বাংলা-উড়িষ্যার দ্বন্দ্বে বারবার আক্রমণের শিকার হয়েছে এই মন্দির

উপাসনাগৃহ হামলার ঐতিহ্য অনেক পুরনো। বিশেষত মন্দিরগুলির সম্পদের প্রাচুর্যের জন্য বারবার মন্দির আক্রমণ হয়েছে। পুরীর জগন্নাথ মন্দির অন্যতম বিখ্যাত মন্দির। অন্যান্য সকল মন্দিরের মতো জগন্নাথ মন্দিরও রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতা পেত যথেষ্ট। সেই বিপুল ধনসম্পদ মন্দিরের মধ্যে মজুদ থাকত। বিগ্রহ থেকে শুরু করে যাবতীয় আয়োজন প্রতিদিন দেখভাল করতেন সেবায়েতরা। প্রচুর মানুষ উপাসনায় আসতেন। কাজেই উড়িষ্যা আক্রমণের কালে বারবার মন্দির যে আক্রান্ত হবেই, তা স্বাভাবিক। প্রথম আক্রমণ হয়ে গিয়েছে নবম খ্রিস্টাব্দে। রক্তবাহুর দাপটে সেবার মন্দির ছাড়তে হয়েছিলেন বিগ্রহরা। পরে অবশ্য তাদের মন্দিরে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রথম আক্রমণের প্রায় অর্ধশতাব্দী পরের ঘটনা। তখন বাংলার সুলতান ইলিয়াস শাহ। উড়িষ্যার মসনদে পূর্বগঙ্গা রাজবংশের রাজা তৃতীয় নরসিংহদেব।

স্বাধীন মুসলমান সালতানাতের ক্ষেত্রটিতে ইলিয়াস শাহের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। বিশেষত বাংলার ইতিহাসের সঙ্গে তাঁর নাম জড়িয়ে রয়েছে অঙ্গাঙ্গিভাবে। পূর্ব পারস্যের সিজিস্থানের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম ইলিয়াসের। দিল্লিতে তখন সুলতানি শাসন। প্রথম জীবনে দিল্লির অধিপতি ফিরোজের অধীনে চাকরি করেছেন। সেখানে কোনও এক অপরাধে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। ধরা পড়ার ভয়ে দিল্লি ছেড়ে বাংলায় পালিয়ে আসেন। তখন সাতগাঁওয়ের তুঘলকি শাসনকর্তা ইজ্জউদ্দিন ইয়াহিয়া। তাঁর অধীনে চাকরি নেন ইলিয়াস। ধীরে ধীরে আপন কর্মবলে মালিক পদাধিকারী হন। ১৩৩৮ খ্রিস্টাব্দে ইজ্জউদ্দিন ইয়াহিয়া মারা গেলেন। ইলিয়াস সাতগাঁওয়ের শাসক হয়ে উঠলেন। নিজের ক্ষমতা সুনিশ্চিত করার পরে লখনউতির আলাউদ্দিন আলি শাহ-এর সঙ্গে তাঁর বিরোধ হয়। ফলস্বরূপ এক দীর্ঘ যুদ্ধের অবতারণা। শেষ পর্যন্ত জয়ী হন এবং সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস উপাধি গ্রহণ করেন। ১৩৪২ খৃস্টাব্দে লখনউতিও পাকাপাকিভাবে ইলিয়াস শাহ-র সাম্রাজ্যের মধ্যে চলে আসে।

লখনউতিতে শাসনের ভিত একটু মজবুত হলে ইলিয়াস আবার রাজ্যবিস্তারে মনোযোগী হন। ক্ষমতার নেশা তখন তাঁকে পেয়ে বসেছে। ১৩৪৪ খ্রিস্টাব্দে ত্রিহুত তাঁর রাজত্বের অন্তর্ভুক্ত হয়। এরপরে নেপালের দিকে এগোন ইলিয়াস। ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দে তরাই অঞ্চলের মধ্য দিয়ে কাঠমাণ্ডু অবধি এগিয়ে যায় ইলিয়াসের বাহিনী। সালতানাতের কোনও বাহিনীই এতদূর অগ্রসর হতে পারেননি। কাঠমাণ্ডুর স্বয়ম্ভু মন্দির ধ্বংস করে সেখানকার বিপুল ধনসম্পদ নিয়ে রাজ্যে ফেরেন তাঁরা। যদিও নেপালের দিকে রাজ্য বিস্তারের চেষ্টা তাঁর দেখা যায় না। এরপরে পূর্ব বাংলার দিকে এগোন ইলিয়াস। ইখতিয়ারউদ্দীন গাজী শাহকে পরাজিত করে ১৩৫২-তে সোনারগাঁও দখল করেন। ফলত, বাংলার তিনটি প্রধান সুবেই তাঁর করায়ত্ত হয়। এবং সমগ্র বাংলার অধিপতি হিসাবে ‘শাহ-ই-বাঙ্গলাহ’, ‘শাহ-ই-বাঙ্গালিয়ান’ ও ‘সুলতান-ই-বাঙ্গালাহ’ বিশেষণে তাঁকে ভূষিত করেন শামস-ই-সিরাজ। ইলিয়াসই প্রথম সাতগাঁও, লখনউতি ও সোনারগাঁও একত্র করে এই অঞ্চলে স্বাধীন সালতানাত প্রতিষ্ঠা করেন ও ‘বাঙ্গালাহ’ নামকরণ করেন।

আরও পড়ুন: বারবার আক্রান্ত হয়েছে জগন্নাথ মন্দির, কিন্তু অক্ষত থেকেছেন দেবতা

ইলিয়াসের প্রভাব-প্রতিপত্তি নেহাত কম ছিল না। স্বয়ং ফিরোজ শাহ তুঘলক তাঁর সঙ্গে যুদ্ধে জিতে উঠতে পারেননি। সন্ধি করতে বাধ্য হন। একের পর এক জয়ে উৎসাহিত হয়ে জাজনগর (উড়িষ্যা) আক্রমণ করেন ইলিয়াস। সেই পথেই জয়পুর ও কটকের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে চিল্কা হ্রদ পর্যন্ত পৌঁছন। সেই সময় উড়িষ্যার সম্রাট তৃতীয় নরসিংহদেব। তাঁর আমলে রাজ্যের উত্তরদিকের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ছিল খুবই দুর্বল। ইলিয়াস তার সুযোগ নিলেন। রাইবানিয়া দুর্গের সেনাদের মধ্যে তেমন বোঝাপড়াও ছিল না। ঘুষ দিয়ে দুর্গের সেনাধিপতিদের হাত করে ফেললেন ইলিয়াস। সেই সময় ইলিয়াসের যা ক্ষমতা, নরসিংহদেব বুঝে গিয়েছিলেন, তাঁর হার নিশ্চিত। ফলে রানিদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল সীমাচলমের কাছে গিরিদুর্গা নামক স্থানে। নিজে একবার শেষ চেষ্টা করলেন বটে, কিন্তু সেই বিপুল সেনাস্রোতের কাছে নরসিংহদেবের অসংগঠিত প্রতিরোধ খড়কুটোর মতো ভেসে গেল। তার ওপর অতর্কিতে আক্রমণ করলেন ইলিয়াস। লুঠ হয়ে গেল ফের পুরীর মন্দির। যাবতীয় সম্পত্তি। রাজা কিছুই বাঁচাতে পারেন না। তবে ত্রিমূর্তি লুকিয়ে ফেলেন কোনও অজ্ঞাত জায়গায়। ফলে এবারও বিগ্রহের কোনও ক্ষতি হয় না। ৪৪টি হাতি সহ প্রচুর ধনসম্পদ নিয়ে ফিরে আসেন ইলিয়াস শাহ।

তবে এই যুদ্ধ কোনও আকস্মিক বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। উড়িষ্যা ও বঙ্গের রাজাদের মধ্যে যুদ্ধ তখন লেগেই থাকত। এই ঘটনার কয়েক দশক পূর্বেই লখনউতি আক্রমণ করেন বাংলার তৎকালীন সুলতান ফকর-উল-মুল্ক-কারিমুদ্দিন-লাঘরিকে হত্যা করেন উড়িষ্যার রাজা প্রথম নরসিংহদেব। পরে দিল্লি থেকে বাংলা পুনরুদ্ধারের জন্য প্রচুর সেনা পাঠানো হলে ওড়িয়া সেনারা বাংলা ছেড়ে সরে আসে। এই ঘটনার পরম্পরাতেই একরকম ইলিয়াসের উড়িষ্যা আক্রমণ। তখন প্রথম নরসিংহদেবের গড়ে তোলা সেই বিরাট সাম্রাজ্যের অবস্থা অত্যন্ত সঙ্গিন। এই কারণেই তৃতীয় নরসিংহদেব শুধু ক্ষমতাচ্যুতই হননি, মন্দিরও রক্ষা করতে পারেননি। পুরীর মন্দির এরপরেও বহুবার আক্রান্ত হয়েছে। এই বাংলা ও উড়িষ্যার দ্বন্দ্ব সেই ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থান অধিকার করে রয়েছে। উড়িষ্যার পূর্বগঙ্গা রাজবংশ এই ঘটনার পরে আরও দুর্বল হয়ে পড়েছিল।

More Articles