সিপাহি বিদ্রোহে ব্রিটিশদের নাকানিচোবানি খাইয়েছিলেন এই আফ্রিকান নারী

Sepoy Mutiny: শুধুমাত্র দলিত হওয়ার কারণে সিপাহি বিদ্রোহের উচ্চবর্ণের ইতিহাসের আড়ালে চাপা পড়ে গেছেন এই আফ্রিকান নারী।

সিপাহি বিদ্রোহ সম্পর্কে ইতিহাসবিদদের দাবি ছিল, এটি কেবল দেশীয় রাজা ও নবাবদের ক্ষমতা ধরে রাখার মরিয়া চেষ্টা। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন ভূস্বামী জমিদার, সেনাদের একাংশ ব্রাহ্মণরা ও কিছু তৎকালীন বিদ্বজ্জন। সমাজের একদম নিচের দিকে তাঁদের নজরই পড়েনি। ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ, আর অযোধ্যার বেগম হজরত মহল ছাড়া নারীদের ভূমিকার তো প্রশ্নই নেই। সেই সময়ের নারীদের ভূমিকা কার্যত অনুল্লিখিতই রয়ে গিয়েছে।

১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল দলিত নারীরা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। সিপাহি বিদ্রোহে নারীর প্রসঙ্গ উঠলেই রানি লক্ষ্মীবাঈয়ের কথা জনমানসে আলোচিত হলেও দলিত হওয়ার কারণে এমন অনেক বীরাঙ্গনার নাম প্রকাশ্যে আসে না সেভাবে। তেমনই এক বীরাঙ্গনা ছিলেন এক আফ্রিকান নারী, যিনি লখনউতে সিকান্দার বাগে ব্রিটিশদের সঙ্গে যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। যুদ্ধক্ষেত্রে মৃত্যুর আগে বত্রিশ জন ব্রিটিশ সৈন্যকে হত্যা করেছিলেন তিনি। অসমসাহসী সেই দলিত বীরাঙ্গনার নাম বা পরিচয় আজ অবধি কিছুই জানা যায়নি।

১৮৫৭ সালের শরৎকাল নাগাদ উত্তর ভারতজুড়ে তৈরি হয়েছিল প্রবল বিশৃঙ্খলা আর নৈরাজ্য। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে রোষের আগুন ধিকিধিকি জ্বলছিল। দিল্লি, ঝাঁসি আর কানপুরের ভারতীয়রা তখন উন্মত্ত হাতির মতো ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে যেন সুযোগ এলেই প্রবল বিস্ফোরণে ফেটে পড়বে তারা। লখনউতে গোমতী নদীর ধারে বাড়িগুলিতে ব্রিটিশ সেনার ছোট একটি দল তখন প্রাণ হাতে নিয়ে ভারতীয়দের পরাস্ত করার জন্য অপেক্ষমান। ১৮৫৭ সালের সমগ্র গ্রীষ্মকাল জুড়ে তারা বিক্ষুব্ধ ভারতীয়দের মাঝে কোনও মতে প্রাণ বাঁচিয়ে থেকেছিল। যে কোনও মুহূর্তে উন্মত্ত ভারতীয়দের হাতে তাদের প্রাণনাশ হতে পারত। নভেম্বর মাসে ব্রিটিশ সেনাধ্যক্ষ কলিন ক্যাম্পবেল শত্রুর সীমানা অতিক্রম করে অনুপ্রবেশ করেন এবং সেখানকার বন্দি সেনাদের উদ্ধার করেন। গোমতী নদীর দক্ষিণ পাড় ধরে ক্যাম্পবেলের নির্দেশে তিরানব্বইতম ব্রিটিশ হাইল্যান্ড রেজিমেন্টের সৈন্যরা সিকান্দার বাগ প্রাসাদের দিকে এগিয়ে আসে ক্রমশ। ব্রিটিশদের অগ্রসর হতে দেখে ভারতীয় বিক্ষোভকারীরা যুদ্ধ শুরু করে দেয়। সেই যুদ্ধে প্রায় দু'হাজার লোক মারা যায়, যার মধ্যে ভারতীয় এবং ব্রিটিশ সৈন্য উভয়ই ছিল। লখনউয়ের এই প্রত্যক্ষ সংগ্রাম সিপাহি বিদ্রোহের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়।

আরও পড়ুন: বিধানসভায় বোমা ছোড়া থেকে সিনেমার গল্প লেখা! বটুকেশ্বর দত্তকে ভুলে গেছে বাঙালি

সিকান্দার বাগ আক্রমণ করেছিলেন ব্রিটিশ সেনাপতি ক্যাম্পবেল। তিনি দলিত নারীদের বাহিনীর আক্রমণের মুখে পড়েছিলেন। এই নারী-যোদ্ধাদের নিয়ে লোকমুখে প্রচলিত আছে-

‘কোই উনকো হাবসি কেহতা, কো-ই কেহতা নীচ অদ্ভুত।
অবলা কোই উনহে বাতলায়ে, কোই কাহে উনহে মজবুত’।

(কেউ তাদের বলে কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান নারী, কেউ বলে অদ্ভুত। কেউ বলে তারা দুর্বল, আর কেউ বলে তারা বীর)।

সিকান্দার বাগ

১৯১০ সালে উইলিয়াম ফোর্বস মিচেলের লেখা ‘গ্রেট বিদ্রোহ ১৮৫৭-'৫৯'-এ এই দলিত আফ্রিকান নারী সম্বন্ধে সংক্ষেপে কিছু বলা হয়েছে। তিনি বলেছেন, ১৮৫৭-র জুন থেকে নভেম্বর অবধি চলে অবরোধ। দিনটা ছিল ১৬ নভেম্বর। সিকান্দার বাগের রাস্তা ধরে ব্রিটিশ সেনারা এলে কিছু বুঝে ওঠার আগেই কোনও এক অতর্কিত শব্দহীন আক্রমণে সেনারা একে একে মাটিতে লুটিয়ে পড়তে থাকল। একাই সংহার করলেন ৩২ জন (কারও কারও মতে ৩৬ জন) ব্রিটিশ সেনা। ব্রিটিশ সেনানায়করা বুঝতেই পারছিলেন না, গুলি আসছে কোথা থেকে।

যুদ্ধ চলাকালীনই এক অফিসার লক্ষ করেন যে, বেশিরভাগ ব্রিটিশ সৈন্যই গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাচ্ছেন এবং সেই গুলির গতিপথ অনেকটা ওপর থেকে নিচে নেমে আসছে যেন। আর এই সন্দেহ হওয়ামাত্রই সতর্ক দৃষ্টিতে চারপাশে দেখতে দেখতে গাছের মাথায় একটি বন্দুক লক্ষ করেন ব্রিটিশ অফিসার। সেই বন্দুক লক্ষ করে গুলি চালানো মাত্র এক বিপ্লবীর গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ গাছ থেকে পড়ে যায়। পরে অনুসন্ধানের সময় দেখা যায়, সেই বিপ্লবীই আসলে ছদ্মবেশী আফ্রিকান নারী। শোনা যায়, ব্রিটিশ অফিসার ক্যাম্পবেলও তাঁর সাহসিকতায় মুগ্ধ হয়ে মাথা নত করেছিলেন তাঁর মৃতদেহের সামনে। উইলিয়াম ফোর্বস মিচেলের লেখা ‘রেমিনিসেন্সেস অফ দ্য গ্রেট মিউটিনি’ বই থেকে জানা যায় যে, সেই বীরাঙ্গনার কাছে একজোড়া পুরনো মডেলের পিস্তল ছিল যার মধ্যে একটি তাঁর বেল্টে গুলিপূর্ণ অবস্থায় রাখা ছিল, আর তাঁর হাতে থাকা পিস্তলে অর্ধেক গুলিভরা ছিল, যা গাছে ওঠার আগে পর্যন্ত ভর্তি ছিল বলেই অনুমান করা হয়, তা না হলে এত সৈন্যকে হত্যা করতে পারতেন না তিনি।

পরে সিকান্দার বাগের নিহত সৈনিকদের দেহ সনাক্ত করতে গিয়েও অনেক হিন্ধু, মুসলমান ও দলিত হাবসি নারীর লাশ পাওয়া যায়। সিকান্দর বাগের সেই যুদ্ধের বর্ণনায় ডব্লিউ গর্ভন আলেকজান্ডার লিখেছেন, "এমনকী, ওখানে মরদেহের মধ্যে কিছু আমাজনের নিগ্রোর লাশও পাওয়া যায়, যাদের শুয়োর বা অন্য কোনও প্রাণীর চর্বিমেশানো কার্তুজ ব্যবহারে সমস্যা ছিল না। এরা ধর্মে মুসলমান হলেও রাইফেল নিয়ে লড়ছিলেন। হিন্দু আর মুসলমান সেনাদের হাতে ছিল তলোয়ার। ওরা লড়ছিলেন জংলি বাঘের মতো ক্ষিপ্রতায়।" তাঁদের মৃত্যুর পর সিকান্দার বাগ দখলের ভয়াবহ যুদ্ধে সেই নারীর ভূমিকা প্রসঙ্গে লিখেছেন, "গাছের ওপর যেখান থেকে তিনি গুলি চালাচ্ছিলেন, সেই জায়গাটিও বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে নির্বাচন করে সুরক্ষিত করা হয়েছিল।"

তাহলে কীভাবে এই আফ্রিকান মহিলা ভারতে এলেন?
আরব দাস-ব্যবসায়ীরা ভারতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আফ্রিকান দাসদাসী আমদানি করেছিল ভারতীয় দাস ব্যবসায়ীদের সহযোগিতায়। ড. রোজির কথায়, "এটি বহু শতাব্দী ধরে চলছে, যেখানে পূর্ব আফ্রিকা থেকে পুরুষ, মহিলা এবং শিশুদের আনা হয়েছিল। তাই এটা সম্ভব যে, এই নামহীন মহিলা সৈনিক হয় সরাসরি আফ্রিকা থেকে এসেছেন বা আফ্রিকান পিতামাতার কাছে ভারতে জন্মগ্রহণ করেছেন। রাজা ওয়াজিদ আলি শাহ আফ্রিকান মহিলাদের এবং মিশ্র আফ্রিকান/ভারতীয় মহিলাদের পছন্দ করতেন এবং বেগম হযরত মহল নিজে ছিলেন একজন আফ্রিকান ক্রীতদাসের কন্যা।"

আবার অনেকে মনে করেন, ওয়াজিদ আলি শাহ-র অধীনে আওয়াধ বাহিনী ছিল হারশিয়ান পুল্টন বা ব্ল্যাক প্লাটুন নামে, যা আফ্রিকান সৈন্যদের নিয়ে গঠিত হয়েছিল। কিন্তু প্লাটুনে কোনও মহিলা থাকত না, তবে আমরা জানি, রাজার একজন মহিলা অশ্বারোহী দেহরক্ষী ছিল। ব্রিটিশ লেখকরা তাদের ‘আমাজন’– মহিলা সৈনিক হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এই নামহীন মহিলা প্রায় নিশ্চিতভাবে এই দলের একটি অংশ ছিল। রাজার সেনাবাহিনীতে একটি গুলাবি পুল্টনের উল্লেখ রয়েছে এবং সম্ভবত এটিই দেহরক্ষীর নাম ছিল। কারণ তার পরনের লাল জ্যাকেট এবং গোলাপি রঙের সিল্কের ট্রাউজার্সের বর্ণনা দেখেন তবে তা বোঝা যায়’।

ড. রোজি সম্প্রতি ‘ব্যাটলফিল্ড লখনউ’ নামে একটি অধিবেশনে এই নামহীন মহিলার অবদান নিয়ে আলোচনা করেছেন, তিনি বলেছেন, "দুর্ভাগ্যবশত, আমরা তাঁর সম্পর্কে জানি না এবং তিনি সম্ভবত সেই সময়ের অনেক অজ্ঞাত নায়কদের একজন‌।" তিনি আরও বলেছেন যে, "এটা খুবই লজ্জাজনক যে, আফ্রিকান পুরুষ এবং মহিলাদের সম্মতি ছাড়াই তাঁদের লখনউতে নিয়ে আসা হয়েছিল। এবং এখানে এসে তাঁরা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সাহসিকতার সঙ্গে লড়াই করেছিলেন, কিন্তু লখনউতে তাঁদের নিজস্ব কোনও স্মৃতিসৌধ নেই।"

শুধুমাত্র দলিত হওয়ার কারণে ঝলকারী বাঈ যেভাবে সিপাহি বিদ্রোহের উচ্চবর্ণের ইতিহাসের আড়ালে চাপা পড়ে গেছেন, দলিত এই আফ্রিকান নারীও তলিয়ে গেছে বিস্মৃতির অতলে।

More Articles