অবশেষ মুক্ত জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ! গোপনতম নথি ফাঁসের কারিগর কে এই 'হ্যাকার'?

Julian Assange Wikileaks: জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ লন্ডনে ইকুয়েডর দূতাবাসে সাত বছর বন্দি অবস্থায় কাটিয়েছেন।

পাঁচ বছর জেলের অন্ধকারে। ১৯০১ দিন জেলে কাটিয়ে অবশেষে মুক্ত জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। তবে এই পাঁচ বছরে জুলিয়ানের কথা বিস্মৃত হয়েছিলেন অনেকেই। অনেকেই ভুলে গেছিলেন একের পর এক গোপন নথি ফাঁস করে বিশ্ব তোলপাড় করে দিয়েছিলেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ। পাঁচ বছর পর ব্রিটিশ যুক্তরাজ্যের অন্তর্গত দক্ষিণ-পূর্ব লন্ডনের বেলমার্শ উচ্চ-নিরাপত্তা কারাগার থেকে মুক্তি পেলেন তিনি, জানিয়ছেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের স্ত্রী স্টেলা অ্যাসাঞ্জ। কিন্তু কে এই জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ? কেনই বা ৫ বছরের জেলভোগ?

জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের জন্ম ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে অস্ট্রেলিয়ার টাউনসভিলে। কিশোর বয়স থেকেই দক্ষ কম্পিউটার প্রোগ্রামার হিসেবে পরিচিতি হয় তাঁর। ১৯৯৫ সালে হ্যাকিংয়ের জন্য দোষী সাব্যস্ত হন জুলিয়ান। সেই সময় তাঁর জরিমানা করা হয়। জুলিয়ান মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত এবং পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন। এসব নিছকই সামান্য পরিচয়। জুলিয়ানকে শিক্ষা বা হ্যাকিং দিয়ে নয়, মানুষ মনে রেখেছে উইকিলিকস দিয়ে। ২০০৬ সালে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ উইকিলিকস চালু করেন। যারা এথিকাল হ্যাকার বা লিকার হতে চান, তাদের জন্যই তৈরি উইকিলিকস। ২০১০ সালের এপ্রিলে উইকিলিকস সাইটটি আলোচনায় আসে প্রথম। বাগদাদে ২০০৭ সালের মার্কিন হেলিকপ্টার হামলার ভিডিও প্রকাশ করে উইকিলিকস। সেই হামলাতে বহু মানুষের মৃত্যু হয়।

আরও পড়ুন- ‘ট্র্যাজিক মিসটেক’! রাফাহতে গণহত্যার পর ভুলস্বীকার আসলে কোন কৌশল নেতানিয়াহুর?

২০১০ সালে উইকিলিকস আফগানিস্তান যুদ্ধের ৯০,০০০টিরও বেশি মার্কিন সামরিক নথি এবং ইরাক যুদ্ধের প্রায় ৪০০,০০০টি গোপন ফাইল প্রকাশ করে। মার্কিন সামরিক ইতিহাসে সবচেয়ে বড় নিরাপত্তা লঙ্ঘন ছিল সেই ঘটনাটি। ২০১১ সালে, উইকিলিকস বিশ্বজুড়ে মার্কিন দূতাবাস থেকে ২৫০,০০০ গোপন কূটনৈতিক তথ্য প্রকাশ করেছিল।

এই গোপন তথ্যগুলি প্রকাশিত হতেই তথ্য মার্কিন রাজনীতিবিদ এবং সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে হইচই পড়ে যায়। এই গোপ তথ্য প্রকাশ মার্কিন যুক্ত্রারাষ্ট্রকে বিপদের ফেলেদেয়। উইকিলিকসে নথি ফাঁস করার কারণে প্রাক্তন সেনা গোয়েন্দা বিশ্লেষক চেলসি ম্যানিংয়ের সাত বছরের জেল হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা পরে ম্যানিংয়ের মুক্তি মঞ্জুর করেন।

২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সময় উইকিলিকস হিলারি ক্লিনটনের প্রচারাভিযানের চেয়ারম্যানের বিভিন্ন ইমেল ফাঁস করে আবারও শোরগোল ফেলে দেয়। ক্লিনটন ছিলেন ডেমোক্রেটিক দলের প্রার্থী। ২০২০ সালে মার্কিন সেনেটের একটি প্রতিবেদনে অভিযোগ করা হয়, রাশিয়া নাকি উইকিলিকসকে ব্যবহার করেই ডোনাল্ড ট্রাম্পকে রাষ্ট্রপতি পদে বসাতে পেরেছে। ট্রাম্প অবশ্য সেসব অস্বীকার করেন। রাশিয়াও নির্বাচনে হস্তক্ষেপের অভিযোগ অস্বীকার করে।

২০১০ সালের শেষের দিকে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ সুইডেনে আইনি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন। সুইডেনের দুই উইকিলিকস স্বেচ্ছাসেবক জুলিয়ানের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ আনেন। যার ফলে সুইডেনের একটি আদালত জুলিয়ানকে আটকের আদেশ জারি করে। সুইডেন থেকে পরের মাসেই ব্রিটিশ যুক্তরাজ্য কর্তৃপক্ষ জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে গ্রেফতার করে।

জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছিলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যে কোনও মতে তাঁকে নিয়ে আসার জন্যই এই ছক কষা হয়। পুরোটাই সাজানো যাতে কোনওভাবে জুলিয়ানকে মার্কিন হেফাজতে স্থানান্তর করা যায়।

২০১২ সালের জুন মাসে যুক্তরাজ্যের সুপ্রিম কোর্টের চ্যালেঞ্জে হেরে যাওয়ার পরে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ লন্ডনের ইকুয়েডর দূতাবাসে আশ্রয় চেয়েছিলেন। অগাস্ট মাসে তা মঞ্জুর করা হয়েছিল। জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ লন্ডনে ইকুয়েডর দূতাবাসে সাত বছর বন্দি অবস্থায় কাটিয়েছেন। সুইডিশ কর্তৃপক্ষ ২০১৭ সালে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত বন্ধ করে দেয় ঠিকই কিন্তু যুক্তরাজ্যর প্রশাসন জানায় জুলিয়ান দূতাবাস ছেড়ে গেলে জামিনের শর্ত লঙ্ঘনের জন্য তাঁকে গ্রেফতার করা হবে।

এই সময়ই, জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ও তাঁর সঙ্গী স্টেলা মরিসের দুই সন্তান জন্মায়। পরে, ২০২২ সালে তারা বিয়ে করেন। বিয়ের অনুষ্ঠানটিও হয় বেলমার্শ কারাগারেই। ২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল জুলিয়ানের জীবন তোলপাড় হয় ফের। ইকুয়েডর সরকার আর আশ্রয় দিতে চায়নি জুলিয়ানকে। ফলে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। জামিনের শর্ত লঙ্ঘনের ফলস্বরূপ জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে ৫০ সপ্তাহের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন- ১৯৭৭ আর ২০২৪: ইন্দিরা আর মোদির দুই নির্বাচনে কী কী আশ্চর্য মিল?

মার্কিন সরকার ২০১৯ সালের জুনে অ্যাসাঞ্জের বিরুদ্ধে আরও ব্যবস্থা নেয়। জুলিয়ানের বিরুদ্ধে ১৮টি অভিযোগ ছিল, যেগুলি সবই মার্কিন সরকারের কম্পিউটার হ্যাক করার ষড়যন্ত্র এবং গুপ্তচরবৃত্তি সংক্রান্ত। উইকিলিকসের প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে সাজা শেষ হওয়ার পরেও লন্ডনের বেলমার্শ সর্বোচ্চ নিরাপত্তা কারাগারেই ছিলেন। ২০২১ সালে, যুক্তরাজ্যের একজন বিচারক তাঁর মানসিক সুস্থতা এবং আত্মহত্যার চেষ্টার আশঙ্কার উদ্বেগ দেখিয়ে অ্যাসাঞ্জকে না ফেরানোর সিদ্ধান্ত নেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চিকিত্সা বিষয়ক গ্যারান্টি দিয়ে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে সফলভাবে সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল করে।

২০২২ সালের যুক্তরাজ্য জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে ফেরানোর সবুজ সংকেত দেয়। অ্যাসাঞ্জ মার্কিন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী, মার্কিন আদালতে জাতীয় প্রতিরক্ষা তথ্য জোগাড় এবং প্রকাশের জন্য দোষ স্বীকার করবেন। চুক্তির অংশ হিসাবে, অ্যাসাঞ্জের ৬২ মাসের কারাদণ্ড হতে পারে, যা ইতিমধ্যেই তিনি কাটিয়ে ফেলেছেন বলে সম্ভবত এবার দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের অবসান ঘটতে চলেছে।

More Articles