অশুভ আত্মা তাড়ানোর উৎসব! হ্যালোউইনের অজানা গল্প জানলে শিউরে উঠতেই হবে

Halloween: কীভাবে শুরু হলো এই ভুতুড়ে উৎসব?

সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিওলে হ্যালোইন পার্টির সময় শত শত মানুষ মারা গিয়েছেন। ফলত ফের চর্চায় উঠে এসেছে এই উৎসব। প্রতিবছর ৩১ অক্টোবর পশ্চিমী দেশগুলিতে পালিত হয় হ্যালোউইন বা হ্যালোইন (Halloween)। ‘হ্যালোউইন’ শব্দটি এসেছে স্কটিশ ভাষার শব্দ ‘অল হ্যালোজ ইভ’ থেকে। যার অর্থ হলো ‘পবিত্র সন্ধ্যা’। মনে করা হয়, এই হ্যালোউইন উৎসবটি প্রথম শুরু হয়েছিল আয়ারল্যান্ড এবং স্কটল্যান্ডে। বর্তমানে এটি সমগ্র ইউরোপ, আমেরিকা, এশিয়াজুড়ে অনেক দেশেই পালিত হয়। ধীরে ধীরে এর জনপ্রিয়তা অনেক বেড়েছে। হ্যালোউইন সম্পর্কে প্রত্যেকেরই আলাদা আলাদা বিশ্বাস রয়েছে। অনেক দেশে বিশ্বাস করা হয় যে, এই উৎসব বা প্রথা পূর্বপুরুষদের আত্মাকে শান্তি দেবে। আবার অনেকে মনে করেন, যাতে অশুভ আত্মা কোনও ক্ষতি করতে না পারে, তাই তাকে দূরে রাখার উৎসব হলো হ্যালোউইন।

কীভাবে শুরু হলো এই উৎসব? প্রায় দু’হাজার বছর আগে বর্তমান আয়ারল্যান্ড, ইংল্যান্ড ও উত্তর ফ্রান্সে বাস করতেন সেলটিক জাতির মানুষ। হ্যালোউইন উৎসব পালন শুরু করেছিলেন তাঁরাই। সেলটিক ক্যালেন্ডার অনুযায়ী, অক্টোবরের শেষ দিন, অর্থাৎ ৩১ অক্টোবর হলো বছরের শেষ। ১ নভেম্বর থেকে শুরু হয় নতুন বছর। বছরের শেষ দিন, অর্থাৎ ৩১ অক্টোবরের রাতে প্রেতাত্মা ও অতৃপ্ত আত্মারা আবার তাদের পুরনো জীবনে ফিরে আসতে চায়। তারা তাদের আত্মীয় পরিজনদের কাছে ফিরে আসতে চায়। তাদের সঙ্গে যদি কারও দেখা হয়, তবে তাঁর ক্ষতি হতে পারে। এই বিশ্বাস থেকে মানুষ এই সন্ধ্যায় একা কাটাতেন না। রাতে আগুন জ্বেলে তার পাশে বৃত্তাকারে একসঙ্গে ঘুরতে ঘুরতে মন্ত্র বলতেন, নাচতেন এবং সময় কাটাতেন। নিজের বাড়িতে সদস্য-সংখ্যা কম হলে অন্যের বাড়িতে একসঙ্গে থাকতেন। মোট কথা কেউ একা থাকার সাহস পেতেন না।

এই রাতে সেল্টিকরা নিজেদের ঘরের সামনে খাবার রেখে দিত। উদ্দেশ্য থাকত, মৃতদের জগৎ থেকে উঠে আসা খারাপ আত্মারা যেন এই খাবার পেয়ে সন্তুষ্ট হয়ে চলে যায়, ঘরের ভেতর যেন আর না প্রবেশ করে। আবার অনেকের মতে আত্মারা ত্রিকালদর্শী। তারা ভূত-ভবিষ্যৎ সব জানে। ফলত সেই আত্মাদের যদি প্রসন্ন রাখা যায়, তাহলে ভবিষ্যতে উন্নতি এবং সমৃদ্ধি হতে পারে। মধ্যযুগের সেল্টিকরা এই যে উৎসবটি পালন করত, এটির নাম ছিল ‘সাহ উইন’। পরবর্তীকালে রোমান সভ্যতায় এই উৎসবের বাড়-বাড়ন্ত দেখা যায়। সময়ের সঙ্গে এর নাম পরিবর্তিত হয়ে হয় হ্যালোউইন। এই উৎসবটিকে খানিকটা আমাদের ভূত চতুর্দশীর সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে।

আরও পড়ুন: ট্রেন্ডিং ভেগান লাইফস্টাইল! জানেন শরীরে বাদ পড়ে যাচ্ছে কোন কোন জরুরি পুষ্টি?

খ্রিস্ট ধর্মমতে এই উৎসবের পরের দিন, অর্থাৎ ১ নভেম্বর হলো ‘অল সেইন্টস ডে’ বা ‘অল সোলস ডে’। এই দিন সেই অর্থে বড় করে কোনও উৎসব পালিত না হলেও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী মানুষরা গোরস্থানে গিয়ে তাদের পূর্বপুরুষদের আত্মার শান্তি কামনা করে আসেন। এবার প্রশ্ন উঠতে পারে, এই হ্যালোউইন শুভ না অশুভ? এর উত্তর আমি একটু অন্যভাবে দেওয়ার চেষ্টা করছি। আসলে এই হ্যালোউইনের দিনে মানুষ অশুভ শক্তির হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করে তাদের তুষ্ট রেখে। এই কারণেই ছোট বাচ্চাদের ভূত সাজিয়ে তাদের চকোলেট, লজেন্স ইত্যাদি ট্রিট দেওয়া হয়। এবার এই উৎসব শুভ না অশুভ, তাতে বিশেষ মাথা ঘামান না মানুষ। যে কোনও উৎসবে আনন্দটাই আসল।

প্রতি বছর অক্টোবরের শেষ দিন, অর্থাৎ, ৩১ অক্টোবর সন্ধ্যা নামলেই ইউরোপ, আমেরিকা-সহ বিশ্বজুড়ে শুরু হয়ে যায় ভূতের নৃত্য; সব জ্যান্ত, ছোট ছোট, মিষ্টি ভূত। পৃথিবীতে যত ভূতপ্রেত আছে, সবাই যেন এই রাতে চলে আসে লোকালয়ে। তবে শুধু ভূত নয়, জলদস্যু, ভ্যাম্পায়ার, স্পাইডারম্যান, জম্বি এবং ব্যাটম্যান- সবই ঘুরে বেড়ায়। সব বাচ্চারা রংবেরঙের পোশাক পরে ভূত সেজে ঘুরে বেড়ায় সর্বত্র। সবার গায়ে থাকে অদ্ভুতুড়ে কস্টিউম। আর হাতে থাকে টর্চ এবং চকোলেট ভরার জন্যে একটি বড় ব্যাগ। পাড়ার সব বাড়িতে গিয়ে তারা দরজায় কড়া নাড়ে এবং দরজা খুললে বলে, ট্রিক অর ট্রিট। সবাই সাধারণত ট্রিট দিয়ে দেয় বাচ্চাদের। সেই ট্রিটে থাকে নানা রকমের চকলেট, লজেন্স, কেক, পেস্ট্রি ইত্যাদি। হ্যালোউইন উৎসবে মেক আপ ও কস্টিউম খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নানা ধরনের মুখোশ, বিভিন্ন ভীতিকর পোশাক পরে বাচ্চারা ভূত সাজতে খুব পছন্দ করে এই উৎসবে।

কালীপুজো বা দিওয়ালিতে যেভাবে আমাদের এখানে টুনি-লাইট দিয়ে সাজানো হয়, ঠিক সেভাবেই এই উৎসবে বাড়ি সাজানো হয় মাকড়সার জাল এবং লাল বা কমলা লাইট দিয়ে। তবে এই উৎসবে আর কেউ কিছু দিয়ে সাজাক না সাজাক, কুমড়ো দিয়ে ঘর সাজানো কিন্তু অপরিহার্য। ছুরি দিয়ে কুমড়োর গায়ে চোখের আকৃতির ছোট গর্ত করে, ভেতরে বাতি জ্বালিয়ে তৈরি করা হয় প্রতীকী দৈত্য ‘জ্যাক ও'লার্টেন’।

এছাড়াও কুমড়োর দিয়ে রকমারি উপাদেয় খাদ্যও তৈরি হয় এই উৎসবে। এই দিনে লোকেরা তৈরি করেন হ্যালোউইন কেক। এছাড়া কুমড়ো, বাদুড় এবং পোকা-মাকডড়ের আকারের ক্যান্ডিও তৈরি করা হয়। পাশাপাশি কুমড়োর পিঠে, কুমড়োর ব্রেড, পপকর্ন, পাউন্ড কেক, কুমড়ার পিউরি দিয়ে তৈরি মোরব্বা, কুমড়োর বীজভাজা এবং মিষ্টি ভুট্টাও তৈরি করা হয়। এছাড়াও হ্যালোউইনে কিন্তু দারুণ অর্থনৈতিক লাভ হয় বিশ্ববাজারে। ইউরোপ এবং আমেরিকায় কনফেকশনারি'স ইন্ডাস্ট্রি-তে ক্রিসমাস বাদে সবচেয়ে বেশি এই সময়ই লাভ হয়। ভারতে এই উৎসব খুব একটা জনপ্রিয় না হলেও বিভিন্ন অভিজাত এলাকায় বর্তমানে শুরু হয়েছে হ্যালোউইন পালন। আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক স্টার এবং সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারদের দেখা যায় হ্যালোউইন পার্টি উদযাপন করতে। মানুষ বরাবরই উৎসবপ্রিয়। কে বলতে পারে, কয়েক দশক পর হয়তো অন্যান্য উৎসবের মতোই হ্যালোউইনও ধুমধাম করে পালিত হবে আমাদের দেশে।

More Articles