ্বাস ছিল। তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্বের সময় সরকারের ভিতরে ও বাইরে (যা এখনও বাস্তব) একটি পুঁজিবাদী-আমেরিকা-ঘনিষ্ঠ লবি সক্রিয় ছিল। সেই লবির সমর্থক ছিলেন মনমোহনও।
যে সরকারকে বামপন্থীরা সমর্থন করছে, যে কংগ্রেস সমাজতান্ত্রিক মতবাদকে একেবারেই ছুঁড়ে ফেলে দেয়নি, তার নেতৃত্ব চাইবেই যে একটি ভারসাম্য রক্ষা করার ব্যবস্থা থাকুক। জাতীয় উপদেষ্টা পর্ষদ সেই কাজটিই করেছে। যার ফল হল তথ্যের অধিকার আইন, ১০০-দিনের কাজের নিশ্চিতিকরণ আইন, শিক্ষার অধিকার আইন, বন সুরক্ষা আইন, শেষের দিকে জমি অধিগ্রহণ আইনের বদল। এই আইনগুলিই মনমোহন সিংহের জমানার মাইলস্টোন। আর দলীয় রাজনীতি ও শরিক-নির্ভর সরকারের ভারসাম্য রক্ষার দায়িত্ব তৎকালীন কংগ্রেস সভানেত্রীর উপরেই ছিল।
এছাড়াও ২০০৮ সালের বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার মাঝেও ভারতীয় অর্থনীতিকে রক্ষা করার কাজ করেছে মনমোহন সিংহের সরকার। তার পিছনে অবশ্য ভারতীয় রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাঙ্কের দৃঢ়তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
হ্যাঁ, তাঁর শাসনকালে কাশ্মীরের জঙ্গি-সমস্যা, মাওবাদী উগ্রপন্থা, মুম্বাইয়ের জঙ্গি হামলার মতো ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু তার জন্য দেশের সংখ্যালঘুদের এক ঘরে হতে হয়নি। বরং সংখ্যালঘুদের জন্য রঙ্গনাথ মিশ্র ও সাচার কমিটি তাঁর আমলেই তৈরি হয়েছে। তার সুপারিশ কার্যকর করার ক্ষেত্রে গড়িমসি হয়েছে ঠিকই কিন্তু তার জন্য সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সংখ্যাগুরুদের আধিপত্যবাদ মাথা চাড়া দেয়নি।
আরও পড়ুন- অর্থনৈতিক উদারীকরণের স্থপতি হিসেবে মনমোহন সিংকে মনে রাখবে দেশ
আসলে মনমোহন সিংহ আদতে একজন শিক্ষক ও আমলা ছিলেন। ফলে তাঁর পক্ষে নিজেকে জাহির না করে রাজনৈতিক 'বস্' সোনিয়া গান্ধীর কথা শুনে চলতে অসুবিধা হয়নি। তিনি রাজনীতিক ছিলেন না। কিন্তু যে রাজনীতিক-সোনিয়া ইউপিএ-র প্রধান হয়ে বসেছিলেন, তিনি শরিক দলের মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আসার পরেও তা ঠিক ভাবে সামলাতে পারেননি। যার দায়ভার মনমোহনকে নিতে হয়েছিল। তাই তাঁর সরকার দুর্নীতির অভিযোগে বিদ্ধ হওয়ায় মনমোহনকে বলতে হয়েছিল, শরিকি-রাজনীতির কারণে তিনি অনেক সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি।
এই রাহুল গান্ধীও ২০১৩ সালে সাজাপ্রাপ্ত জনপ্রতিনিধিকে বাঁচাতে মনমোহন সিংহ সরকারের আনা অর্ডিন্যান্সকে জনসমক্ষে ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন। তিনি তো কংগ্রেসেরই নেতা ছিলেন। দলের মধ্য়ে আলোচনার বদলে নিজের দলের প্রধানমন্ত্রীকেই সেদিন বিপাকে ফেলেছিলেন খোদ রাহুল। এই 'দুর্বলতার' দায় মনমোহনের উপরেই পড়েছিল।
কিন্তু মনমোহনই অবশ্য জোর গলায় বলতে পেরেছিলেন, তাঁকে নীরব প্রধানমন্ত্রী বলা হলেও তিনি কঠিন সময়েও মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করেননি। সৌজন্য বজায় রেখেই তিনি দৃঢ়তা দেখিয়েছেন বার বার। মিডিয়ার মালিক-সম্পাদকদের সামনে যখন মনমোহনের ইমেজ পুনরুদ্ধারের কাজ করছে প্রধানমন্ত্রীর দফতর, তখনকার একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করতেই হয়।
২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে দূরদর্শনে লাইভ সম্প্রচার চলাকালীন সব সম্পাদকদের 'গুডি গুডি' প্রশ্নের শেষে টাইমস নাউয়ের তৎকালীন প্রধান সম্পাদক অর্ণব গোস্বামী প্রশ্ন করে বসলেন অ্যানট্রিক্স-ডেভাস চুক্তি নিয়ে। মহাকাশ নিয়ে গবেষণার জন্য এই চুক্তিতে ভারতীয় আইন না মানার অভিযোগ ছিল খোদ প্রধানমন্ত্রীর দফতরের বিরুদ্ধে। অর্ণব সেই কথাই তুললেন। তখন প্রধানমন্ত্রী দফতরের অফিসারেরা বিব্রত। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ কিন্তু বিব্রত না হয়ে উত্তর দিয়েছেন তথ্য তুলে ধরে। টুজি কেলেঙ্কারি নিয়ে পরবর্তী প্রশ্ন করায় যখন প্রধানমন্ত্রীর দফতরের অফিসারেরা অর্ণবকে সৌজন্য দেখাতে পরামর্শ দিচ্ছেন, মনমোহন ধৈর্যের সঙ্গে উত্তর দিয়েছেন তাঁর কঠোরতম সমালোচককে।
তাঁর ১০ বছরের শাসনকালে মনমোহন সিংহ জননেতা বা তথাকথিত রাজনৈতিক নেতা বা একনায়ক হয়ে উঠতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু নিজের ও সংবিধানের মর্যাদা রক্ষা করেছেন একজন শিক্ষিত ও রুচিশীল ব্যক্তি হিসেবে। রাজনৈতিক অসৌজন্যতা কখনও তাঁর পরিচয় হয়ে ওঠেনি।
'আমিত্ব'কে দুরে সরিয়ে গণতান্ত্রিক ভারতের সংবিধানে উল্লেখিত 'যৌথ দায়িত্ব' পালনের মধ্যে দিয়ে তিনি যেমন দেশের সংবিধানের মর্যাদা রক্ষা করেছেন, তেমনই সেই যৌথ দায়িত্বের ব্যর্থতাতেই তিনি সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে দুর্নীতিবাজ সরকারের দুর্বল প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পরিচিত হয়ে গেছেন। তা অবশ্যই মনমোহনের যথাযথ মূল্যয়ন নয়।