'খেটে খাওয়া'দের শিল্প! বরফ বিক্রি, জুতো পালিশ করা, মাংস কাটা ছেলেরাই জিতিয়েছিল দেশকে

Uruguay Football: মন্তেভেদিয়োতেই আন্দ্রাদে মারা যায়। সে যক্ষায় মারা যায়, তার পকেটে তখন কানাকড়িও ছিল না।

আমেরিকা পুনরাবিষ্কার

স্বদেশ কথাটায় পেদ্রো অ্যারিস্পের আলাদা রকম কোনও অনুভূতি হতো না। স্বদেশ তার কাছে নেহাতই জন্মস্থান, যা বেছে নেওয়ার কোনও সুযোগ কারওই থাকে না। পেদ্রোর স্বদেশ বরং সেই জায়গাটা, যেখানে কোনও এক বড়লোকের দপ্তরির কাজ করতে করতে সে নিজের পিঠ ভেঙে ফেলেছিল। এমন নয় যে লোকটা তাকেই বেশি খাটাত, দুনিয়ার যেকোনও প্রান্তেই অধস্তনদের এমন খাটতে হয়। কিন্তু উরুগুয়ে যখন ১৯২৪-এর ফ্রান্স অলিম্পিকে সোনা জিতল, অ্যারিস্পে ছিল সেই দলেরই খেলোয়াড়। পুরস্কার বিতরণীর সময় সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিল সূর্য আর হালকা নীল চারটে দাগ টানা পতাকা ধীরে ধীরে সম্মানের চূড়ায় উঠে গেল অন্য সব পতাকার মাথা ছাড়িয়ে। তখন তার মনে হচ্ছিল আনন্দে বুকটা বুঝি ফেটেই যাবে।

এর চার বছর পরে উরুগুয়ে হল্যান্ড অলিম্পিকে ফের সোনা জিতল। প্রখ্যাত শিশুচিকিৎসক ও উরুগুয়ে ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি আতিলিয়ো নারানসিয়ো, যিনি ’২৪ সালের অলিম্পিকে দল পাঠানোর রাহাখরচ জোগাড় করতে নিজের বাড়ি পর্যন্ত বন্ধক রেখেছিলেন, মন্তব্য করেন, "আমরা পৃথিবীর মানচিত্রে ছোট্ট একটা বিন্দুমাত্র নই আর।" আকাশী নীল জার্সিটা ততদিনে একটি জাতির অস্তিত্বের সঙ্গে লেপটে-সেঁটে গেছে, উরুগুয়ে ফাঁকতালে বাজি জেতেনি। ফুটবলই ছোট্ট দেশটিকে অপরিচয়ের ছায়া থেকে প্রকাশ্য দিবালোকে টেনে আনে।

১৯২৪ আর ’২৮-এর ঐতিহাসিক জয়ের কারিগরেরা ছিল নেহাতই খেটে খাওয়া মানুষ আর ভবঘুরের দল, যারা ফুটবল থেকে অনাবিল আনন্দ ছাড়া কিচ্ছুটি চায়নি। পেদ্রো অ্যারিস্পে কসাইখানায় প্যাকেটে মাংস ভরার কাজ করত, হোসে নাসাৎসি মার্বেলের মিস্ত্রি ছিল, ‘পেরুচো’ পেত্রনে একটা মুদি দোকানে কাজ করত, পেদ্রো সেআ রাস্তার ধারে বরফ বেচত, হোসে লিয়ান্দ্রো আন্দ্রাদে জলসায় বাজনা বাজাত আর অন্য সময়ে জুতো পালিশ করত। ওরা সবাই কমবেশি বছর কুড়ির ছিল, যদিও পুরনো ছবিতে সবাইকেই রীতিমতো বয়স্ক বলে মনে হয়। খেলতে গিয়ে হাত-পা কেটে বা মচকে গেলে ওরা নুন জল দিয়ে ধুয়ে নিত, ভিনিগারের পুলটিস লাগাত আর পেটে দু' এক গেলাস কারণসুধা চালান করে দিত।

একটা যাচ্ছেতাই জাহাজের থার্ড ক্লাসে চড়ে ওরা ১৯২৪-এ ইওরোপে পৌঁছেছিল, তারপর ধারের পয়সায় বাস বা ট্রেনের সেকেন্ড ক্লাসে বিভিন্ন জায়গায় যাতায়াত চলে। কখনও কাঠের বেঞ্চিতে শুয়েও কাটিয়েছে। ম্যাচের পর ম্যাচ খেলে গেছে স্রেফ রাতের খোরাক আর ছাদের নীচে শোয়ার জন্য। পারি অলিম্পিকের আগে উরুগুয়ের দলটা হিস্পানি দেশে ন'টা ম্যাচ খেলে, সব কটা ম্যাচেই তারা জিতেছিল।

আরও পড়ুন- ১১ জন ফুটবলারকেই পাহাড়ের চুড়োয় দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরেছিল হিটলারের দল

লাতিন আমেরিকার কোনও দেশ সেই প্রথমবার ইওরোপে খেলছিল। প্রথম ম্যাচ ছিল য়ুগোশ্লাভিয়ার বিরুদ্ধে। উরুগুয়ের অনুশীলনের সময় য়ুগোশ্লাভিয়া মাঠে গুপ্তচর পাঠিয়েছিল। আমাদের দেশের খেলোয়াড়রা ব্যাপারটা বুঝে ফেলে মাটিতে লাথি মারতে থাকে আর মাঝে মাঝে বেদম জোরে বল মেরে মেঘের দেশে পাঠাতে শুরু করে, এক পা যেতে না যেতেই মাটিতে পড়ে যেতে থাকে, নিজেদের মধ্যে কেবলই ধস্তাধস্তি করে। বিভ্রান্ত গুপ্তচরেরা নির্দিষ্ট জায়গায় বার্তা পাঠায়, "আপনাদের ভাবতেই খারাপ লাগবে, বেচারারা অদ্দূর থেকে কেন যে এসেছে…"।

মেরেকেটে হাজার দুয়েক মানুষ খেলা দেখতে এসেছিল। সূর্যটাকে মাথার দিকে রেখে উরুগুয়ের পতাকাটা সেদিন উলটো করে ঝোলানো হয়েছিল, জাতীয় সুরের বদলে ব্রাজিলীয় কুচকাওয়াজের সুর বাজানো হয়েছিল। কিন্তু শেষ বিকেলে উরুগুয়ে য়ুগোশ্লাভিয়াকে ৭-০ হারায়।

এই খেলার ফলাফল যেন দ্বিতীয়বার আমেরিকা আবিষ্কারের মতো হয়ে দাঁড়াল। খেলার পর খেলায় মানুষ ধাক্কাধাক্কি করতে শুরু করল ওই ছেলেগুলোর ফুটবল দেখবে বলে। ওরা কাঠবেড়ালির মতো পিছলে যেত, পায়ে বল নিয়ে যেন দাবা খেলা শুরু করত। ইংল্যান্ডের ফুটবল দলটা লম্বা পাস আর উঁচু শট মারায় নিখুঁত ছিল, কিন্তু দূর মহাদেশ থেকে যাওয়া, উত্তরাধিকার-বঞ্চিত ছেলেগুলো, আদৌ ফুটবলে নিজেদের পূর্বপুরুষের পদাঙ্ক অনুসরণ করেনি। তারা আবিষ্কার করেছে নিজের পা থেকে ঠিক পাশের জনের পায়ে ছোট-ছোট মাপা পাস খেলার কৌশল, মাঝে মধ্যেই প্রবল গতির ঝড় তুলে খেলার চাল পালটে দেওয়া, আর ওই বিপুল গতিতে চলতে চলতেই ড্রিবল করা। ফ্রান্সের অভিজাত লেখক অঁরি দ্য মুতেরলঁ ওদের খেলা দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে লিখেছিলেন, "সত্যিই এটা একটা অত্যাশ্চর্য আবিষ্কার! যেন এই প্রথম আসল ফুটবল দেখছি। এর পাশে এতকাল যা দেখে এসেছি, যা আমাদের এখানে ফুটবল বলে খেলা হয়, সবই নেহাত পানসে, ছোট ছেলেদের সময় কাটানো।"

১৯২৪ আর ’২৮-এর অলিম্পিক এবং ১৯৩০ এবং ’৫০-এর বিশ্বকাপে উরুগুয়ের সাফল্যের পেছনে সরকারি কিছু সিদ্ধান্তও যথেষ্ট কাজে এসেছিল। বিশেষ করে দেশের কোণায় কোণায় শারীরশিক্ষার বিস্তারের জন্য খেলার মাঠের বন্দোবস্ত করাটা খুবই কাজে লেগেছিল। আজকাল আর ওসবের চল তেমন নেই, সবাই বড্ড নিয়ম মতে চলতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি, ফুটবলও হয়ে দাঁড়িয়েছে দূর অতীতের সোনালি স্মৃতি। অনেক খেলোয়াড়ই, এনজ়ো ফ্রাঞ্চিকোলির [ফ্রান্সিসকোলি] মতো অসামান্য খেলোয়াড়রা যেমন, পুরনো শিল্প পুনরুদ্ধারে যথেষ্ট মনোযোগী, তবু উরুগুয়ের ফুটবলের সেই অতীত আর ফেরেনি। আজকালকার ছেলেরা বিশেষ খেলতেও চায় না, যারা খেলে তাদের মধ্যে নয়নাভিরাম খেলাও বিশেষ দেখা যায় না। যদিও, উরুগুয়েতে এমন কোনও লোককে পাবেন না যে নিজেকে ফুটবলের কৌশলে পিএইচডি ভাবে না। সবাই নিজেকে ফুটবলের ইতিহাসের গবেষক বলেও মনে করে। সেই পুরনো দিনগুলোর কথা থেকেই উরুগুয়ের মানুষের ফুটবল প্রেম সার জল পায়, এর শিকড় অনেক গভীরে। প্রত্যেকবার যখন আমাদের জাতীয় দল খেলতে নামে, তা সে যার বিরুদ্ধেই হোক না কেন, গোটা দেশ দমবন্ধ করে বসে থাকে। নেতা-গায়ক-রাস্তার ফেরিওলা সবাই মুখ বন্ধ করে ফেলে, প্রেমিক-প্রেমিকা আলিঙ্গন স্থগিত রাখে, মাছিরাও ওড়াউড়ি করে না।

আরও পড়ুন- মহিলাদের যাতে অসম্মান না হয়, তাই সর্বাঙ্গ ঢাকা জামা পরে মাঠে নামতেন ফুটবলাররা!

আন্দ্রাদে

ইওরোপ তার আগে কোনও কালো মানুষকে ফুটবল খেলতে দেখেনি। ১৯২৪-এর অলিম্পিকে হোসে লিয়ান্দ্রো আন্দ্রাদে তার অনবদ্য শৈলীতে সব্বাইকে চমকে দিয়েছিল। আন্দ্রাদে খেলত মাঝমাঠে। দৈত্যাকৃতি চেহারা হলে কী হবে, শরীরটা যেন রবারের তৈরি, প্রতিপক্ষকে না ছুঁয়েই মাঠের এক প্রান্ত থেকে ঝেঁটিয়ে অন্য প্রান্তে বল নিয়ে চলে যেত। আর আক্রমণ শানানোর সময় শরীরটা এমনভাবে দোলাত যে উলটোদিকের খেলোয়াড়রা সব ছিটকে মাটিতে পড়ে যেত। একটা ম্যাচে তো বলটাকে মাথায় রেখেই মাঝমাঠ পেরিয়ে গিয়েছিল। দর্শকরা এমন সব অনাসৃষ্টি কাণ্ড দেখে তার নামে জয়ধ্বনি দিত। ফরাসি সংবাদমাধ্যম তার নাম দিয়েছিল ‘কালো বিস্ময়’।

টুর্নামেন্ট শেষ হয়ে যাবার পর, আন্দ্রাদে পারি শহরের আশেপাশে কিছুদিন ঘুরেছিল, তখন সে পাক্কা বোহেমিয়ান আর ক্যাবারের রাজা। মন্তেভেদিয়ো থেকে পরে যাওয়া শণের দড়ির চটির বদলে চকচকে চামড়ার জুতো আর ছেঁড়া টুপির বদলে মাথায় চমৎকার দামি টুপি পরে একেবারে ফিটফাট বাবু। নিয়ন আলোয় ঝকমকে পারির পিগাল এলাকার নৈশজীবনের নতুন রাজাকে তখনকার খবরের কাগজের কলামে অঢেল প্রশংসা করা হয়েছে; চঞ্চল পদক্ষেপ, চওড়া হাসি, আধ বোঁজা চোখে সদাই যেন দূরে তাকিয়ে আছে। আর পোশাক? সে তো মেয়েদের বুকে বেমালুম ছুরি বসিয়ে দেয়, সিল্কের রুমাল, স্ট্রাইপড জ্যাকেট, উজ্জ্বল হলুদ রঙের দস্তানা, হাতে রুপো বাঁধানো বেতের ছড়ি।

এর বহুদিন বাদে মন্তেভেদিয়োতেই আন্দ্রাদে মারা যায়। বন্ধুরা তার জন্য অনেক রকম পরিকল্পনা করেছিল, কিন্তু কিছুই বাস্তবায়িত হয়নি। সে যক্ষায় মারা যায়, তার পকেটে তখন কানাকড়িও ছিল না।

সে কৃষ্ণাঙ্গ ছিল, ছিল দক্ষিণ আমেরিকার মানুষ এবং দরিদ্র ফুটবলের প্রথম আন্তর্জাতিক তারকা।

আরও পড়ুন- এক হাতে রিভলবার, অন্য হাতে চিঠি! মাঝমাঠেই নিজেকে শেষ করে দিয়েছিলেন ফুটবলার

বল পায়ে ভাঁজ মারা

ইংরেজি আট সংখ্যাটির মতো পেঁচিয়ে একের পর এক খেলোয়াড়কে কাটিয়ে যাওয়াকে ওরা বলত মোনাস কিংবা রিংলেট কোঁকড়া চুল। ফরাসি সাংবাদিকেরা এই ডাকিনি বিদ্যার স্বরূপ জানতে চেয়েছিল, যা বিপক্ষের খেলোয়াড়কে এমন শালগ্রাম শিলার মতো স্থাণু বানিয়ে ছাড়ে। এক দোভাষীর মাধ্যমে হোসে লেয়ান্দ্রো আন্দ্রাদে সে রহস্যের উন্মোচন করে বলেছিল, উরুগুয়ের খেলোয়াড়েরা অনুশীলনের সময় মুরগির পিছনে দৌড়য়, ফলে মাঠে ইংরেজি ‘এস’ হরফের মতো দেখায়। কী কপাল! সাংবাদিকেরা এইসব হাবিজাবি শুধু বিশ্বাসই করেনি, ফলাও করে কাগজে ছেপেওছিল।

এর বহু বছর পরেও দক্ষিণ আমেরিকার দর্শকের চোখে বল নিয়ে এইভাবে কাটিয়ে খেলা, গোল করার মতোই জনপ্রিয় ছিল। আমার শৈশবের স্মৃতি জুড়ে আছে এমন সব অনবদ্য খেলোয়াড়, যারা কাটানোয় ওস্তাদ ছিল। এখনও চোখ বুঁজলে তাদের দেখতে পাই। যেমন ধরুন, ওয়াল্টার গোমেজ়। মাথা ঘুরিয়ে দেবার মতো বল নিয়ে কাটাত, যেন ঝোপ-জঙ্গল সাফ করতে নেমেছে, প্রতিপক্ষের পায়ের জলাভূমিতে ঝাঁপ দিয়ে নেমে কাটাতে কাটাতে এগিয়ে যেত। নৌকো চলে গেলে যেমন জলে কিছুক্ষণের জন্য দাগ থেকে যায়, তেমনই মাঠে পড়ে যাওয়া উলটোদিকের খেলোয়াড়দের পিছনে ফেলে গিয়ে যেত সে। আমরা গ্যালারিতে বসে গান জুড়তাম,

আমরা এতই জোরে দৌড়ই

ওয়াল্টার গোমেজ়ের পাস ধরা আমাদের সাধ্যি না।

সে ভালোবাসত বলটাকে প্রায় হাঁটু দিয়ে ঠেলে নিয়ে যেতে, নিজের দখলে রাখতে, আদর করতে। আর যদি কোনও কারণে বল তার পা থেকে ছিটকে যেত তাহলে বেজায় অসম্মানিত বোধ করত। আজকালকার মতো তখনকার দিনে কোনও কোচের বাপের সাধ্যি ছিল না তাকে বলে যে, "এতই যদি হাঁটু দিয়ে বল ঠেলে নিয়ে যাবার শখ তাহলে রুটির কারখানায় চাকরি খোঁজ গে যা।"

তখনকার খেলোয়াড়দের এই কাটিয়ে-কাটিয়ে খেলা শুধু সরলমতির শয়তানি ছিল না, বরং দর্শক এমনটাই চাইত। ইদানিং এমন শিল্পময় ফুটবলকে একবারে আস্তাকুঁড়ের আবর্জনা বলে মনে করা হয়। নইলে সন্দেহ করা হয় স্বার্থপর খেলোয়াড়ের দেখানেপনা বলে যা দলের পক্ষে নাকি ক্ষতিকর এবং আধুনিক ফুটবলে রক্ষণভাগের লৌহযবনিকার সামনে এসব নাকি নেহাতই খেলো ব্যাপার।

 

More Articles