ফলল কল্যাণের আপ্তবাক্য, ত্রিপুরায় রাজীবে ভরসার মাশুল গুণছে তৃণমূল

Tripura assembly by election : ত্রিপুরায় এমন অবস্থা হল কেন তৃণমূলের?

তারিখটা ছিল চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি৷

সেই দিনেই হক কথাটা বুঝতে পেরেছিলেন তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় ৷ তিনি বলেছিলেন, "অভিষেক যদি ত্রিপুরা আর গোয়া জিতিয়ে দেখাতে পারেন, তাহলে ওঁকে নেতা বলে মেনে নেব"৷ বলার অপেক্ষা রাখে না এখানে অভিষেক বলতে তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কেই বুঝিয়েছিলেন সাংসদ কল্যাণ৷

এর পর গত ১৪ ফেব্রুয়ারি গোয়া বিধানসভার নির্বাচন হয়৷ ফল প্রকাশিত হয় প্রায় একমাস পর, ১০ মার্চ৷ তাতে দেখা যায়, তৃণমূলের সব প্রার্থী সম্মিলিতভাবে ভোট পেয়েছে ৪৯,৪৮০টি ভোট, শতাংশের হিসেবে ৫.২% ভোট৷ এই ভোট পেয়ে কোনও আসন পাওয়া অসম্ভব৷ তাই তৃণমূল কোনও আসনেই জিততে পারেনি৷

এর পর ত্রিপুরার ৪টি বিধানসভা আসনে উপনির্বাচন হয় গত ২৩ জুন৷ চারটি আসনেই প্রার্থী দেয় তৃণমূল কংগ্রেস৷ অভিষেক নিজে কয়েক দফায় ভোটপ্রচারে যান৷ এই নির্বাচন পরিচালনার জন্য দলের তরফে দায়িত্ব দেওয়া হয় বিজেপি-ফেরত প্রাক্তন তৃণমূলি মন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়কে৷ 'ওয়ার রুম' খুলে তিনি ওখানেই ছিলেন৷

বাংলা থেকে দফায় দফায় একাধিক নেতা-মন্ত্রী ত্রিপুরায় ভোটপ্রচারে গিয়েছিলেন৷ তাঁদের বডি-ল্যাঙ্গুয়েজ ছিল, 'এই চারটি আসন তো জেতা হয়েই গিয়েছে৷ এর পর ২০২৩-এর বিধানসভা নির্বাচনে ত্রিপুরায় তৃণমূলের সরকার গড়া একশো ভাগ নিশ্চিত৷' কলকাতায় বসে তৃণমূল নেতা-কর্মীরাও এমনটাই বিশ্বাস করছিলেন৷

রবিবার ভোটের ফল প্রকাশিত হয়েছে৷ ৪ আসনেই তৃণমূল প্রার্থীদের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে৷ 'নোটা'-র সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করে ৪ আসন মিলিয়ে তৃণমূল পেয়েছে মোট ৩৮৯৬টি ভোট৷ শতাংশের হিসেবে ২.৮%৷ ওদিকে ৪ আসনে নোটা-র প্রাপ্ত মোট ভোট ১৪৪৩টি৷ আগরতলা, টাউন বরদোয়ালি, সুরমা এবং যুবরাজনগর কেন্দ্রে তৃণমূল প্রার্থীদের প্রাপ্ত ভোট যথাক্রমে, ৮৩০, ৯৭৩, ১০২০ এবং ১০৭৩ ভোট৷ পাড়ার ক্লাবের ভোটেও প্রার্থীরা এর থেকে বেশি ভোট পেয়ে থাকেন৷ এই ভোট লড়তে তৃণমূল কংগ্রেস বিমানভাড়া-সহ মোট যত টাকা খরচ করেছে,তার সঙ্গে প্রাপ্ত মোট ভোট ভাগ করলে দেখা যাবে ভোটপিছু তৃণমূল খরচ করেছে কয়েক লক্ষ টাকা৷

এর আগে আগরতলা পুরভোটেও 'দাপট'-এর সঙ্গে লড়াই করেছিল তৃণমূল৷ সেবারও কয়েক দফায় ত্রিপুরা যান অভিষেক৷ সেবারও একটি আসনও তৃণমূলের কপালে জোটেনি৷ এই নিয়ে সাম্প্রতিককালে দু'বার খালি হাতে ফিরতে হয়েছে আগরতলা থেকে৷

এবার ফেরা যাক তৃণমূল সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়৷ তিনি বলেছিলেন, "অভিষেক যদি ত্রিপুরা আর গোয়া জিতিয়ে দেখাতে পারেন, তাহলে ওঁকে নেতা বলে মেনে নেব"৷ গোয়া বা ত্রিপুরার কোনও আসনে জেতা তো দূরের কথা, জয়ের ধারেকাছেও যেতে পারেনি তৃণমূল৷ তাহলে ধরে নেওয়া যেতেই পারে এর পর 'এক কথার মানুষ' কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে দলের জাতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে 'নেতা' মানা সম্ভব নয়৷ ভবিষ্যৎই বলবে কল্যাণ কী করবেন৷

আসলে এমনই তো হওয়ার ছিল৷ ত্রিপুরা পশ্চিমবঙ্গের কোনও জেলা নয়৷ তৃণমূল কংগ্রেসের ইচ্ছা বা পরিকল্পনা সফল করায় দায় ত্রিপুরা প্রশাসন বা পুলিশের নেই৷ তৃণমূলের জেতার একমাত্র পথ ছিল, যথেষ্ট সময় দিয়ে মজবুত সংগঠন গড়ে, মানুষের পাশে দাঁড়ানো৷ সে কাজ তৃণমূল করেনি৷ আকাশপথে ত্রিপুরায় নেমে স্টেজে মেরে দেওয়ার ছক কষেছিল৷ বাংলার যে কোনও ভোটে 'জয়ী' হতে হতে সম্ভবত তৃণমূলের ধারনা হয়েছে, শক্ত সংগঠন বা জনপ্রিয়তার কোনও প্রয়োজনই নেই, তৃণমূলের 'নাম হি কাফি হ্যায়'৷ ভিন রাজ্যে তা হয় না'কি !

মনে রাখা দরকার, আগরতলা পুরসভা ভোটে তৃণমূল তুলনামূলকভাবে ভালো ফল হয়েছিল। এবার তর্জন-গর্জন বেশি হলেও সেই ভোট ধরে রাখতে তৃণমূল নেতারা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে৷

কেন তা ধরে রাখা গেল না, দলীয় নেতৃত্বকে এর জবাব দিতে বাধ্য ত্রিপুরা ভোটে দলীয় পর্যবেক্ষক রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়৷ জানা নেই কিসের ভিত্তিতে দলের ধারনা হলো যে রাজীববাবু ভোট ভালো বোঝেন৷

পড়তে পারেন-ত্রিপুরায় রাজধানী থেকেই নিকেশ বিজেপি, চাণক্যের নাম সুদীপ রায় বর্মন

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি সামনে রেখে ২০১১ এবং ২০১৬-র নির্বাচনে হাওড়ার
ডোমজুড় থেকে জয়ী হয়েছিলেন রাজীব৷ ২০২১-এ বিজেপির প্রার্থী হওয়ামাত্রই তাঁর 'ভোট-দক্ষতা' ধরা পড়ে যায়৷ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি সামনে না থাকায় প্রায় ৫০ হাজার ভোটে রাজীব হারেন৷ বিরোধী দলকে কীভাবে ভোট করতে হয়, তার ন্যূনতম জ্ঞান-ই রাজীবের নেই৷ ত্রিপুরায় বিরোধী দল তৃণমূল৷ বিরোধী দলের যা ভোট-কৌশল থাকা দরকার, তা সাজাতেই ব্যর্থ হয়েছেন তৃণমূলের পর্যবেক্ষক ৷

প্রশ্ন উঠেছে, এই ভোট জিততে আদৌ কী সিরিয়াস ছিল তৃণমূল? কেন এ সব কথা উঠছে ? তৃণমূলে এমন অসংখ্য নেতা, মন্ত্রী রয়েছেন, যারা ভোট বোঝেন৷ তেমন কোনও নেতাকেই এবার ত্রিপুরায় পাঠানো হয়নি৷ শুধু মিছিল-মিটিং করেই ভোটে জেতা যায়না৷ গ্রাউণ্ড লেভেলে মেশিনারি সাজাতে হয়৷ এ সব কাজে দক্ষ এমন অসংখ্য রাজ্যনেতা বা বিধায়ক, এমনকী জেলাস্তরের নেতা থাকা সত্ত্বেও তাদের ত্রিপুরা পাঠানো হয়নি৷ ওখানে দলের তরফে আসা-যাওয়া করেছেন কিছু সেলিব্রেটি, নেতাদের পিছু পিছু যাওয়া কিছু কর্মী এবং বাংলায় দলের সুসময় আসার পর তৃণমূল করতে আসা হাঁকডাক করা কিছু চরিত্র৷ এদের না আছে ভোট-মেশিনারির জ্ঞান, না আছে রুখে দাঁড়ানোর ক্ষমতা৷ যেখানে সংগঠন দুর্বল, প্রায় না থাকার মতো, সেখানে এই ধরনের লোকজন দিয়ে ভোট হয় না'কি? ওই পর্যবেক্ষক এই সমস্যা সম্ভবত বুঝতেই পারেননি, অথবা দলকে বলেও কোনও সাহায্য পাননি৷

ভোটের এই ফল বলছে, ত্রিপুরায় কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে গিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। এই ফাঁকিবাজিতে ২০২৩ সালের বিধানসভা নির্বাচনেও সাফল্য আসবে না৷ প্রাপ্ত ভোটসংখ্যাই বলছে, তৃণমূল ত্রিপুরার মানুষের মনে ১% জায়গাও করতে পারেনি৷ আরও পরিষ্কারভাবে বলা যায়, ত্রিপুরার মানুষের সমস্যাগুলিই বুঝতে পারেনি৷ মানুষের দরজাতেও পৌঁছাতে পারেনি৷

ফলে তা তুলে ধরাও যায়নি। দুর্বলতম ত্রিপুরা তৃণমূলের কাছে এর থেকে বেশি আশা করাও ঠিক হয়নি৷ বিশাল রাজ্য কমিটি হয়েছে৷ কমিটিতে যারা ঢুকেছেন তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ গলি-র নেতাও নন৷ এদের যোগ্যতা সীমিত৷

শুধুই কন্যাশ্রী, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার বা দুয়ারে সরকারের আশ্বাস দিয়ে বিরোধী রাজ্যে ভালো ফল আশা করা মূর্খামি৷ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে ময়দানে নামলেও গ্রাউণ্ড লেভেলের দায়িত্বে যারা ছিলেন, তারা স্রেফ ভুল বুঝিয়ে গিয়েছে তাঁকে৷ এ ভাবে ভোটে সাফল্য আসতে পারেনা৷ তাই চার প্রার্থীর জামানত জব্দ হওয়া আশ্চর্যজনক কিছু ফল নয়৷

২০২৩-এর নির্বাচনে লড়তে হলে তৃণমূল নেতৃত্বকে নতুন করে ভাবতে হবে৷ ভাবতে হবে কংগ্রেস এবং তিপ্রামোথার সঙ্গে জোট করে ভোটে যাওয়া যায় কি'না, সে কথাও৷ বাংলা থেকে ভোট বোঝেন, এমন অভিজ্ঞতাসম্পন্ন নেতাদের এখন থেকেই ত্রিপুরায় স্থায়িভাবে পাঠিয়ে দিতে হবে৷ বিরোধী দল হিসেবে শুধুই সন্ত্রাস-সন্ত্রাস করে চিৎকার করলে বা পরাজয়ের অজুহাত হিসেবে সন্ত্রাসকে খাড়া করলে শাসক দল কোন নজরে সেই আর্তনাদকে দেখে, তৃণমূল তো নিজেই সেই পথ তৈরি করেছে বাংলায়৷

হোম ওয়ার্ক না করে স্রেফ হালকাভাবে ভোটকে দেখার মাশুল দু-দুবার দিতে হলো তৃণমূলকে৷ এর ফলে জাতীয়স্তরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবমূর্তিতে একটু হলেও আঘাত লেগেছে৷ আগামী দিনে আবারও দলের সুপ্রিমোর মর্যাদা ক্ষুন্ন করার ঝুঁকি তৃণমূল নেতারা নেবেন কি'না, সেটাই এখন বড়ভাবে দেখতে হবে৷

More Articles