চাপের মুখে ক্ষমতা ছাড়লেন জাস্টিন ট্রুডো! কেন ইস্তফা দিলেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী?

Justin Trudeau Resignation: সমীক্ষায় দেখা গেছে, কানাডার শুধুমাত্র ২২% নাগরিক ট্রুডোর নেতৃত্বে ভরসা রাখেন। ২০১৫ সালের পর থেকে গত নয় বছরে এত কম জনসমর্থন দেখা যায়নি।

পদত্যাগের কথা ঘোষণা করেছেন কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো। তিনি জানিয়েছেন, একই সঙ্গে পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ 'হাউস অফ কমন্স'-এ লিবারেল পার্টির পদ থেকেও ইস্তফা দিচ্ছেন। সোমবার কানাডার সংবাদপত্র 'দ্য গ্লোব অ্যান্ড মেল' -এ দাবি করা হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রীর পদ ও লিবারেল পার্টির নেতৃত্ব ছাড়তে চলেছেন জাস্টিন ট্রুডো। সোমবার সন্ধ্যায় ট্রুডো নিজেই ইস্তফার কথা জানান। ট্রুডো বলেছেন, "আমার কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, আমাকে যদি দলের অভ্যন্তরীণ লড়াই লড়তে হয়, তাহলে আগামী নির্বাচন লড়ার জন্য আমি সেরা বিকল্প নই। দেশকে তাদের সেরা নেতা বাছাই করার একটা সুযোগ দেওয়া দরকার।" এরই মধ্যে ট্রুডোর ইস্তফা নিয়ে জল্পনাও শুরু হয়েছে। কেন ট্রুডো ইস্তফা দিলেন? কোন চাপের মুখে পড়ে পার্টির নেতৃত্ব ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি? প্রশ্ন ওঠা শুরু হয়েছে যে, ট্রুডোর উত্তরসূরি কে হবেন?

পরপর দু'বার ট্রুডোর নেতৃত্বে দল নির্বাচনে জিতেছে। তাঁকে দেখেই জনগণ ভোট দিয়েছিল। ২০১৩ সাল থেকে তিনি লিবারেল পার্টির দায়িত্ব নিয়েছিলেন। দল তখন সংকটে ছিল। এমন পরিস্থিতি হয়েছিল যে, কানাডার 'হাউস অব কমন্সে' তৃতীয় স্থানে নেমে গিয়েছিল পার্টি। সেখান থেকে দলকে ক্ষমতায় এনেছিলেন লিবারেল পার্টির এই নেতা। ২০১৫ সালে তিনি কানাডার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসেন। টানা নয় বছর কানাডার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি। এখনও অবধি তিনিই কানাডার দীর্ঘসময়ের প্রধানমন্ত্রী। সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি জানিয়েছেন, পরিবার ও ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে তিনি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে পার্টির নতুন নেতা নির্বাচিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি দায়িত্বে থাকবেন।

আরও পড়ুন- ‘ডানকি রুটে’ আমেরিকায় ঢোকার নয়া শর্টকাট এখন কানাডা! যে বিপদের মুখে অসংখ্য ভারতীয়

এ বছর কানাডায় সাধারণ নির্বাচন। ২০ অক্টোবরের আগে নির্বাচন প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। এর জন্য দেশে বেশ কিছু সমীক্ষাও চালানো হয়েছিল। সমীক্ষায় দেখা গেছে, জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন ট্রুডো। বিবিসির তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বরের সমীক্ষায় দেখা গেছে, কানাডার শুধুমাত্র ২২% নাগরিক ট্রুডোর নেতৃত্বে ভরসা রাখেন। ২০১৫ সালের পর থেকে গত নয় বছরে এত কম জনসমর্থন দেখা যায়নি। বলে রাখা ভালো, দেশের অন্দরেই নানা কারণে কোণঠাসা ছিলেন তিনি। অর্থাৎ তিনি যদি এবারেও পার্টির নেতৃত্বে থাকেন, তাহলে দল নির্বাচনে হেরে যেতে পারে। এর জন্য নিজের দলের থেকেও বেশ চাপে ছিলেন তিনি। এছাড়াও দেশের আর্থিক অবস্থা নিয়ে সমস্যায় ছিলেন ট্রুডো। অন্যদিকে, কিছুদিন আগে পদত্যাগ করেন কানাডার অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড। তাঁর পদত্যাগ থেকেই ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছিল।

ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড

সোমবার ট্রুডো ক্রিস্টিয়ার প্রশংসা করেছেন ঠিকই কিন্তু ক্রিস্টিয়ার পদত্যাগের জন্য ট্রুডোকেই দায়ী করা হচ্ছে। ট্রুডোর সঙ্গে মতবিরোধের জন্যই ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড পদত্যাগ করেছিলেন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তিন সপ্তাহ আগে পদত্যাগ করেছিলেন তিনি। জানা যাচ্ছে, ক্রিস্টিয়াকে অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন ট্রুডো। এবং তাঁকে দফতরহীন মন্ত্রিত্বের পদ দিতে চেয়েছিলেন। ক্রিস্টিয়া সেই প্রস্তাব মানেননি। পরে ক্রিস্টিয়া পদত্যাগ করলে, ট্রুডো অর্থমন্ত্রীর পদ দেন তাঁর বিশ্বস্ত সহকর্মী ডমিনিক লেব্রুঁকে। এতে শাসক শিবিরের মধ্যেই বিতর্কের জন্ম হয়েছিল।

উল্লেখ্য, দ্বিতীয়বার আমেরিকার প্রেসিডেন্টের কুর্সিতে বসার আগেই ডোনাল্ড ট্রাম্প কানাডার বিরুদ্ধে মাশুল বসানোর ঘোষণা করেছিলেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটা সত্যি হলে কানাডার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও ভেঙে পড়বে। বিবিসির সংবাদদাতা জেসিকা মারফি বিবিসিতে বলেছেন, "কানাডায় রাজনৈতিক অস্থিরতা এমন একটা সময় দেখা দিল যখন দেশটি অর্থনৈতিক কয়েকটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে চলেছে, যার মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য কারণ হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প শপথ নিতে চলেছেন আগামী ২০ জানুয়ারি।" তাঁর কথায়, "ট্রাম্প বলেই দিয়েছেন, কানাডা যদি অনুপ্রবেশকারীদের এবং বেআইনি মাদক আমেরিকায় প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ না করতে পারে তাহলে কানাডা থেকে আসা পণ্যের উপরে তিনি ২৫% কর আরোপ করবেন। এই পরিমাণ কর কানাডার অর্থনীতিকে শেষ করে দিতে পারে।"

আরও পড়ুন- কানাডাতেই কেন আশ্রয় নিলেন শিখেরা?

কানাডার সংসদ অধিবেশন ২৪ মার্চ পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে। জানা যাচ্ছে, এই সময়কালের মধ্যে লিবারেল পার্টির নতুন নেতা নির্বাচন করা হবে। মূলত রাজনৈতিক সংকট দেখা দিলেই সংসদ অধিবেশন স্থগিত করা হয়। ২০২০ সালে সংসদ অধিবেশন স্থগিত করেছিলেন ট্রুডো। এতে সংসদ না ভেঙে দেশে ভোটাভুটির মতো বিষয়গুলি বন্ধ রাখা যায়। কোন প্রক্রিয়ায় দলে নতুন নেতা বাছাই করা হবে সেটি এখনও স্পষ্ট নয়। সাধারণত দেখা গিয়েছে, দলগুলি চার-পাঁচ মাস লম্বা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে নেতা নির্বাচন করে থাকে। একটি আনুষ্ঠানিক সম্মেলনও করা হয়। এবার সময় কম। তবে নেতা বাছাইয়ের প্রক্রিয়া যে প্রতিযোগিতামূলক হবে, সোমবারই ট্রুডোর ভাষণে সেই ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে। যিনি দেশটির লিবারেল পার্টির প্রধান হবেন, তিনিই দেশটির প্রধানমন্ত্রীও হবেন। ট্রুডোর উত্তরসূরি কে হবেন, তা এখনও জানা যায়নি। তবে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে থেকে কিছু জনের নাম উঠে এসেছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন ট্রুডোর সরকারের প্রাক্তন উপপ্রধানমন্ত্রী তথা অর্থমন্ত্রী ক্রিস্টিয়া ফ্রিল্যান্ড, পরিবহনমন্ত্রী অনিতা আনন্দ এবং কানাডার কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের সাবেক কর্মকর্তা মার্ক কারনি। ট্রুডোর পর যিনি দলের প্রধানের দায়িত্ব নেবেন, তিনি আসন্ন নির্বাচন পর্যন্ত দায়িত্বে থাকবেন।

উল্লেখ্য, ট্রুডোর বিরুদ্ধে 'ভারত-বিরোধী' মনোভাবের অভিযোগ রয়েছে। ট্রুডোর আমলে নয়াদিল্লি আর কানাডার সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে। সম্পর্ক তিক্ত হয় খালিস্তানি নেতা নিজ্জর হত্যাকাণ্ড থেকে। গত বছর সংসদে দাঁড়িয়েই কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো অভিযোগ তুলেছিলেন, হরদীপ সিং নিজ্জরের হত্যার ঘটনায় ভারতের সংযোগ রয়েছে। ২০২৪ সালের মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ট্রুডো নিজ্জর হত্যা মামলায় 'ভারতের সরকারের এজেন্টদের' জড়িত থাকার অভিযোগ করেন। ভারত এ অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছিল।এছাড়া বিগত কয়েক বছরে নানা বিতর্কে বারবার ট্রুডোর নাম সামনে আসছিল। এখন দলের সংসদ সদস্যরাই তাঁর ইস্তফার দাবি করেছেন বলে জানা যাচ্ছে। গত কয়েক বছরে তাঁর জনপ্রিয়তা অনেকটাই কমেছে। তার অন্যতম কারণ মূল্যবৃদ্ধি এবং আবাসন সংকট। এখন সময়ই বলবে, ট্রুডোর উত্তরসূরী কে হবেন?

More Articles