আরও একটা মে দিবস, শ্রমিকদের অধিকার এখনও প্রশ্নের মুখে

দেখিনু সেদিন রেলে,
কুলি ব’লে এক বাবু সা’ব তারে ঠেলে দিলে নীচে ফেলে!
চোখ ফেটে এল জল,
এমনি ক’রে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?
যে দধীচিদের হাড় দিয়ে ঐ বাষ্প-শকট চলে,
বাবু সা’ব এসে চড়িল তাহাতে, কুলিরা পড়িল তলে।


একথা বলছেন কে? বিদ্রোহের স্বর নজরুল ইসলাম, তাঁর 'কুলি-মজুর' কবিতায়। ব্যথাতুর হৃদয়ে তিনি বলেছেন সেই দুর্বলদেরই কথা, যাঁদের ঘামে-রক্তেই বাষ্পরেল চলে। বাবু এসে দিলেন কিনা সেই এক দুর্বলকেই ঠেলে নিচে ফেলে! ক্ষমতাশালী ও অহংকারী শ্রেণির এইরূপ ‘ঠেলে ফেলে দেওয়া’ আমাদের কাছে নতুন ঘটনা নয়। তবে ইতিহাসের রক্তাক্ত পাতা শ্রমিকদের মুক্তির আন্দোলন দেখেছে, দেখেছে ক্ষমতাশালীর, মালিক পক্ষের, জমিদার পক্ষের ভয়, দেখিয়েছে ক্ষমতার বিরুদ্ধে স্রোতের ন্যয় সাধারণ-শোষিত-নিপীড়িতদের প্রতিরোধ, শুনেছে “দুনিয়ার মজুর এক হও” ডাক। কালক্রমে সমাজের চালচিত্র ভিন্ন হয়ে গেলেও মালিক শ্রেণির এই নিপীড়নের মানসিকতা সমানভাবেই বজায় রয়েছে, আজও। প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্কে এগিয়েছে শ্রমিক-কৃষক শ্রেণির অবস্থা। ধীরে ধীরে শ্রমিক বদলে হয়েছে আধুনিক শ্রমিক। যন্ত্রই হয়ে উঠেছে প্রোডাকশনের নতুন হাতিয়ার, বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে যা সর্বসম্ভাব্য। অন্যদিকে লাঙল-কাস্তে হাতে কৃষক হোক, ছেনি-হাতুড়ি হাতে শ্রমিক হোক বা কলের যন্ত্র চালানোর শ্রমিক- অবস্থার অবনতি হয়েছে কালক্রমে। এক্ষেত্রে প্রথম শ্রমিক শ্রেণির উদ্ভব ও অসন্তোষের জন্মলগ্নে চলে যাওয়া যাক।  


আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে ইউরোপ ও আমেরিকার আকাশে শিল্পবিপ্লবের 'সূর্যোদয়' হলে (যদিও ‘শিল্পবিল্পব’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার হয় ১৮৩৭ সাল নাগাদ, উল্লেখ করেন ফ্রান্সের সমাজতান্ত্রিক লেখক জেরম ব্লাঙ্কি, পরে ১৮৮১ নাগাদ বিখ্যাত ইংরেজ ইতিহাস গবেষক জে. টয়েনবি অক্সফোর্ডে দেওয়া তাঁর বক্তৃতামালায় এই কথাটি উল্লেখ করেন), সেই সূর্যোদয়ের কিরণে কলকারখানার সংখ্যা বাড়তে থাকে, বিজ্ঞানের প্রসারও ছিল উল্লেখযোগ্য (পাওয়ার লুম, স্টিমইঞ্জিন, মিউল মেশিনের মতো যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়), কয়লা ও ইস্পাতের ব্যবহার বহুল হয়ে উঠতে থাকে, জমিহীন কৃষক, প্রান্তিক মানুষজন শহরে আসতে শুরু করে এবং শ্রমিক শ্রেণির উদ্ভব হয়।

এমন এক সময়ের কথা বলা হচ্ছে, আদপে যখন পুঁজিবাদ, শ্রমিকের অধিকার, ধনতান্ত্রিকতার বিরোধিতার মতো সামাজিক-রাজনৈতিক প্রশ্নগুলির জন্ম হচ্ছে এবং যখন বিশ্বমানচিত্র আক্ষরিকভাবে প্রথমবারের শ্রমিক অসন্তোষ প্রত্যক্ষ করছে। অন্যদিকে শিল্পবিপ্লবের আলোতে শাসক শ্রেণি হয়ে ওঠে ধনতান্ত্রিক, যেখানে বাণিজ্যিক মুনাফাই শেষ কথা। শ্রমিকদের (পুরুষ, শিশু ও মহিলা) কারখানা-পার্শ্ববর্তী অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস ও নির্দিষ্ট মজুরিতে চোদ্দো-ষোলো ঘণ্টা অক্লান্ত পরিশ্রম হয়ে ওঠে তাদের অসন্তোষ ও আন্দোলনের কারণ। এর বিরোধিতায় ইউরোপ আর আমেরিকাজুড়ে আঠারো শতকের মাঝামাঝি সময় শুরু হয় ‘দ্য এইট আওয়ারস’ মুভমেন্ট। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় এই আন্দোলন ছড়িয়ে পরে। ১৮৬৪ থেকেই ‘আট ঘণ্টার বেশি কাজ করব না'- এই মর্মে শ্রমিকরা একত্র হতে থাকে। এরপর মিছিল, মিটিং, ধর্মঘটের ঢেউয়ে প্রায় চার বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলে, ১৮৬৮ সালে ইউএসএ-র আইনসভায় “একজন শ্রমিক সর্বাধিক আট ঘণ্টা কাজ করবে” এই মর্মে একটি আইন পাশ হয়। যদিও এরপরও মালিক পক্ষ একই থেকে যায়, আমেরিকার কলকারখানাতে শ্রমিকদের অবস্থার কোনও উন্নতি দেখা না গেলে আন্দোলন ফের জোরদার হয়, দিকে দিকে শ্রমিক সংগ্রামের ডাক উঠতে থাকে।

আরও পড়ুন: ফের কৃষ্ণাঙ্গ শিশুকে নিগ্রহ! ফ্লয়েডের মৃত্যুতেও বদলায়নি মার্কিন ঘৃণার রং

১৮৮৬-র ১ মে ‘ট্রেডস অ্যান্ড লেবার ইউনিয়ন’ আট ঘণ্টাধিক কাজ কোনও শ্রমিক করবে না এই ব্যপারে দৃঢ় সংকল্প নেয়। সেদিন শিকাগো শহরের বুকে ধর্মঘটে পাঁচ লক্ষ শ্রমিকের যোগদান মালিক পক্ষকে ভীত করে। আন্দোলন আরও জোরদার হলে তাতে পুলিশি আক্রমণ হয় এবং তাতে নিরস্ত্র ছ'-জন শ্রমিক মৃত্যুবরণ করে। এতে আন্দোলন দমন হওয়ার পরিবর্তে নতুনভাবে উজ্জীবিত হয়। ৪ মে, শিকাগোর হে মার্কেটের শ্রমিক সমাবেশে বোমা পড়ে, তাতে আকস্মিকভাবে বেশ কিছু পুলিশকর্মী নিহত হন এবং হে রায়টের সূচনা হয়। এই রায়ট দমনের পর আট জন শ্রমিক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের মধ্যে একজনকে পনেরো বছরের কারাবাস ও বাকিদের সর্বসমক্ষে ফাঁসি দেওয়া হয় (১৮৮৭), যদিও পরবর্তীকালে জানা যায় তাঁরা নির্দোষ ছিলেন। মালিক পক্ষই বোমা নিক্ষেপ করে সেদিন সেই গোলযোগ সৃষ্টি করে পুলিশ ও শ্রমিকের মধ্যে, হে মার্কেট স্কোয়ারে।

এরপর অবশেষে ফ্রান্সে ওয়ার্কারমেন্স অ্যাসোসিয়েশনের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে, ১৮৮৯ সালে, ১ মে দিনটিকে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, এবং সর্বসম্মতিক্রমে তা পাশ হয়। ১৮৯০-এর পর থেকে যথাক্রমে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, রাশিয়া, চিন-সহ বিভিন্ন দেশে শ্রমিক দিবস পালন শুরু হয়। ভারতে প্রথম শ্রমিক দিবস পালিত হয় ১৯২৩ সালে, চেন্নাইয়ে, শ্রমিক নেতা সিঙ্গারাভেল্লু চেত্তিয়ারের নেতৃত্বে। বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকেই মে দিবস সরকারিভাবে পালিত হওয়া শুরু হয়।


ঔপনিবেশিকতার শ্রমিক হয়ে যে দেশের প্রায় দুশো বছর কেটেছে, সেই ভারতে মে দিবস পালনের যথাক্রমে প্রায় ৯৯ বছর অতিক্রান্ত। আশ্চর্য যে, আজও প্রাসঙ্গিক শ্রমিক শ্রেণির দুর্দশার কথা, এবং তাদের অধিকার আজও প্রশ্নের সম্মুখীন! 

 

More Articles