সিঙ্গল মাদার, সাহিত্যপ্রেমী || ধর্ষণের মামলায় দময়ন্তীই কেন সেরা অফিসার?

পার্ক স্ট্রিটের সেই সুজেট জর্ডনকে মনে পড়ে? খাস কলকাতার অভিজাত এলাকায় ধর্ষিত হয়েছিলেন সুজেট, আজ থেকে প্রায় এক দশক আগে। সালটা ২০১২। ফেব্রুয়ারি মাসে শহরের এক পাঁচতারা নাইট ক্লাবের বাইরে থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করা হয়েছিল সুজেটকে। অভিযোগের আঙুল উঠল বর্তমান তৃণমূল সাংসদ-অভিনেত্রী নুসরত জাহানের তৎকালীন প্রেমিক কাদের খানের বিরুদ্ধে। সুমিত বজাজ, নাসির খান এবং রুমান খান এই মামলায় ধরা পড়লেও, কাদের এবং তাঁর ঘনিষ্ট বন্ধু আলিকে বাঁচানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে শুরু করলেন অভিনেত্রী নুসরত জাহান। 

তারপর তদন্তের নামে যা শুরু হলো, অনেকের চোখেই তা আদতে প্রহসন। একদিকে যখন অভিনেত্রী ব্যস্ত তাঁর 'ধর্ষক' প্রেমিককে পালাতে সাহায্য করতে, সেই সময়েই আবার ঘটনাটিকে ধামাচাপা দিতে মাঠে নামল শাসক দল তৃণমূল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘটনার চাপ আন্দাজ করতে পেরে নিজেই মিডিয়ার সামনে ভরা মঞ্চে ঘোষণা করলেন, "এটা ছোটো ঘটনা", "সাজানো ঘটনা"। কাকলি ঘোষদস্তিদার আবার সমস্ত সীমাই লঙ্ঘন করে গেলেন শালীনতার। আন্তর্জাতিক মিডিয়ার এক সাক্ষাৎকারে ওই তৃণমূল নেত্রী সদর্পে ঘোষণা করলেন, পার্ক স্ট্রিট নাকি কোনও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেইনি, ওই মহিলা (ধর্ষিতা) এবং তাঁর 'খদ্দের'-দের মধ্যে শুধু একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। 

সারা বিশ্বের কাছে মুখ পুড়ল তৃণমূলের। ধর্ষিতা ওই মহিলা নিজেই দাবি রাখলেন, "আমাকে কি বলতে চাইছেন সাংসদ? আমি দেহোপসারিনী? এ রেপ ইজ এ রেপ!" প্রশ্ন উঠল মহিলার চরিত্র নিয়েও। তৃণমূল নেতারা জায়গায় জায়গায় সালিশি সভা বসিয়ে প্রশ্ন রাখলেন, 'এত রাতে ওই মেয়েটা ওখানে কী করছিল?', 'মেয়েটার চরিত্র কেমন?' 

আরও পড়ুন: তৃতীয় জয়ের এক বছরেই নড়বড়ে তৃণমূল? দল কি ভাঙছে আড়াআড়ি?

এমন অবস্থাতেই এই হাই প্রোফাইল কেসের দায়িত্ব গিয়ে পড়ল ১৯৯৬ ব্যাচের এক আইপিএস অফিসারের হাতে। তিনি এসেই যেন পুরো ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দিলেন। খুঁজে বের করলেন কিছু পুরোনো সিসিটিভি ফুটেজ, তাতে স্পষ্ট মিলল ধর্ষণের প্রমাণ। মুহূর্তের মধ্যেই লাইমলাইটে এসে গেলেন আইপিএস দময়ন্তী সেন। পরিষ্কার মিডিয়ায় এসে জানালেন, এটা ধর্ষণের ঘটনা, এবং তাঁর কাছে প্রমাণ আছে এই ঘটনার। কিন্তু এই পুলিশ অফিসারের অতি উৎসাহকে খুব একটা ভাল চোখে দেখল না শাসক দল। দেশজুড়ে বিতর্কের ঝড় উঠল তৃণমূলের বিরুদ্ধে। দোষীদের আড়াল করার আর তদন্তকে প্রভাবিত করার অভিযোগ উঠলো খোদ মাননীয়ার বিরুদ্ধেই।

আজও অনেকেই বলে থাকেন, সেদিন একরকম নিজের জেদের জন্যই পার্কস্ট্রিট ধর্ষণকাণ্ডের তদন্ত এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন দময়ন্তী সেন। মূল অভিযুক্ত অধরা থাকলেও, একে একে অন্যান্য অভিযুক্তরা ধরা পড়তে শুরু করে। কিন্তু আচমকাই ঘুরে যায় সম্পূর্ণ ছবিটা। লহমায় তদন্তের সাফল্য যেন বদলে গেল দুর্ভাগ্যে। মুখ্যমন্ত্রী এবং পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে বৈঠকের পর দময়ন্তী জানিয়েছিলেন, এই সাফল্য তাঁর একার নয়, তাঁর পুরো টিম একসঙ্গে কাজ করেছে। কিন্তু, দময়ন্তীকে কোপে পড়তেই হয়। তদন্ত চলাকালীন, মাত্র দু'মাসের মধ্যে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ পদে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে। রাজনীতির অন্দরে কান পাতলে শোনা যায়, সেদিন দময়ন্তী সেন ওই কথাগুলো বলেছিলেন কার্যত চাপের মুখেই। সেদিনের আইপিএস দময়ন্তী সেনের চেহারায় না কি চাপের ছাপ ছিল স্পষ্ট। গোয়েন্দা প্রধানের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে হঠাৎ করেই রাজ্য পুলিশের ডিআইজি করে দেওয়া হয় তাঁকে। তাঁকে পোস্ট দেওয়া হয় দার্জিলিং রেঞ্জে। টানা সাত বছর পর আবারও ২০১৯ সালে কলকাতায় ফেরেন দময়ন্তী সেন। কলকাতা পুলিশের অতিরিক্ত নগরপাল পদে যোগ দেন তিনি। সেখান থেকেই কলকাতা পুলিশের স্পেশাল কমিশনার হিসেবে কাজ শুরু।

সাম্প্রতিকে কলকাতা হাই কোর্টের প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তব ও বিচারপতি রাজর্ষি ভরদ্বাজের ডিভিশন বেঞ্চের রায়ের পর চারটি ধর্ষণ মামলার তদন্তভার এল দময়ন্তীর কাঁধে।

পুলিশের উর্দির বাইরে কেমন দময়ন্তী?

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি কেমন? পুলিশের উর্দির বাইরেও কি তিনি একইরকম কঠোর? সিঙ্গল মাদার হয়েও তিনি কীভাবে সবদিকে ব্যালেন্স করে চলেন? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পাশ করা দময়ন্তী সেনের পুলিশে চলে আসাটা খানিকটা আকস্মিকই বলা চলে। শোনা যায়, তিনি প্রথমে চেয়েছিলেন আইএএস হতে। কিন্তু তারপর পরীক্ষা দিয়ে ভাগ্যে জোটে আইপিএস। ১৯৯৬ ব্যাচের আইপিএস অফিসার দময়ন্তী সেনের উত্থান ছিল সত্যি নজরকাড়া। প্রথমেই দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার অ্যাসিস্ট্যান্ট পুলিশ সুপার থেকে নিজে কর্মজীবন শুরু করেন দময়ন্তী সেন। সেখান থেকেই দ্রুত এসপি এবং কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের ডেপুটি কমিশনার থেকে জয়েন্ট কমিশনের অফ ক্রাইম পদে পদোন্নতি। কিন্তু, পুলিশের উর্দি খুলে রাখলে, তিনি একেবারেই ঘরোয়া একজন মহিলা। ছেলে স্কুলে পড়ার সময় তাঁর স্কুলের পিকনিকে রান্না পর্যন্ত করেছেন তিনি। বাংলা সাহিত্য পড়তে ভালবাসেন, আর তাঁর প্রথম পছন্দ রবীন্দ্রসংগীত। ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে খুব একটা মুখ খুলতে না চাইলেও, তাঁর ব্যাপারে জানতে আগ্রহী মানুষের অভাব নেই। বিশেষত, পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ মামলা থেকে তাঁর নাম যখন চর্চায় এল, তখন থেকেই তাঁর ব্যক্তিগত জীবন ও কেরিয়ার নিয়ে আগ্রহীদের চর্চা শুরু। 

ঝুঁকেগা নেহি...

তাঁর কেরিয়ারের অসাধারণ গ্রাফ প্রমাণ করে, তিনি একজন দক্ষ ও মেধাবী আইপিএস অফিসার। কিন্তু, এই সবকিছুই কেমন একটা ওলটপালট করে দিয়েছিল ওই পার্ক স্ট্রিটের ঘটনাটি। চাকরির উত্থান-পতন তাঁকে হয়তো খুব একটা বিচলিত করে না। এই কারণেই রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে গিয়েই মামলা এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন দময়ন্তী সেন। তাঁর কাছে অপরাধীকে খুঁজে বের করাই একমাত্র লক্ষ্য। পশ্চিমবঙ্গের পুলিশের সাহসিকতা নিয়ে কথা বলতে গেলে, একবার না একবার ঠিক উঠে আসে দময়ন্তী সেনের নাম। তবে, রাজ্য সরকারের রোষানলে পড়লেও তিনি এখনও পর্যন্ত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাননি। এমনকী, দুর্নীতির কাছে মাথা নিচু করেননি তিনি কোনওদিন।

প্রত‌্যাবর্তন ও আক্ষেপ

এই জন্যই হয়তো, রাজ্যের সাম্প্রতিক চারটি ধর্ষণের ঘটনার তদন্তভার তাঁর হাতে সঁপে দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। কিন্তু, আবারও যে সময় স্বমহিমায় রাজ্যে তিনি ফিরলেন, তখন রাজ্যে প্রকাশ্যে আসছে একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা। আবারও অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের দিকে। একটি নয়, চারটি ধর্ষণের মামলায় নাম উঠেছে প্রভাবশালী তৃণমূল নেতাদের। ভাবমূর্তি চাপে পড়তে না পড়তেই আবারও পার্ক স্ট্রিটের সেই দিনের মূর্তি ধারণ করে নিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এবারেও হাতিয়ার ভিক্টিম ব্লেমিং। এবারে মমতা সরাসরি জানিয়েই দিয়েছেন, এটা ধর্ষণের ঘটনাই না, মেয়েটির লাভ অ্যাফেয়ার ছিল, মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা ছিল বলেও তিনি জানিয়েছেন। অন্যদিকে, হাঁসখালির এই ঘটনা না হলেও, অন্য চারটি ধর্ষণ মামলার তদন্ত করার জন্য ফিরে এসেছেন সেই দময়ন্তী সেন। সেই ২০১২ থেকে 'সাজানো ঘটনা' বনাম 'ঘটনা ধর্ষণেরই'- এর মধ্যে যে দ্বন্দ্ব চলে আসছে, তা যেন নতুন মাত্রা পেল দময়ন্তীর আগমনে। যেন এক বৃত্ত সম্পূর্ণ হল।

সেই ২০১২-র পার্ক স্ট্রিট থেকে আজকের দেগঙ্গা-মাটিয়া-ইংরেজবাজার-বাঁশদ্রোণী, মাঝে কেটে গিয়েছে পাক্কা একটা দশক। আবার শিরোনামে উঠে এসেছেন দময়ন্তী। ভাবমূর্তিতে এখনও লাগেনি এক ফোঁটা দাগ। রাজ্য সরকারের সঙ্গে সংঘাতের ঠিক ১০ বছর পর এই চারটি ধর্ষণের মামলায় আবারও তদন্তের দায়িত্বে তিনি। তবে এবার তাঁকে দায়িত্ব দিয়েছে খোদ কলকাতা হাইকোর্ট। একদিকে যখন, হাঁসখালি ধর্ষণ কাণ্ড প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য নিয়ে ক্ষোভ জমেছে রাজ্যবাসীর একাংশের মনে; ঠিক সেই সময়েই কার্যত ফিল্মি কায়দায় অন্য কয়েকটি ধর্ষণের মামলায় কামব্যাক করলেন দময়ন্তী। আর দময়ন্তী তদন্তভার পেতেই নতুন চর্চা শুরু রাজনৈতিক মহলে।

পার্ক স্ট্রিটের ঘটনার মতোই একইভাবে এই মামলাগুলোর তদন্তেও অগ্রগতি দেখিয়েছেন দময়ন্তী। ইতিমধ্যেই মালদার ইংরেজবাজার এবং দেগঙ্গা ধর্ষণকাণ্ডের তদন্তকারী মোট ছয় আধিকারিককে লালবাজারের তলব করেছেন তিনি। ইংরেজবাজার ধর্ষণকাণ্ডের তদন্তকারী অফিসার, আইসি এবং এসডিপিওকে তলব করা হয়েছে লালবাজারে। এছাড়াও দেগঙ্গা ধর্ষণকাণ্ডের ২ তদন্তকারী আধিকারিককে ডেকে পাঠানো হয়েছে লালবাজারে। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কলকাতা পুলিশের এক জুনিয়র কর্মীর কথায়, 'শুধুমাত্র সত্যের পথে চলা এবং সত্যকে সমর্থন করার জন্যই ম্যাডামকে বছরের পর বছর ধরে শাস্তি পেয়ে যেতে হলো। যখন পার্কস্ট্রিটে ওই গণধর্ষণের ঘটনাটি ঘটে, সেই সময় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষ তিনি গ্রহণ করেননি। তাঁর পরিবর্তে, ওই নির্যাতিতাঁকে সুবিচার দেওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি করেছিলেন লড়াই। আর সেই অপরাধী দীর্ঘ ৭ বছর ধরে তাঁকে সরিয়ে রাখা হলো পুলিশের প্রধান দপ্তরগুলি থেকে। এতদিন ধরে পশ্চিমবঙ্গ এমন একজন পুলিশ অফিসারের সার্ভিস হারাল, কারণ তিনি শুধু চেয়েছিলেন এক নির্যাতিতাকে বিচার দিতে।'

 

More Articles