ফের কৃষ্ণাঙ্গ শিশুকে নিগ্রহ! ফ্লয়েডের মৃত্যুতেও বদলায়নি মার্কিন ঘৃণার রং

ভারতে গায়ের রং নিয়ে হীনম্মন্যতা, অহংকার এতটাই রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গিয়েছে যে, এদেশে ফরসা হওয়ার ক্রিম লোকে ব্যবহার করে। আর্য ধারার সৌন্দর্যের ধারণা আর আরবি ধারার সৌন্দর্যের ধারণায় তেমন পার্থক্য নেই। ফলে দু'দিক থেকেই তথাকথিত 'অসুন্দর' এদেশের মানুষ। ভারতের প্রেক্ষিতে বর্ণবিদ্বেষ তুমুলভাবে ফিরে আসে নবজাগরণের আলোয়। ইংরেজদের এই গুণটিকে নিজের সঙ্গে মেলাতে পেরে ভারতীয় মধ্যবিত্ত সেদিন খুশি হয়েছিল। আফ্রিকা থেকে জাহাজে করে যেভাবে কালো মানুষদের তুলে আনা হয়েছিল, তা ভারতীয়দের কাছে অকল্পনীয়। জাহাজের খোলের ভেতরে হাজার হাজার মানুষকে হাতে পায়ে বেড়ি দিয়ে দাস হিসেবে অবলীলায় যে ‘সভ্যতা’ তুলে আনতে পারে, তাদের ‘সভ্যতা’-র পরিমাপ নিয়ে সংশয় থাকে বইকি! দীর্ঘদিন শোষিত হতে হতে একসময় কালো মানুষরা রুখে দাঁড়ায়। আমেরিকাকে দেশ বলে স্বীকার করে তাদের পরবর্তী প্রজন্ম। আফ্রিকান-আমেরিকান পরিচিতি নির্মিত হয়। আমেরিকা স্বাধীন হয়, কালো মানুষদের অবস্থা পাল্টায় না। কালো মানুষদের সমস্যা সামনে রেখে গৃহযুদ্ধ হয়, এতেও তাদের অবস্থার উন্নতি হয় না। উদ্বাস্তু চিনাদের প্রতি ঘৃণা, আইরিশদের প্রতি ঘৃণা, ইন্ডিয়ানদের প্রতি ঘৃণা, মেক্সিকানদের প্রতি ঘৃণা– এর কোনওকিছু থেকেই স্বাধীন হতে চায়নি আমেরিকার শ্বেতাঙ্গরা দীর্ঘদিন। একের পর এক আন্দোলন হয়েছে। এদিকে সংবিধান সবাইকে সমান অধিকার দিয়েছে। কিন্তু প্রশাসন চালায় কারা? তারাও তো শ্বেতাঙ্গ সমাজেরই। সাধারণের ঘৃণা সরকার অনুমোদিত ক্ষমতায়, ইউনিফর্মে, লাঠিতে, বন্দুকে শানিত চকচকে হয়ে ওঠে। ছয়ের দশকে এই ঘৃণা যখন চরমে, তখন কৃষ্ণাঙ্গ রাজনীতির ধারাটি আরও শক্ত হচ্ছে। বিশ্বজোড়া সেই শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে পদে পদে গর্জে উঠছে তারা। শ্বেতাঙ্গের সংস্কৃতি, আধিপত্য অস্বীকার করে নিজস্বতা নির্মাণ করছে তার। লাগাতার এই অ্যাক্টিভিজম কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের কিঞ্চিৎ শ্বাস ফেলার সুযোগ দিচ্ছে। 'ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার' আরও প্রেরণা জুগিয়েছে এই আন্দোলনকে।

 

কিন্তু তা কতটুকু? জর্জ ফ্লয়েডকে গলায় পা দিয়ে সেই শ্বাস কেড়ে নিয়ে শ্বেতাঙ্গ পুলিশ যখন বুঝিয়ে দেয় এ তার অনুদানমাত্র, চাইলেই অধিকার কেড়ে নেওয়ার ক্ষমতা তার আছে প্রকাশ্য রাস্তায়– তখন তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে আরেকবার। বিশ্বজুড়ে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার আন্দোলন আবারও প্রাণ পায়। মিনেসোটার মিনিয়াপোলিসের সেই পুলিশ স্টেশন ক্ষমা চাইতে বাধ্য হয়। কিন্তু ক্ষমতার উচ্চতা থেকে ‘ক্ষমা চাওয়া’ এমন এক সাবান, যা দিয়ে যাবতীয় রক্তের দাগ তুলে ফেলা যায় না। সেই ঘটনার বছরদুয়েক পরে ফের ভাইরাল হল একটি শিশুকে ছেঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা। সম্প্রতি নিউ ইয়র্কের সিরাকাসের রাস্তায় ঘটে যাওয়া এমনই এক ঘটনার সাক্ষী থাকল সমস্ত বিশ্ব। কেনেথ জ্যাকসন নামে ওই অঞ্চলের এক বাসিন্দা গত রবিবার কাজে বেরিয়েছিলেন। হঠাৎ তাঁর নজরে পরে একটি বছরআটেকের কৃষ্ণাঙ্গ শিশুকে তিন-চারজন পুলিশ তার সাইকেল থেকে টেনে তুলে আনছে। চারিদিকে ডোরিটো ছড়িয়ে রয়েছে ইতস্তত। কেনেথ জানান, “সাইকেলের থেকে ওকে হেঁচড়ে নামানো হয়”, এই ঘটনা দেখেই ক্যামেরায় ঘটনাটি রেকর্ড করার সিদ্ধান্ত নেন সাঁইত্রিশ বছরের কেনেথ। প্রতিবাদে সরব হন তিনি। “আরে আরে, করছেন কী আপনারা?” ফোনে রেকর্ডিং করতে করতে আর্তনাদ করে ওঠেন ভদ্রলোক। একজন অফিসার তখন শিশুটির হাত পিছন দিকে মুচড়ে ধাক্কা দিতে দিতে তাকে গাড়ির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে সেই পুলিশ কেনেথকে ভেঙিয়ে বলেন, “জানেন না কী করছি? চোখে দেখতে পান না?” সেই সময় আরেকজন অফিসার এগিয়ে আসেন কেনেথের দিকে। তিনি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে বলেন, “চুরি করেছে তাই।" ধীরে ধীরে লোক বাড়ছিল। পাশ থেকে একজন বলেন, “বছরদশেকের বেশি বয়স না বাচ্চাটার। এভাবে কেউ ধরে?” গোটা ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, হাতের ব্যাথায় বিশ্রীভাবে আর্তনাদ করছে ছেলেটি। জোর করে তাকে পুলিশের গাড়ির পিছনের আসনে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।

টুইটটি দেখুন:

https://twitter.com/HunndoHefner/status/1516069289362706437?t=uPbuL7vORpBNg_Op5ZCTeQ&s=19

 

ভিডিওটি নিয়ে সরগরম নেটদুনিয়া। অনেকেই নানা বিকল্পের সন্ধান দিচ্ছেন। রাস্তার মাঝে এইভাবে অত্যাচার না করেও নানা পন্থা নেওয়া যেত বলেই তাঁদের বিশ্বাস। এমনকী, ছেলেটির বাবা মা-কেও ডাকা যেতে পারত। ছেলেটি একটি ডোরিটোস-এর প্যাকেট চুরি করেছিল বলেই অভিযোগ। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে কেনেথ নিজেই সেই দাম মিটিয়ে দিতে চাইছেন। অথচ পুলিশের বিকার নেই। জানা গিয়েছে, ছেলেটি এবং তার ভাইদের পরে বাড়িতে দিয়ে আসে পুলিশ। অভিভাবকদের জানানো হয় চুরির ব্যাপারটি। তখনও ছেলেটির বাবা ভিডিওটি দেখেননি। বরং পুলিশের আচরণ বন্ধুত্বপূর্ণ বলেই মনে হয়েছিল তাঁর। এরপরে ভাইরাল ভিডিওটি দেখেন সেই ভদ্রলোক। পুলিশের সেই আচরণ দেখে মি. উইহ্‌ যারপরনাই বিরক্ত ডিপার্টমেন্টের ওপর। “একটা বাচ্চা ছেলের সঙ্গে কীভাবে এরকম ব্যবহার করতে পারে পুলিশ?” ক্ষোভ উগরে দেন এক কৃষ্ণাঙ্গ পিতা।

আরও পড়ুন: লুক্সেমবার্গ থেকে‌ প্যালেস্তাইনের গেরিলা || ছাঁচভাঙা মেয়েদের গল্প…

মুহুর্মুহু সমালোচনায় শহরের মেয়র একটি বিবৃতি দিতে বাধ্য হন। এবং ঘটনার যাবতীয় ফুটেজ, যা বডি ক্যামেরায় বন্দি হয়েছে, তা খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেন তিনি। মেয়র বেল ওয়ালশ এও জানান, বাচ্চাটিকে ওই পুলিশকর্মীরা আগে থেকেই চিনত। এর আগেও ছোটখাটো চুরি করেছে বাচ্চাগুলো। পুলিশ তাদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এসেছে এবারও। কোনওরকম অভিযোগ দায়ের করা হয়নি। চাপের মুখে পুলিশ ডিপার্টমেন্টও জানাতে বাধ্য হয়েছে, “বাচ্চাটিকে হাতকড়ি পরানো হয়নি।” যদি সত্যি তাই হয়ে থাকে, যদি চুরির ঘটনার জন্যই আটক করা হয়ে থাকে বাচ্চাটিকে, সেক্ষেত্রেও অমন ব্যবহার করা যায় কি? শ্বেতাঙ্গ বাচ্চাদের ক্ষেত্রে, অভিজাত পরিবারের অপরাধী বাচ্চাদের ক্ষেত্রে এতটাই অধৈর্য হতে দেখা যায় এই পুলিশদের? শাসনের মাত্রা সম্বন্ধে প্রশাসনের জ্ঞান থাকবে না? না কি আসল ব্যাপারটা লুকিয়ে আছে কয়েকশো বছর ধরে চলে আসা অপরীকরণের মধ্যে? ফ্লয়েড হত্যার পরে পুলিশের এই ভূমিকা নিয়ে জাতিবিদ্বেষ উদযাপনের প্রশ্ন উঠবেই। বিশেষত, এক প্যাকেট ডোরিটোসের দাম যখন তিন ডলার।

More Articles