মহিলাদের যাতে অসম্মান না হয়, তাই সর্বাঙ্গ ঢাকা জামা পরে মাঠে নামতেন ফুটবলাররা!

Ancient Days of Football: মহিলাদের যাতে কোনও অসম্মান না হয় সেজন্য খেলোয়াড়রা সুতি কিংবা পশমের কাপড় জামার বর্মে সর্বাঙ্গ মুড়ে মাঠে নামত। চর্ম প্রদর্শনের কোনও সুযোগই ছিল না।

হানাদার ইংরেজ

বুয়েনস আইরেসের পাগলাগারদের সামনে খোলা জায়গাটায় কয়েকজন সাদা চামড়ার ছেলে মনের আনন্দে বল পেটাচ্ছিল।

"ওরা কারা গো ?" একটা বাচ্চা জিগ্যেস করে।

"পাগল রে", বাচ্চাটার বাবা বলে, "পাগলা ইংরেজ যত"।

সাংবাদিক হুয়ান হোসে দে সইসা রেইলি শৈশবের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এই ঘটনাটার উল্লেখ করেছেন। শুরুর দিকে রিভার প্লেটে ফুটবলকে পাগল-ছাগলের খেলা বলেই মনে করা হতো। কিন্তু ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কামড় যত বেড়েছে ওদের চিরাচরিত রীতি মেনে ম্যানচেস্টারের কাপড়, রেলওয়ে, ব্যারিংস ব্যাঙ্কের ঋণ, মুক্ত বাণিজ্যের ফাঁদ যত বিস্তৃত হয়েছে দুনিয়ার এই প্রান্তে ততই ফুটবলেরও প্রসার হয়েছে। বুয়েনস আইরেস আর মন্তেভিদেয়োতে ফুটবল আসে জাহাজিদের পায়ে-পায়ে, নদী-নালা-খাল-বিল দিয়ে, সেই যখন থেকে মহারানির জাহাজগুলো কম্বল, বুট জুতো আর ময়দা নামিয়ে দিয়ে এদিক থেকে পশম, পশুর চামড়া আর গম পাচার করত অতলান্তিকের ওই পারে। ব্রিটিশ নাগরিক, কূটনৈতিক এবং রেলওয়ে বা গ্যাস কোম্পানির হর্তাকর্তারাই প্রথম এখানকার ফুটবল দল তৈরি করে। মন্তেভিদেয়ো আর বুয়েনস আইরেসের ইংরেজরা ১৮৮৯ সালে, মহারানি ভিক্টোরিয়ার অতিকায় প্রতিকৃতির সামনে উরুগুয়ের প্রথম আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচ আয়োজন করে। ছবিতে রানিমা তাচ্ছিল্য করে চোখ নামিয়ে রেখেছিলেন। সাত সমুদ্রের অধীশ্বরীর আরেকটা প্রতিকৃতির সামনে ১৮৯৫-এ ব্রাজিলে প্রথম ফুটবল ম্যাচ হয়। সেই খেলাটা হয়েছিল গ্যাস কোম্পানি আর সাও পাওলো রেলওয়ের ইংরেজদের মধ্যে।

আদ্যিকালের সাদা-কালো ছবিতে এই সব যুগপুরুষদের দেখা যায়। ওরা কিন্তু যুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেওয়া সেপাই। উপস্থিত ভদ্রমহিলারা, যারা রোদ্দুরের হাত থেকে গায়ের রং বাঁচাতে সঙ্গে আনা রেশমের রঙিন ছাতা আর লেসের কাজ করা রুমাল ওড়িয়ে উৎসাহ দিত, তাদের যাতে কোনও অসম্মান না হয় সেজন্য খেলোয়াড়রা সুতি কিংবা পশমের কাপড় জামার বর্মে সর্বাঙ্গ মুড়ে মাঠে নামত। চর্ম প্রদর্শনের কোনও সুযোগই ছিল না। কেবল দেখা যেত টুপির নীচে মোম দিয়ে মাজা গোঁফজোড়ার পিছনে গম্ভীর মুখগুলো। তাদের পা ঢাকা থাকত ম্যানসফিল্ডের বাজার থেকে কেনা শক্তপোক্ত জুতোয়।

তবে সংক্রমণ ছড়াতে বেশি সময় লাগেনি। অনতিবিলম্বেই স্থানীয় বংশোদ্ভূত বাবুরাও নিজেদের মধ্যে ইংরেজদের শেখানো এই খামখেয়ালি ফুটবল খেলা শুরু করে। তারা সাগরপারের লন্ডন থেকে জার্সি, বুট, গোড়ালির কাছটায় মোটা মোজা এবং বুক থেকে হাঁটু পর্যন্ত লম্বা ঝুলের হাফপ্যান্ট আমদানি করত। শুল্ক বিভাগের যেসব কর্তা প্রথম দিকে বলকে কী ধরনের আমদানি দ্রব্যের মধ্যে ধরবে বুঝতে পারত না, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারাও আর বল দেখে বিভ্রান্ত হত না। জাহাজে চড়েই সাগরপারে দক্ষিণ আমেরিকার এই সব বেলাভূমিতে ফুটবলের আইন-কানুনের বইপত্রও পৌঁছয়। আর এসে পৌঁছয় বহু শব্দ, যা এখনও প্রচলিত তো বটেই আগামী বহু কাল এই শব্দগুলো ভোলার কোনও সম্ভাবনা নেই : ফিল্ড, স্কোর, গোল, গোলকিপার, ব্যাক, হাফ, ফরোয়ার্ড, আউট-বল, পেনাল্টি, অফ-সাইড ইত্যাদি ইত্যাদি। ‘ফাউল’ হলে ‘রেফারি’ শাস্তি দেবে, কিন্তু যাকে মারা হল সে মনে করলে অপরাধী খেলোয়াড়কে মার্জনাও করতে পারে, "যদি তার ক্ষমাপ্রার্থনা আন্তরিক এবং নির্ভুল ইংরেজিতে" হয়, রিভার প্লেটে প্রথম যুগে ফুটবলের আইন-কানুনের যে বই আসে তাতে এমন কথা ছাপা ছিল।

ইতোমধ্যে, অন্য বেশ কিছু ইংরেজি শব্দ ক্যারিবিয়ায় লাতিন আমেরিকার দেশগুলির ভাষায় প্রবেশ করে, পিচার, ক্যাচার, ইনিংস ইত্যাদি। মার্কিনি প্রভাবে পড়ে এইসব দেশের লোকেরা কাঠের একটা গোল ডাণ্ডার মতো ব্যাট দিয়ে বল পেটাতে শেখে। নাবিকেরা যখন বুলেটের জোরে রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়ে কিংবা আগুন জ্বেলে জনপদের পর জনপদ ছারখার করে এইসব এলাকায় আধিপত্য কায়েম করত, তখন নিজেদের রাইফেলের সঙ্গে ব্যাটও বয়ে আনত। আমাদের কাছে ফুটবল যেমন, ক্যারিবিয়ায় বেসবল তেমনই জায়গা করে নিয়েছে।

আরও পড়ুন- বাপের আবেগ বর্তায় ছেলের উপরে! ফুটবল আসলে যুদ্ধের পরম্পরা?

ফুটবলের নবকলেবর

আরহেন্তিনার সর্বোচ্চ ফুটবল সংস্থা তাদের দপ্তরের সভায় পদাধিকারীদের হিস্পানিতে কথা বলতে দিত না। উরুগুয়ের ফুটবল নিয়ামক সংস্থা রোববারের ফুটবল ম্যাচ বাতিল করে দিয়েছে কেননা ব্রিটিশদের রেওয়াজ হচ্ছে শনিবারে ফুটবল খেলা। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর প্রথম কয়েক বছরে, রিভার প্লেটের দু'পারে ফুটবলের জনপ্রিয়তার পারদ ক্রমশ এমনই চড়তে থাকে যে ওই সব এলাকায় এটি জাতীয় খেলার মর্যাদা পায়। বদলটা খেয়াল করুন, খেলাটা প্রথম এসেছিল বড়লোকের অলস অপোগণ্ড ছেলেপুলের বিনোদনের জন্য, খুব দ্রুত তা গজদন্ত মিনার ছেড়ে মাটির কাছাকাছি নেমে এল এবং রীতিমতো শিকড় গেড়ে বসল।

পরিবর্তনের এমন প্রবাহ ঠেকানো অসম্ভব ছিল। ট্যাঙ্গোর ছন্দের মতোই ফুটবলও এঁদো বস্তির অলি-গলিতে বিকশিত হয়েছে। তার জন্য পয়সা লাগেনি, খেলার তীব্র আকাঙ্ক্ষার চেয়ে আর কিছু বেশি জরুরি মনে হয়নি। মাঠে, কানাগলিতে কিংবা সৈকতের ভেজা বালিতে স্থানীয় ছোট ছোট ছেলেরা তরুণ অভিবাসীদের সঙ্গে পুরনো মোজার পেটে কাগজ বা ছেঁড়া কাপড় ঢুকিয়ে বল বানিয়ে খেলত। দু'প্রান্তে একজোড়া করে পাথর রেখে তৈরি হত তাদের গোলপোস্ট। ধন্যবাদ জানতে হয় ফুটবলের ভাষাকে, যা অচিরেই বিশ্বজনীন হয়ে উঠবে, যা দিয়ে অক্লেশেই এই মহাদেশের গাঁয়ের চাষা ইওরোপ থেকে বিতাড়িত মজুরদের সঙ্গে কী চমৎকারভাবে ভাব বিনিময় করতে পারল। ফুটবলের এস্পেরান্তো স্থানীয় ক্রেয়ল ভাষার সঙ্গে সমুদ্রপারের ভিগো, লিসবোঁয়া, নেপলস, বেইরুট কিংবা বেসারাবিয়ার কোনও ছোট্ট জায়গা থেকে আমেরিকায় আসার স্বপ্ন তাড়া করা কোনও সামান্য দপ্তরিরও এমন মনের মিল ঘটিয়ে দিল সত্যিই একটা নতুন দুনিয়া গড়তে লাগল তারা। কেউ রাজমিস্ত্রির কাজ নিল, কেউ মাল বইতে থাকল, কেউ রুটি বানাল, কেউ আবার ঝাড়ুদারের কাজ নিল। কিন্তু ফুটবল তাদের সমুদ্রযাত্রার ক্ষতে মলম বুলিয়ে দিল। ব্যাপারখানা বুঝে দেখুন, যে খেলাটা আগে হত ইংল্যান্ডের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে, দক্ষিণ আমেরিকায় এসে সেটাই আনন্দের জোয়ার বইয়ে দিল, যদিও এদিকের লোকেরা জীবনে ইশকুলের চৌকাঠ মাড়ায়নি।

বুয়েনস আইরেস আর মন্তেভেদিয়োর মাঠে-ঘাটে ধীরে ধীরে ফুটবলের নতুন শৈলীর জন্ম হল। আমাদের ফুটবল খেলার ঘরোয়া পদ্ধতি তৈরি হল, যেমন মিলঙ্গা নাচের ক্লাবগুলোয় ট্যাঙ্গোও বদলে গেছে। মেয়ে-পুরুষ নির্বিশেষে নাচিয়েরা মেঝের ছোট্ট একখণ্ড পাথরে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সব কারুকাজ ফুটিয়ে তোলে। ফুটবল পায়ে খেলোয়াড়রাও নিজেদের ভাষা নির্মাণ করে নেয়। তারা জোরে বল মেরে উড়িয়ে দেওয়ার বদলে সামান্য একফালি জায়গায় বলকে বশ মানিয়ে রাখে, ছাড়তে চায় না মোটে যেন পরম আদরে বিনুনি বেঁধে দিচ্ছে। ফুটবলের এই ক্রেয়ল ভাষায়, পায়ের কারুকাজে, জন্ম হল লাতিন আমেরিকার বিখ্যাত টাচ ফুটবলের, এ তো পায়ে বল নয়, দু' আঙুলের ফাঁকে প্লেকট্রাম ধরে গিটারে সুরের মূর্ছনা বইয়ে দেওয়া।

একই সঙ্গে, হিউ দে জেনেইরো আর সাও পাওলোতে খেলাটা নিজেকে ক্রান্তীয় গ্রীষ্মমণ্ডলের উপযোগী করে নিয়ে গরিবগুর্বো মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। ভুললে চলবে না, লঝঝড়ে অর্থনীতির ওইসব মানুষই খেলাটাকে সমৃদ্ধ করেছে বেশি। প্রথম প্রথম ওদেশেরই কিছু অবস্থাপন্ন ঘরের ছেলেরা ফুটবলে ইওরোপের নকলনবিশি করেছে, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খেলাটা ব্রাজিলেরও নিজস্ব হয়ে উঠেছে। তারাও ততদিনে ফুটবলে নিজেদের প্রাণশক্তির ঢেউ খেলিয়ে দিয়েছে। এভাবেই পৃথিবীর সবচেয়ে দর্শনীয় ফুটবলের জন্ম কোমর দুলিয়ে শরীরি বিভঙ্গে ঝড় তুলে পা জোড়া যেন উড়ে চলে। এর উদ্ভব মনে হয় আফ্রো-ব্রাজিলীয় মার্শাল আর্ট কাপোএইরা থেকে দাসপ্রথার বলি কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের রণনৃত্য আর বড়ো শহরের বস্তিগুলোর উল্লাসের নাচ এক জায়গায় এসে মিশেছে।

ফুটবল যতই জনপ্রিয় আবেগে রূপান্তরিত হতে থাকল, তার বুকের মাঝখানটিতে লুকিয়ে থাকা সৌন্দর্য যত পাপড়ি মেলল, সে নিজেকে নেহাত অবসর বিনোদনের মাধ্যম হিসেব দেখাটাকে তুড়ি মেরে বাতিল করে দিল। ১৯১৫-য় ফুটবলের এতটাই গণতন্ত্রীকরণ হল যে তার নামে হিউ দে জেনেইরোর স্পোর্টস পত্রিকায় লেখা হল, "আমরা যারা সমাজে রীতিমতো প্রতিষ্ঠিত তাদের জোর করা হচ্ছে মজদুরদের সঙ্গে খেলতে, গাড়ির চালকদের সঙ্গে... খেলাটা দিন দিন নিদারুণ যন্ত্রণার ব্যাপার হয়ে উঠছে, যেন যুদ্ধ হচ্ছে, এটা মোটেই আর অবসরে মন ভালো করার খেলা থাকছে না"।

আরও পড়ুন- বলে লাথি কষিয়ে খানিক খোশগল্প, খানিক তামাক! যেভাবে চলত আদ্যিকালের ফুটবল

ফ্লা আর ফ্লু-এর গপ্পো

ব্রাজিলের ফুটবলের ইতিহাসে প্রথম মহাকাব্যিক ম্যাচটি হয়েছিল ১৯১২ সালে, প্রথম ফ্লা-ফ্লু। সেই খেলায় ফ্লামেঙ্গো ৩-২ গোলে ফ্লুমিনেন্সের কাছে হারে। সেদিন খেলাও হয়েছিল জবরদস্ত। দর্শকরা প্রায় দমবন্ধ করে দেখছিল কী হয় কী হয়! ম্যাচের আগে কাঠখোট্টা ভদ্রলোক আর ঝুঁকে পড়া ভদ্রমহিলারা দর্শকদের বসার জায়গাটা ফল, ফুল, পালক দিয়ে সাজিয়েছিল। একটা করে গোল হচ্ছিল আর ভদ্রলোকেরা উল্লাসে মাথার খড়ের টুপি উড়িয়ে দিচ্ছিল মাঠের ভেতরে তাক করে। মাঠে মেয়েদের দেখে তাদের ভক্তরা সাধারণত অজ্ঞান হয়ে যায়, কিন্তু সেদিনের খেলায় গোলের উত্তেজনাতেই হোক বা ভ্যাপসা গরম আর আঁটোসাঁটো কর্সেট অন্তর্বাসের কারণে, মেয়েরাই জ্ঞান হারায়।

ফ্লামেঙ্গো তার অল্প কিছুদিন আগেই গড়ে উঠেছে। আসলে ফ্লুমিনেন্স ক্লাবই দীর্ঘদিনের খিটিমিটি আর যন্ত্রণার শেষে দু'ভাগে ভাগ হয়ে যায়। কিন্তু আদি ক্লাব সামান্য দিনেই বুঝে যায় নতুনটিকে আঁতুড় ঘরে নুন খাইয়ে মেরে না দেওয়াটা কত বড় আহাম্মকের কাজ হয়েছে। অবশ্য চোর না পালানো পর্যন্ত বুদ্ধি আর কবেই বা বেড়েছে মানুষের। নিজেই খাল কেটে কুমির আনলে হাত কামড়ানো ছাড়া আর তো কিছু করার থাকে না।

তারপর থেকে, পিতা পুত্রের মতো, পুত্র বললে ঠিক বোঝা যাবে না বিদ্রোহী পুত্র, যে বাপকে পরিত্যাগ করেছে এবং বাকি জীবনটা বাপ বেটায় একে অপরকে ঘৃণা করে কাটিয়ে দেবে বলে পণ করেছে। প্রতিটি ফ্লা-ফ্লু ম্যাচ যেন চির অসমাপ্ত যুদ্ধের একটা দৃশ্য মাত্র। দুটো ক্লাবই অলস-পাপী হিউ দে জেনেইরো শহরের প্রেমে মশগুল। বহু ইতিহাসের সাক্ষী এই শহর দু' দলকেই প্রশ্রয় দেয়, তাদের নিয়ে সারাবেলা আপন মনে খেলে, কিন্তু কোনও একজনের কাছে কখনও নিজেকে সমর্পণ করে না। তার দখল নেবার জন্যই দুই ক্লাব শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত লড়ে যায়, আর হিউ দে জেনেইরো প্রতিটি ম্যাচেই দিব্যি সেজগুজে গ্যালারিতে এসে বসে।

More Articles