রাশিয়ার মাস্তানিতে ভাটার টান! চাণক্য কি জেলেনস্কিই?

প্রস্তুতি চলছিল দীর্ঘদিন ধরেই। অবশেষে ইন্তানবুলে মুখোমুখি আলোচনায় বসল রাশিয়া ও ইউক্রেন। রাশিয়ার উপ-প্রতিরক্ষা মন্ত্রী আলেকজান্ডার ফোমিন সেখানে জানান ইউক্রেনের কিয়েভ ও চেরনিহিভে তাঁরা আক্রমণের মাত্রা কমিয়ে আনবেন। অর্থাৎ বজ্র আঁটুনি কিছুটা আলগা করতে প্রস্তুত রাশিয়া। তবে কি যুদ্ধ শেষের পথে? না, পুরোপুরি শেষের পথে হয়ত নয়, তবে তার প্রাথমিক সম্ভবনাটুকু দেখা যাচ্ছে। এমনটাই মনে করছেন অনেকে। বস্তুত,  এই বৈঠককেই রাশিয়া ও ইউক্রেনের শান্তি চুক্তির প্রথম ধাপ হিসেবে দেখতে চাইছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু সে আশা যে অচিরেই দুরাশায় পরিণত হবে না, এমনটা বুক ঠুকে বলা চলে না। কারণ রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটছে দ্রুত গতিতে। তবে গত কয়েকদিনে পুতিনের রণং দেহি মূর্তিতে যেন কিছুটা ভাটার টান লক্ষ করা যাচ্ছে। তাহলে কি শেষ পর্যন্ত কিছুটা হলেও পিছু হটছে রাশিয়া? ইউক্রেনের রাষ্ট্রনেতা ভ্লাদিমির জেলেন্সকির চালেই কি কিছুটা ব্যাকফুটে রাশিয়া!

গত কয়েকদিন ধরে পূর্ব-ইউক্রেনের বেশ কিছু অংশে নিয়মিত মিসাইল আক্রমণ চালিয়েছে রাশিয়া। রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রক বুক ফুলিয়ে ঘোষণা করেছে, হাইপারসনিক অস্ত্রের সাহায্যে ইউক্রেনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র সংগ্রহশালা ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে তারা। প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ মানুষ যুদ্ধের কবল থেকে রক্ষা পেতে ইউক্রেনের পশ্চিম সীমান্ত পেরিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। মারিওপোলের দক্ষিণ বন্দরের দখল নিয়েছে রুশ সৈন্যরা। ফলত, আজভ সাগরের সঙ্গে ইউক্রেনের সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। দেশে বহু জায়গায় বিদ্যুৎ নেই। জলের ঘোরতর অভাব। ইউক্রেনের স্থানীয় মানুষজনের মতে, যুদ্ধে আক্রান্ত বহু ব্যক্তির কাছে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র ও খাবার পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে না। ইউক্রেনের শহরাঞ্চল রুশ আক্রমণের ফলে কার্যত ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। যুদ্ধের ফল ভুগতে হচ্ছে রুশ সেনাদেরও।  প্রায় ৫০০ র কাছাকাছি রুশ সেনা ইতিমধ্যেই যুদ্ধে নিহত হয়েছেন। তাছাড়া বারবার রসদ ফুরিয়ে আসায় বিপদের মুখে পড়তে হয়েছে।

আরও পড়ুন-ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা? ঠিক কী পরিমাণ পারমানবিক অস্ত্র মজুত করেছেন রাষ্ট্রনেতারা?

ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির জেলেন্সকি প্রথম থেকে প্রতিবেশী দেশ রাশিয়াকে শান্তির বৈঠকে বসবার বার্তা দিয়েছিলেন। রাশিয়ার উদ্দেশ্যে তিনি বলেছিলেন, ‘শান্তি-চুক্তির মধ্যে দিয়ে ইউক্রেনের প্রতি সুবিচার করার সময় এসেছে। নইলে রাশিয়া যে ক্ষয়-ক্ষতির মুখোমুখি হবে তার থেকে মাথা তুলে দাঁড়াতে বহু প্রজন্ম কেটে যাবে।’ যদিও এই কথাবার্তার মধ্যে জেলেনস্কির ভীতি ধরা পড়েনি কখনও। বরং বহু মানুষ দেশ ছাড়লেও, জেলনস্কি কিন্তু যুদ্ধের মধ্যেও রণাঙ্গন ছাড়েননি। রাশিয়ার হাজার আক্রমণের মুখেও আপাতভাবে নির্ভীক থেকেছেন জেলেন্সকি। দেশবাসীকে সাহস জোগাতে নিজেই নেমে পড়েছেন যুদ্ধক্ষেত্রে। সোশ্যাল মিডিয়া এবং সংবাদমাধ্যম জুড়ে তাঁর সাহসিকতার প্রশংসা করেছেন বহু মানুষ। কিন্তু কেবলমাত্র সাহসকে মূলধন করেই কি রাশিয়াকে শান্তির বৈঠকে বসতে বাধ্য করলেন তিনি? সমগ্র ঘটনার সমীকরণ সম্ভবত রুপকথার গল্পের মতো অতটা সরল নয়।

আরও পড়ুন-মোদীর প্রাণনাশের হুমকি এই প্রথম নয়! বারবার ঘুম উড়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের

ইতিপূর্বে ন্যাটো রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে জেলেন্সকিকে নৈতিক সমর্থন জানিয়েছে। কিন্তু সরাসরি তাঁকে কোনো রকম সাহায্য করেনি তারা। তাদের যে এ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু বাধা বিপত্তি ছিল সে কথাও অস্বীকার করা চলে না। ন্যাটোর ৫ নম্বর ধারা  অনুযায়ী, তাদের এক সদস্য দেশের উপর আক্রমণ নেমে এলে বাকিরাও যৌথভাবে প্রতিরোধ করবে। শেষবার এই বিশেষ ধারা প্রয়োগ করা হয় ২০০১ সালে, মার্কিন-যুক্তরাষ্ট্রের ‘টুইন টাওয়ার’ হামলার পর।  সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বেশ কিছু বলটিক দেশ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ন্যাটোর সদস্য পদ গ্রহণ করেছিল। উদাহরণ হিসেবে নাম করা চলে লিউথেনিয়া, লাতভিয়া এবং এস্তোনিয়ার। ইউক্রেনের সঙ্গে ন্যাটোর মিত্রত্ব থাকলেও সে সরাসরি তাদের সদস্য নয়। ফলত, ন্যাটো আইনত রাশিয়ার বিরুদ্ধে তাকে সাহায্য করতে পারে না।

এবার দেখে নেওয়া যাক ন্যাটোর সঙ্গে কালক্রমে কী ভাবে দ্বন্দে জড়িয়েছে ইউক্রেন। গোড়ায় ন্যাটোর সদস্য হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিল ইউক্রেন। প্রধানত সেই সূত্র ধরেই রাশিয়ার সঙ্গে তার যুদ্ধের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অতঃপর ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি ন্যাটোকে বারংবার অনুরোধ করেন তাঁর দেশের সদস্যপদ কে কেন্দ্র করে তাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে। অর্থাৎ, ইউক্রেন কে কি তাঁরা আদৌ সদস্য করতে চান, নাকি চান না? সে বিষয়ে স্পষ্ট মতামত জানাতে।  কিন্তু বেশ কিছুদিন কেটে গেলেও ন্যাটো এ বিষয়ে কোনোরকম সদুত্তর দেয় না। এ নিয়ে ন্যাটোর সদস্যদের প্রতি তির্যক মন্তব্যও করেন ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি।  অবশেষে জেলিন্সকি প্রকাশ্যে জানান যে তাঁরা ন্যাটোর সদস্য হওয়ার বাসনা পরিত্যাগ করেছেন। তারপর থেকেই বরফ খানিক গলতে আরম্ভ করে। রাশিয়ার সঙ্গে তাদের কূটনৈতিক কথোপকথন আরম্ভ হয়। অর্থাৎ, দেখা যাচ্ছে,  রাশিয়ার আক্রমণের মুখেও যারা প্রাথমিকভাবে ন্যাটোর সদস্য হতে বদ্ধপরিকর ছিল, তাদের গলাতেই এখন অন্যরকম সুর! তবে কি  ইউক্রেন  উপলব্ধি করতে পারছে যে ন্যাটোর প্রত্যক্ষ সাহায্য ছাড়া রাশিয়ার মতো শক্তিশালী দেশকে দীর্ঘদিন ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব নয়? এই কারণেই কি ইস্তানবুলে মুখোমুখি আলোচনায় বসতে বাধ্য হচ্ছে তারা?

এই পরিস্থিতিতে মার্কিন-যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়। ন্যাটোর মতোই ইউক্রেনকে শুধুমাত্র নৈতিক সমর্থন জানিয়েছিল তারা। পরবর্তীতে দুই দেশের বৈঠকের খবরে  সংশয় প্রকাশ করছেন জো বাইডেন। তিনি মনে করছেন নানান প্রতিশ্রুতির কথা শুনিয়ে রাশিয়া আসলে ইউক্রেনকে বোকা বানাতে চাইছে। বাইডেন সরাসরি জানিয়েছেন, আসলে দুনিয়ার নজর অন্যত্র ঘোরাতে চান পুতিন, তাই এই বৈঠক কে তিনি কৌশল হিসেবে ব্যবহার করছেন। অর্থাৎ দুই দেশের বৈঠক কে কেন্দ্র করে বাইডেনের গলায় নেতিবাচক সুর স্পষ্ট। তবে কি তিনি চাইছেন না চটজলদি কোনও সমাধান সূত্র বেরিয়ে আসুক? কোভিডের পর পাল্টেছে পৃথিবীর বাণিজ্যিক সমীকরণ।  রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের সূত্র ধরে রাশিয়া কে সর্বোতভাবে কোণঠাসা করেছে মার্কিন-যুক্তরাষ্ট্র। তবে কি ইউনিপোলার বিশ্বব্যবস্থায় এই যুদ্ধকে সামগ্রিকভাবে বাণিজ্যিক ফায়দা তোলার কাজেই ব্যবহার করতে চাইছে তারা?  

More Articles