নিয়ন্ত্রণে নেই অশান্ত মন? ২০০০ বছরের প্রাচীন চিনা রীতি বদলে দিতে পারে জীবন

Wu wei Chinese Mental Health Mantra: এ খানিক চোখ খোলা রেখে ধ্যানস্থ হওয়া। উ-ওয়ে জীবনের নানা ঘটনাকে স্বাভাবিকভাবে ঘটতে দেওয়ার কথা বলে।

কিচ্ছু ঠিক হচ্ছে না। দিনের পর দিন যেন কিচ্ছু ঠিক নেই। অথচ কীভাবে সব গুছিয়ে ফেলা যায়, কীভাবে নিজেকে সরিয়ে আনা যায় এই পাকদণ্ডী রাস্তা থেকে উপায়ও মেলে না। সকাল থেকে রাত গড়িয়ে যায় অথচ জীবনের চরম টালমাটাল বাঁকগুলোতে এসে জীবনের দু'পেয়ে গাড়ি বুঝতে পারে না এগোবে না পিছোবে। ওই একই বাঁকে পাক খেতে খেতে চাকার গায়ে শ্যাওলা লেগে যায়। বিষাক্ত আগাছা ক্রমেই ছেয়ে ফেলে সম্পূর্ণ দেহ, মাথা। মুক্তি নেই? একটা দরজা বন্ধ থাকলে, অন্য খোলা দরজা কোথাও না কোথাও খোলা থাকেই, এমনটাই বলেন বিশ্বাসীরা। আমাদের মনের এই গহনের একটি এমন দরজাই লুকিয়ে আছে চিনে! মনের দরজা চিনে? এ কেমন!

আসলে প্রতিটি প্রাচীন সংস্কৃতিতেই জীবনশৈলীর নানা আঙ্গিক থাকে, এক এক স্থানের মানুষ জীবনকে এক এক ভাবে দেখেন। জীবনের বিষাক্ত খাদে পড়ে বেঁচে ওঠার জন্য তাঁদের সবার মন্ত্র পৃথক। জাপানের মানুষরা যেমন বেশ কিছু রীতি মেনে চলেন। দীর্ঘদিন ধরে মেনে চলতে চলতে বদলও এসেছে বৈকি! হতেও তো পারে, আমাদের টলমলে জীবনের মলম লুকিয়ে আছে চিনে। আসলে চিনে একটি প্রাচীন ধারণা রয়েছে, ‘wu wei'। উচ্চারণ করলে বিষয়টা দাঁড়ায় 'উ-ওয়ে'। ধারণার বয়স প্রায় ২,০০০ বছরের কাছাকাছি। এই উ-ওয়ে বলছে 'নন-অ্যাকশন' বা প্রচেষ্টাহীন ক্রিয়ার কথা। চিনের মানুষদের বিশ্বাসে, এই নন অ্যাকশনই আমাদের আরও ভারসাম্যযুক্ত, পরিপূর্ণ এবং সফল জীবনযাপন করতে সাহায্য করতে পারে।

আরও পড়ুন- জীবনযাপনে ছোট্ট বদল, আমার আপনার থেকে অনেক বেশিদিন বাঁচেন জাপানিরা

উ-ওয়ে মানে আসলে প্রায় শূন্য প্রচেষ্টা। মানে জীবনে যাই হয়ে যাক না কেন, যত সংকটই আসুক না কেন, আমি কিচ্ছুটি না করে পায়ের উপর পা তুলে ভাবজগতে রইব? একেবারেই তা না। বলা যেতে পারে এ খানিক চোখ খোলা রেখে ধ্যানস্থ হওয়া। উ-ওয়ে জীবনের নানা ঘটনাকে স্বাভাবিকভাবে ঘটতে দেওয়া এবং সেগুলি নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়ার মরিয়া চেষ্টা ছেড়ে দেওয়ার কথা বলে। প্রয়োজনে পদক্ষেপ করার উপর জোর দেয়, তবে অতিরিক্ত প্রচেষ্টা এবং উত্তেজনায় নিজেকে ভাসিয়ে দেওয়ার কথা বলে না। অর্থাৎ, রবিঠাকুর অনেককাল আগেই বলে গেছেন যে কথা। ভালো মন্দ যাহাই আসুক, সত্যেরে লও সহজে। জীবন যেমন ঘাড় ধরে যে পথে নিয়ে যাচ্ছে, যেখানে ডুবিয়ে দিচ্ছে, যেখানে ভাসিয়ে দিচ্ছে, দিতে দাও। সমস্ত ঢেউই আছড়ে পড়ে ফের ফিরে যায়। 

গবেষণায় দেখা গেছে, উ-ওয়ে মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ কমাতে সাহায্য করে। জীবনে সন্তুষ্টি এবং সামগ্রিক সুস্থতা বাড়াতে পারে। উ-ওয়েকে কীভাবে দৈনন্দিন জীবনের অংশ করা যায়?

১. যা যেমন তাকে সেভাবেই তেমন গ্রহণ করুন

জীবনে যা ভেবেছেন, কিচ্ছুটি নাও হতে পারে। প্রচুর পরিকল্পনা করে এগোলেন অথচ দেখা গেল এক দিন সমস্তটা ঘেঁটে গেল। জীবন কেন, এই ঘণ্টাখানেক পরে যে কাজ করবেন ভেবেছেন, যেখানে যাবেন ভেবেছেন সবটাই তো ভেস্তে যেতে পারে। চাকরির পদোন্নতির কথা ভাবছেন, নাও তো পেতে পারেন। কেন পেলেন না এই নিয়ে সুস্থ জীবনকে অসুস্থ করার চেয়ে ভাবুন, এটি আপনার জীবনযাত্রার এক স্বাভাবিক অংশ। সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না, তবে যাই ঘটুক না কেন নিজের সেরাটা করতেই পারেন। এটুকুই আপনার হাতে।

আরও পড়ুন- টানটান যৌবন থেকে লম্বা আয়ু, কোন রহস্য লুকিয়ে জাপানিদের অভ্যাসে?

কোনও কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়লে নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন ফলাফলের উপর আপনার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ আছে কিনা। যদি তা না করেন তবে তা শান্ত মনে স্বীকার করুন এবং চরৈবেতি।

২. অপূর্ণতাকে স্বীকার করুন

প্রতিটি বিষয় নিজের মতো করে অবস্থা করে। কোনও কিছুই কখনও নিখুঁত নয়। যদি নতুন কিছু শেখেন, নতুন কিছুর চেষ্টা করেন ভুল তো হবেই। তার জন্য শেখা বদলায় না। কেন ভাবছেন, নির্ভুল হতেই হবে? কেন সোনার হরিণ চাই বলে দৌড়চ্ছেন? এখানেও রবিঠাকুর, যা ছিল তা গেল ঘুচে, যা নেই তার ঝোঁকে! অসম্ভব কোনও কিছু অর্জনের জন্য নিজেকে নির্যাতন করার অর্থ কী?

৩. মননশীল হন

মননশীল হওয়া মানে কোনও বিচার ছাড়াই নিজের চিন্তাভাবনা এবং অনুভূতি সম্পর্কে সচেতন হওয়া। আপনার চারপাশের সমস্ত ছোট ঘটনাকে লক্ষ্য করুন। সূর্যের আলো ত্বকে এসে পড়লে কেমন লাগে? পাখির ডাক কেন আনমনা করা? পাতা মাড়িয়ে যাওয়ার শব্দ কেমন? প্রকৃতির শব্দ শুনুন, ফুলের গড়ন, রঙ সব মন দিয়ে দেখুন। এই মুহূর্তে যা ঘটছে তার প্রতি যদি মনোযোগ দিতে পারেন, জীবনে উ-ওয়ে প্রয়োগ করা অনেক সহজ হয়ে যায়।

আসলে হতাশ মানুষ অতীতেই বাঁচেন। উদ্বিগ্ন মানুষ ভবিষ্যতে। যে জন শান্তিতে থাকেন, তিনিই এই বর্তমানের মধ্যে রয়েছেন।

More Articles