ইতিহাসে উপেক্ষিত রয়ে গেলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের যে শহিদ নারীরা

অনেক অজানা নাম আজও ইতিহাসের পাতায় লুকিয়ে আছে, যাঁরা দেশের জন্য প্রাণপাত করেছিলেন।

১৫ অগাস্ট, ২০২২, আমাদের দেশ স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্ণ করল। লালকেল্লা থেকে শুরু করে অজপাড়াগাঁয়েও, ছোটখাটোভাবে হলেও স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। স্মরণ করা হয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের। ভারতের স্বাধীনতা এমনি এমনি একদিনে হাতে আসেনি, তার জন্য করতে হয়েছে লড়াই, আর দীর্ঘ সংগ্রাম। কিন্তু দেখা গেল, যুদ্ধশেষের পর এমন অনেক সংগ্রামী নায়ক-নায়িকাকে ইতিহাস মনেই রাখেনি। শুধু যে এই স্বাধীনতা সংগ্রামে পুরুষরাই যোগদান করেছিলেন তা তো নয়, বহু নারীও শামিল ছিলেন। তেমন কিছু সংগ্রামীর কথা তুলে ধরা যাক, যাঁরা দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেছেন, যাঁদের আমরা ধীরে ধীরে ভুলতে বসেছি।

অনেকেই জানেন না যে, ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালির ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইংরেজ সাম্রাজ্যের শুরু থেকেই বাংলার মানুষ ভারতকে স্বাধীন করার জন্য আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বাংলার বিপ্লবীরাই হয়ে উঠেছিলেন আন্দোলনের মুখ এবং বাকি সব বিপ্লবীদের উৎসাহ।

মাতঙ্গিনী হাজরা
আঠারো শতকের পরাধীন ভারত। সেই সময় নারীরা থাকত পর্দার আড়ালে, সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র আর হেঁশেলের কাণ্ডারি হওয়াই ছিল তাদের নিয়তি। স্বামীর মৃত্যুতে তাদের সতী হতে হতো। কিন্তু এইসব নিয়ম-নীতিকে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছিলেন এমন এক নারী, যিনি ইংরেজ শাসকের অস্বস্তির কারণ হয়ে উঠেছিলেন। তিনি আর কেউ নন, আমাদের গান্ধীবুড়ি মাতঙ্গিনী হাজরা। তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, নারীর ক্ষমতা কতটা। মেদিনীপুরের এক কৃষক পরিবারে তাঁর জন্ম। মহাত্মা গান্ধীর ডাকে ভারত ছাড়ো আন্দোলন এবং অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। ছয় হাজার মহিলা স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে তমলুক থানা দখলের জন্য এক মিছিল বের করেন তিনি। শহরে মিছিল পৌঁছলে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু দমে যাননি, সব বাধা অগ্রাহ্য করে এগিয়ে যান ওই ৭৩ বছর বয়সি বৃদ্ধা। তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় ইংরেজ বাহিনী। তাঁর মোট তিনটি গুলি লাগে– একটি কপালে, আর দু'টি দুই হাতে। কিন্তু প্রাণ থাকতে জাতীয় কংগ্রেসের পতাকা হাত থেকে ফেলেননি। 'বন্দে মাতরম' ধ্বনি দিতে দিতে শহিদ হয়েছিলেন এই বীরাঙ্গনা। তাঁর আত্মত্যাগ আজও নারী সমাজকে অনুপ্রেরণা যোগায়।

আরও পড়ুন: শুধু দেশের মানুষ নয়, ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন ভারতে থাকা বিদেশিরাও

বেগম হজরত মহল
১৮৫৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধর আত্মা বলা হয় হজরত মহলকে। ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে একদিকে তিনি ছিলেন আপসহীন সংগ্রামের প্রতীক আর অন‍্যদিকে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যর প্রতিভূ। ১৮৫৭ সালে মহাবিদ্রোহে আওয়াধের নবাবকে ইংরেজরা নির্বাসিত করলে তিনি আওয়াধের ক্ষমতা নিজের হাতে তুলে নেন। তাঁর নেতৃত্বে আওয়াধবাসী ইংরেজশাসিত লখনউ শহর অবরুদ্ধ করে রেখেছিল, অবশ্য পরে তাদের পিছু হটতে হয়। শেষ পর্যন্ত আওয়াধেও ব্রিটিশ সরকার বিজয়ী হয়েছিল। কিন্তু হজরত মহল ছিলেন অপরাজিত, শত্রুর চক্রব্যূহ ভেদ করে পুত্রকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন নেপালে। কোনও প্রলোভন তাঁকে টলাতে পারেনি।

সেনাপতি বাপাত
স্বাধীনতা লাভের পর প্রথম স্বাধীন ভারতের পতাকা তোলার মর্যাদা পেয়েছিলেন এই নেতা। মুলসি সত্যাগ্রহের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তাঁকে সেনাপতি বলে ডাকা হতো। ইংরেজ সরকার তাঁর বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে সরকারের সমালোচনা এবং ভাঙচুর চালানোর অভিযোগ আনে। এই অভিযোগ ওঠার পর তিনি নিজেই আত্মসমর্পণ করেন ব্রিটিশ সরকারের কাছে। দীর্ঘদিন জেলেও কাটাতে হয়েছে তাকে।

পত্তি শ্রীরামুলু
গান্ধীর একনিষ্ঠ সমর্থক ও ভক্ত বলা যায় তাঁকে। গান্ধীর মানবতার আদর্শকে সামনে রেখে স্বাধীনতা সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েছিলেন তিনি। দেশ ও মানবতার প্রতি তাঁর এই নিষ্ঠা এবং কর্তব্যবোধ দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন গান্ধীজি। একবার গান্ধী নিজে শ্রীরামুলু সম্পর্কে বলেছিলেন, "আমার যদি শ্রীরামুলুর মতো আরও ১১ জন সমর্থক থাকত, তাহলে ১ বছরেই স্বাধীনতা অর্জন করতে পারতাম।"

তারা রানি শ্রীবাস্তব
তারা রানি ছিলেন ভারতের বিহারে জন্ম নেওয়া এক স্বাধীনতা সংগ্রামী। স্বামীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সিওয়ান থানার সামনে মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন তারা। ব্রিটিশের গুলিতে তাঁর স্বামী নিহত হলেও তিনি দমে যাননি। স্বামীর মৃত্যু তাঁকে আরও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে তুলেছিল। নিজের এলাকার নারীদের নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত করায় রানির অবদান ছিল অনস্বীকার্য। তিনি এমন সময় ভারতীয় নারীদের ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে শামিল করেছিলেন, যখন ভারতীয় নারীদের ঘরের বাইরে পা রাখাকে সমাজ বাঁকা চোখে দেখত। তিনিও তাঁর স্বামীর মতোই সংগ্রামের পথেই মৃত্যুবরণ করেন। শেষ মুহূর্ত অবধি তাঁর হাতে উঁচু করে ধরা ছিল স্বাধীন ভারতের তেরঙ্গা।

পীর আলি খান
১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বিভিন্ন অঞ্চলের বহু নেতা। বারাকপুরের মঙ্গল পাণ্ডে, ঝাঁসির রানি লক্ষ্মীবাঈ, কানপুরের তাঁতিয়া টোপি। কিন্তু এত সব নামের আড়ালে চাপা পড়ে গেছেন সেই মহান বিপ্লবী, যিনি একজন বই বিক্রেতা থেকে হয়ে উঠেছিলেন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। ইতিহাস তাঁকে ভুলে গেছে বলা চলে। তিনি পাটনার পীর আলি খান। তাঁর পেশাগত জীবন শুরু হয় বইয়ের দোকানদার হিসেবে। পরবর্তীকালে তাঁর এই দোকান হয়ে ওঠে বিপ্লবীদের গোপন আস্তানা এবং আশ্রয়স্থল। তাঁর দোকান থেকেই বিভিন্ন লিফলেট বা সাংকেতিকভাবে গোপনে তথ্য ও খবর পাঠানো হতো। ১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহের আঁচ পাটনায় এসে পৌঁছলে পীর আলি এই বিদ্রোহের নেতা হিসেবে এগিয়ে আসেন। বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেওয়ার অভিযোগে তাঁকে সবার সামনে ফাঁসি দেওয়া হয়। এক সাধারণ বইবিক্রেতা কীভাবে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়ে ভারতের স্বাধীনতার জন্য জীবন দিয়েছেন, তা ইতিহাসে এক অনন্য অধ্যায়কে সূচিত করে।

বীণা দাস
১৯১১ সালের ২৪ অগাস্ট কৃষ্ণনগরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বীণা দাস। তাঁর পিতা বেণীমাধব দাস ছিলেন একজন বিশিষ্ট সমাজসেবী। বাংলা তথা সারা দেশে ব্রিটিশ সরকারের দমনপীড়নের প্রতিবাদ জানাতে গভর্নর জ্যাকসনকে গুলি করে মারার সিদ্ধান্ত নেন তিনি। জানা যায়, খোঁপার ভেতর রিভলভার লুকিয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন তিনি। সেখান থেকেই তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। রিভলভার কীভাবে সংগ্রহ করেছে, সেকথা পুলিশ জানতে চাইলে তাঁর মুখ থেকে একটি কথাও বের হয়নি। ৯ বছরের কারাদণ্ড হলেও আদালতে নিজের মতামত আর লক্ষ্যের কথা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন তিনি। জেল থেকে বেরিয়েও আবার মুক্তি সংগ্রামে নিজেকে উজাড় করে দেন।

তিরুপুর কুমারণ
দেশবন্ধু ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তিনি। ১৯৩২ সালের ২১ জানুয়ারি এক মিছিলে তাঁকে গুলি করে হত্যা করে ইংরেজ সরকার। ভারতের জাতীয় পতাকা তখন নিষিদ্ধ ঘোষণা হয়েছিল, কিন্তু কুমারণ সেই পতাকা হাতেই মিছিল করতে নেমেছিলেন। মৃত্যুর পরও তাঁর হাতে সেই ভারতীয় পতাকা শক্ত করে ধরা ছিল।

বিরসা মুণ্ডা
মাত্র ২৫ বছর বয়সে প্রাণ হারান এই তরুণ যুবক। কিন্তু এই স্বল্প জীবনেই তিনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক আদিবাসী নেতা হিসেবে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছিলেন। তাঁর নেতৃত্বেই ব্রিটিশের বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়েছিল সাঁওতাল বিদ্রোহ। যা উনিশ শতকের শেষ ভাগে বর্তমান বিহার ও ঝাড়খণ্ড এলাকার সমস্ত আদিবাসী মানুষকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছিল।

দুকড়ি বালা দেবী
দুকড়ি বালা দেবী ছিলেন বিপ্লবী নিবারণ ঘটকের মাসি। নিবারণ মাঝে মাঝে বিপ্লবীদের তাঁর মাসির বাড়িতে আনতেন আশ্রয়ের জন্য। গাড়োয়ানের ছদ্মবেশে বিপ্লবী হরিদাস দত্ত ৯ বাক্স কার্তুজ আর ৫০টি পিস্তল চুরি করলে তার মধ্যে ৭টি পিস্তল দুকড়ি বালা দেবীর কাছে রেখে যান। পুলিশ খবর পেয়ে দুকড়ি বালা দেবীকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। তৃতীয় শ্রেণির কয়েদি হিসেবে দু'-বছরের জন্য জেলে গিয়েছিলেন তিনি। অখাদ্য খাবার, চটের মতো মোটা জামাকাপড় বরাদ্দ ছিল তাঁদের জন্য। যৌন নির্যাতন, চোখে পিন ফুটিয়ে দেওয়া মতো অমানুষিক অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে।

ভারতকে স্বাধীন করার জন্য প্রতিটি মানুষ নিজের জীবনের বাজি রেখেছিলেন। তাঁদের জীবন উৎসর্গ বিফলে যায়নি, ভারত স্বাধীন হয়েছে। উপরোক্ত ব্যক্তিত্ব ছাড়াও এমন অনেক অজানা নাম আজও ইতিহাসের পাতায় লুকিয়ে আছে, যাঁরা দেশের জন্য প্রাণপাত করেছিলেন। যেমন, সুচেতা কৃপালনী, বাসন্তী দেবী, ভেলু নাচিয়ার, কমলা চট্টোপাধ্যায়, এন. জি. রাঙ্গা, পার্বতী গিরি, আবাদি বানো বেগম, দুর্গাবাঈ দেশমুখ। এমন আরও অনেক নাম আছে, যাঁদের আমরা আজ ভুলতে বসেছি। তাঁরা শুধু একটি দেশ স্বাধীন করেনি, তাঁরা পরবর্তী প্রজন্মকে এক অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। তাঁদের কাছে আমরা চিরকৃতজ্ঞ।

More Articles