২০২৪ নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদি বনাম কে? এখন থেকেই উত্তর খোঁজার চেষ্টায় বিজেপি বিরোধীরা
2024 Loksabha Election Narendra Modi : সামনের বছর, ২০২৪ সালেই লোকসভা নির্বাচন। যত সময় আসছে, প্রতিটা দলই নিজের নিজের শক্তি মেপে নিচ্ছে।
২০২২-এর শেষটা ভারতীয় জনতা পার্টির কাছে একটা ঝড় এনে দিল। সেই ঝড়ের নাম গুজরাত। ১৯৯৫ সাল থেকে ভারতের এই রাজ্যে বিজেপির একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকার। কেশুভাই প্যাটেল হয়ে নরেন্দ্র মোদি, আনন্দিবেন প্যাটেল হয়ে ভূপেন্দ্রভাই প্যাটেল – বারবার বিজেপির গেরুয়া পতাকাই উড়েছে সেখানে। তবে ২০২২ সাল একটু আলাদা ছিল। গত বছরের গুজরাত নির্বাচনে আগের সমস্ত রেকর্ড ভেঙে জয়ী হয়েছে বিজেপি। ১৮২ টির মধ্যে ১৫৬ টি আসন পেয়েছে কেন্দ্রের শাসক দল। মোরবি সেতু বিপর্যয়ের পরও গুজরাতের মানুষ যে গেরুয়া শিবিরের ওপর ভরসা রেখেছে, তা ফলাফল ও পরিসংখ্যান থেকেই স্পষ্ট।
এমন তথ্য দিয়ে কেন শুরু করা? কারণ গুজরাতের বিপুল জয় বাদ দিলে বাকি ছবিটা বিজেপির কাছে খানিক শঙ্কারই। ২০২২-এই হিমাচল প্রদেশের বিধানসভা নির্বাচন সংগঠিত হয়। সেখানে অবশ্য জাতীয় কংগ্রেস আসল বাজিমাত করেছে। দিল্লির পর পাঞ্জাবেও তাঁবু খাটিয়েছে অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং তাঁর আম আদমি পার্টি। দিল্লির পুর নির্বাচন এতদিন ছিল বিজেপির দখলে। ২০২২-এ সেখান থেকেও ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে তারা। ঠিক তার আগের বছর, ২০২১ সালে প্রবল শক্তি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ জয়ের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বিজেপি। কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে হেরে যায় গেরুয়া ব্রিগেড।
বছর শুরুর সময় এত ভোটের পরিসংখ্যান কেন? কারণ, সামনের বছর, ২০২৪ সালেই লোকসভা নির্বাচন। উত্তর প্রদেশ নির্বাচন থেকেই তার দামামা বেজে গিয়েছে। কিন্তু যত সময় আসছে, প্রতিটা দলই নিজের নিজের শক্তি মেপে নিচ্ছে। সেই খেলায় একটু হলেও চিন্তার মুখে বিজেপি। কারণ? সাম্প্রতিক ফলাফল। গুজরাতের বিরাট জয় অক্সিজেন দিয়েছে বটে, কিন্তু শঙ্কা সেখানেও ছিল। ইতিমধ্যেই দিল্লিতে সামান্য হলেও দাঁত ফুটিয়েছে আপ। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে সম্মুখ সমরে নামবেন খোদ নরেন্দ্র মোদি। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে নিশ্চিতভাবেই তিনি থাকবেন। বিজেপির নেতা হিসেবে মোদি আর অমিত শাহের জুটির ওপরই ভরসা করতে হবে বিজেপিকে।
আরও পড়ুন : আবারও নির্বাচনের দামামা, সোশ্যাল মিডিয়ায় কেমন লড়ছে বিজেপি থেকে বিরোধীরা
শাসকপক্ষের উল্টোদিকে বিরোধীদের অবস্থাটা এখন ঠিক কী? বিজেপি নেতারা বারবার যে প্রশ্ন তুলে এসেছেন, আজও সেই একই প্রশ্ন রয়ে গেছে। লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদির বিপক্ষে কে দাঁড়াবেন? মোদি বনাম কে? এই প্রশ্নের উত্তর এখনও অমীমাংসিত। দেশজুড়ে অনেক নাম উঠে আসছে। বিরোধীদের মুখ হওয়ার দৌড়ে কেউ এগোচ্ছেন, কেউ পিছোচ্ছেন। কিন্তু একটা স্থায়ী নাম এখনও সামনে আসেনি।
গুজরাত ভোটের পর অন্যতম মূল শক্তি হিসেবে উঠে এসেছে আম আদমি পার্টি। একটা সময় বদনাম ছিল, দিল্লির বাইরে ভারতের ‘মাফলার ম্যান’-এর দৌড় শেষ। কিন্তু সেই কথাটিকে ভুল প্রমাণ করে দিয়েছেন দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। ভারতের রাজধানীর পাশাপাশি এবার পাঞ্জাবেও জয় ছিনিয়ে এনেছে তাঁর পার্টি। গুজরাতের মতো কঠিন নির্বাচনে আপ দাঁড়াতেই পারবে না বলে ভেবেছিলেন অনেকে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে পাঁচটি আসন জিতে নেয় কেজরিওয়ালের দল। উল্লেখ্য, আগের নির্বাচনে একটি আসনও জেতেনি আপ। সেই জায়গায় নতুন করে ভোটার তৈরি করা, একটা জায়গা তৈরি করা অবশ্যই আপের বড়ো কৃতিত্ব। নির্বাচনী জনসভায় বারবার ছুটে গিয়েছেন কেজরিওয়াল। গুজরাতে বিজেপির দুর্নীতি ও অন্যান্য ইস্যু নিয়ে লাগাতার ভাষণ দেন। সেটা যে একেবারে বিফলে যায়নি, ফলাফলেই তার প্রমাণ। মূলত পাঞ্জাব আর গুজরাত নির্বাচনের পরই বিরোধী শক্তি হিসেবে আপের প্রাধান্য বেড়ে যায়। একটু হলেও বিরোধী মুখ হিসেবে এগিয়ে যান কেজরিওয়াল। এখন অন্যান্য রাজ্যেও নিজেদের সংগঠন বাড়ানোর কাজে মন দিয়েছে আপ।
অন্যদিকে রয়েছে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস। একটা সময় যে দলটি বহু বছর ক্ষমতায় ছিল, সেই দলটির গ্রাফ আজ একেবারে খাতের দিকে। বিজেপি ও মোদির উত্থানই এর জন্য দায়ী নয়; সেইসঙ্গে রয়েছে আপ। পাঞ্জাব হোক বা গুজরাত, প্রতিটা জায়গায় কংগ্রেসের আসন কমেছে, ভোটারও কমেছে। আর তার সিংহভাগ চলে গিয়েছে আপের দিকে। ২০২২ গুজরাত নির্বাচনের আগে কংগ্রেসের আসন ছিল ৭৭ টি। সেখান থেকে গত নির্বাচনে সোজা ১৭ টি আসনে নেমে এল তারা।
আরও পড়ুন : ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ বুঝতেন অটল বিহারী, বাজপেয়ীর বিজেপির থেকে কোথায় আলাদা মোদির বিজেপি?
অন্যদিকে, আপের ভোট শতাংশ ছিল ০.১০। সেখান থেকে ১২.৯২ শতাংশে উঠে এসেছে তারা। ইউপিএ আমলে একের পর এক দুর্নীতি, কয়লা হোক বা ব্যাপম, জনগণের মধ্যে প্রভাব ভালোমতোই পড়েছে। সেইসঙ্গে রয়েছে পরিবারতন্ত্র। কংগ্রেস বিরোধী ঢেউয়ের হাত ধরেই আম আদমি পার্টির উত্থান। সেখানে ২০২৪-এ আদৌ কংগ্রেস নিজেদের জায়গায় ফিরতে পারবে কিনা, সন্দেহ অনেকের। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা নজর রেখেছেন সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হওয়া ‘ভারত জোড়ো যাত্রা’র দিকে। রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে সেই মহামিছিল ইতিমধ্যেই নজর কেড়েছে মানুষের। এখন এর হাত ধরে কি কংগ্রেস নিজের দুবন্ত তরী ভাসিয়ে তুলতে পারবে? ‘হাত’ কি শক্ত হবে?
স্বাধীনতার পর থেকে যত দিন গিয়েছে, জাতীয় রাজনীতির ময়দান বাইনারিতে ভেঙে গিয়েছে। একদিকে কংগ্রেস, অন্যদিকে ভারতীয় জনতা দল। পরবর্তীকালে সেই জায়গা নেয় ভারতীয় জনতা পার্টি। ইদানিং আঞ্চলিক দলগুলি একটু একটু করে নিজেদের ছাপ ফেলছে। যেমন, আপ। একটু একটু করে জাতীয় শক্তি হওয়ার দিকে এগিয়েছে, নিজের অবস্থান মজবুত করেছে। দিল্লিতে কেজরিওয়াল সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের কথা ছড়িয়ে পড়েছে দেশজুড়ে। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন সম্ভবত প্রথমবার বিরল এক দৃশ্য দেখতে চলেছে। যেখানে বিজেপি ও কংগ্রেসের পাশাপাহি আপও নিজের ছোবল মারার প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিজেপি বিরোধী মুখ হিসেবে কংগ্রেসকে বাদ দিলে অবশ্যম্ভাবী শক্তি হিসেবে উঠে আসবে অরবিন্দ কেজরিওয়াল।
অন্যদিকে, ২০২১ সালের নির্বাচনকে ভুললে চলবে না। প্রবল শক্তি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বিজেপি। কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেসের কাছে তাদের সেই প্রতিরোধ টেকেনি। আর এই পুরো ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে যিনি দাঁড়িয়ে, তাঁর নাম মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর শ্লোগান ছিল একটাই – ‘ভাঙা পায়ে খেলা হবে’। জাতীয় মঞ্চে বিজেপির যতটা শক্তি, রাজ্যস্তরে গিয়ে সেই দাপট যেন অনেকটাই কমে গিয়েছে। মহারাষ্ট্র, কর্ণাটক, গুজরাত, উত্তর প্রদেশের মতো কয়েকটি উদাহরণ বাদ দিলে এই ছবিই দেখা যাবে। ২০২১-এর পর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও বিজেপি বিরোধী মুখ হিসেবে উঠে এসেছিলেন।
আরও পড়ুন : বারবার বিজেপির হাতছাড়া রাজধানী! কোন চালে কিস্তিমাত আপ-এর?
কিন্তু তৃণমূলের ‘বাঙালি মহিলা প্রধানমন্ত্রী’র স্বপ্নে আঘাত দেয় জাতীয় পরিস্থিতি। জাতীয় স্তরে তৃণমূলের দাপট সেভাবে দেখা যায়নি এখনও। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সহ উচ্চস্তরের নেতারা চেষ্টা করলেও সেভাবে দাঁত ফোটাতে পারেনি তৃণমূল। গোয়া হোক বা ত্রিপুরা – ছবিটা সব জায়গায় একই। সেই জায়গায় অনেকটা সফল ইমেজ নিয়ে রাজনীতির ময়দানে দাঁড়িয়ে আম আদমি পার্টি। কিন্তু প্রশ্নটা এখনও রয়েই গিয়েছে। নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে কে? বিজেপি বিরোধী মুখ হিসেবে কে ভরসা দেবেন মানুষকে? কোনও একটি দল, না বিপক্ষের মহাজোট? নিজেদের অহং বিসর্জন দিয়ে কি একজন নেতাকে বেছে নিতে পারবে বিরোধীরা?