অশরীরীদের উপদ্রবে এই স্টেশনে আজ ট্রেন থামে না প্রায় পঞ্চাশ বছরের বেশি সময়
ঠিক যেন কোন ভৌতিক সিনেমা কিংবা কোন ধারাবাহিকের প্লট। সারাদিন ধরে একটার পর একটা ট্রেন এই স্টেশনের বুকের উপর গিয়ে চলে যায় কিন্তু সেই ট্রেনগুলো আর থামে না। আপনাদের শুনে মনে হতেই পারে এসব একেবারে আজগুবি কথাবার্তা। কিন্তু আজ প্রায় পঞ্চান্ন বছর ধরে পুরুলিয়ার বেগুনকোদর স্টেশনের এই অবস্থাই বহাল রয়েছে। ইন্টারনেট খুললেও দেখা যায়, পৃথিবীর ভুতুড়ে রেলস্টেশনগুলোর মধ্যে অন্যতম স্বান কেড়েছে এই পরিত্যক্ত স্টেশনটি। এমনকি পুরুলিয়ায় যারা ভ্রমণ করতে আসেন তারা অন্তত একবার ঘুরে দেখে যান স্টেশনটিকে।
পুরুলিয়ার ঝালদা এবং বেগুনকোদর শহরের মধ্যে রেলযোগাযোগ পরিচালনা করে এই স্টেশনটি। পুরুলিয়া থেকে ৪২ কিমি দূরে অবস্থিত একটি হল্ট স্টেশন হল এই বেগুনকোদর। অযোধ্যা পাহাড়ের সুন্দর প্রাকৃতিক পরিবেশের মধ্যে ছোট্ট একটি স্টেশন কিন্তু এই স্টেশনকে ঘিরেই গোটা গ্ৰামবাসীর মনে জন্ম নিয়েছে অশরীরীর আতঙ্ক। শোনা যায়, বহুবছর আগে এই স্টেশনে, স্টেশনমাষ্টার হয়ে থাকতে আসেন এক ভদ্রলোক এবং সঙ্গে আসেন তাঁর স্ত্রীও। কিন্তু হঠাৎ একদিন রাত্রিবেলা স্টেশনমাষ্টার দেখতে পান দূর থেকে একটা সাদা শাড়ি পরা কঙ্কাল যেন তাঁরই দিকে এগিয়ে আসছে, আশঙ্কা করা হয় রেল দুর্ঘটনায় তার মৃত্যু হয়েছিল। এই ঘটনার পরেই রহস্যজনকভাবে সেই মাষ্টার এবং তাঁর স্ত্রীয়ের মৃত্যু ঘটে এবং কিছুদিন পর তাঁদের দেহ উদ্ধার করা হয় পাশের এক কুঁয়ো থেকে। অনেকে বলেন তাদের দুজনকেই খুন করা হয়েছিল। এই ঘটনার পর থেকেই নাকি স্টেশনে শুরু হয় অশরীরীদের উপদ্রব। এরপর সমস্ত রেলকর্মীরা পালিয়ে যান স্টেশন ছেড়ে, কর্মীর অভাবে বাধ্য হয়েই বন্ধ করতে হয় রেল পরিসেবা। অথচ এই বেগুনকোদর স্টেশন একদিন অন্তত জমজমাট ছিল, ট্রেনে নিয়মিত যাতায়াত ছিল অসংখ্য যাত্রীর। এই স্টেশনকে কেন্দ্র করেই সংলগ্ন এলাকায় গড়ে উঠেছিল একটি ছোট্ট বাজারও। ওই অঞ্চলের বাসিন্দাদের কথায়, স্টেশনে নাকি সন্ধ্যা হলেই হঠাৎ হঠাৎ নানা আলো জ্বলে উঠতে দেখা যায়, অথবা দূর থেকে ভেসে আসে বিভিন্ন ভৌতিক সব আওয়াজ। চারিদিকে বিকট গন্ধ ছড়ায়। রাতেরবেলা তো বটেই দিনেরবেলাতেও মানুষজন স্টেশন চত্বরে সচরাসর পা রাখতে সাহস করেন না। কেবলমাত্র বেগুনকোদর স্টেশন নয়, অনেকে আবার বলেছেন গ্ৰামের ভিতরেও নাকি অশরীরীদের দেখা মেলে। হঠাৎ করেই কেউ নাকি কানের পাশে ফিসফিসিয়ে চলে যায় কিংবা পথ চলতি মানুষদের যেন কেউ ধাক্কা দেয়, কিন্তু মুখ তুললে আশেপাশে কাউকেই দেখা যায় না। পাকা ইমারতের স্টেশন বিল্ডিং, রেল কোয়ার্টার্স সব পরে থাকে সেভাবেই, লোকের অভাবে আর রেল থামে না। ১৯৬৭ সাল থেকে ২০০৯ সাল, প্রায় ৪২ বছর এভাবেই কাটে গেছে।
কিন্তু এই আতঙ্কের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্ৰস্ত হয় সাধারণ মানুষেরা। এই লাইনে ট্রেনের পরিষেবা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তাই বহুকাল এই অচল অবস্থা বহাল থাকার পরে মানুষেরা আন্দোলন শুরু করেন এবং বহুবছর পরে ২০০৯ সালে বামফ্রন্ট সরকার পুনরায় স্টেশনটি সচল করার প্রয়াস করেন। বামফ্রন্টের প্রাক্তন সাংসদ বাসুদেব আচার্যের নেতৃত্বে রেল পরিষেবা পুনরায় চালু হয়। তাঁর কথায়, ভূতের গল্প ইচ্ছাকৃতভাবেই সৃষ্টি করা হয়েছিল। তিনি আরও বলেছিলেন আসলে গ্ৰাম থেকে অনেক দূরে স্টেশনটির অবস্থান হওয়ায় বেশিরভাগ মানুষই কাজ করতে আসতে চাইতেন না সেখানে। অতঃপর ২০১০ সালে খুলল বেগুনকোদর রেলস্টেশন। পুরোনো বাড়ি আবার রং করে খুলে দেওয়া হয়, স্টপেজ দেওয়া হয় তিনটি প্যাসেঞ্জার ট্রেনের। কিন্তু অবস্থার পরেও বিশেষ পরিবর্তন চোখে পড়ে না। বর্তমানে বিকেল ৫.৫০ মিনিটে একটি ট্রেন দাঁড়ায় স্টেশনে। সকালবেলা যাও টুকটাক লোক দেখা যায়, সন্ধ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আবারও স্টেশন চত্বর পরিণত হয় শ্মশানে।
এই ঘটনার সত্যতার খোঁজে ২০১৭ সালে বিজ্ঞানমঞ্চের কিছু সদস্য হাড়-হিম শীতের তোয়াক্কা না করেই একদিন সন্ধ্যায় ঘাঁটি গেড়েছিলেন স্টেশন চত্বরে। সঙ্গে ছিল রেল ও স্থানীয় পুলিশ । সারারাত অপেক্ষা করার পরেও কোন ভূতের দেখা মেলে না। আপাদমস্তক চাদরে মোড়া দুই ট্রাকম্যানের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটেছিল তাঁদের । তবে ঘটনার মোড় ঘোরে ভোর ৪টে নাগাদ। হঠাৎই বাতাসে ভেসে আসতে থাকে দুর্গন্ধ। দূর থেকে জ্বলতে দেখা যায় লাল আলো, একসঙ্গে ডেকে ওঠে সেখানে থাকা অজস্র কুকুর। কিন্তু এই ঘটনার পরেই বিজ্ঞানমঞ্চের সদস্যরা সেই গন্ধ এবং আলোর অভিমুখে চলতে শুরু করেন এবং কিছুক্ষণ পরেই রীতিমতো তাড়া করেন ঝোপের আড়ালে থাকা কিছু মানুষকে। না , কোন ভূতের দেখা মেলেনি এই কথা ঠিক কিন্তু ঝোপের মধ্যে উদ্ধার করা গেছে বিভিন্ন মাদকদ্রব্য এবং তাস। এরপরেই স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠেছিল তবে কি কেবলমাত্র অসামাজিক বিভিন্ন কাজ নির্বিঘ্নে ঘটানোর জন্য এতগুলো বছর ধরে পরিকল্পনা করে রটানো হয়েছিল এই অশরীরীর গল্প? যদিও আজও এই রহস্য কেবল রহস্যই থেকে গেছে।
তথ্যসূত্র-
1. https://puruliatravels.blogspot.com/2017/05/blog-post.html
3.https://bengali.news18.com/news/south-bengal/shocking-facts-about-begunkodor-station-161839.html
4. https://thebengalstory.com/know-what-happened-at-the-mysterious-begunkodar-station/