গোয়া কি আদৌ ‘বহিরাগত’ তৃণমূলকে চাইল?

বঙ্গোপসাগরের মাছ আরবসাগরে চলল। সে জলে কোথায়ই বা ঘাপটি মেরে আছে কুচো মাছের ঝাঁক, কোথায়ই বা আরও বড়ো কোনও হাঁ-মুখ অপেক্ষা করে রয়েছে গিলে নেওয়ার, সেসব অনিশ্চিত জলীয় কৌশলকে কপালে গেঁথেই মাছ চলল। জল পালটে গেলে বাঁচার কৌশলও বদলে যায়, সামাজিক পরিবেশ বদলালে খাপ খাইয়ে নেওয়ার আচার আচরণও বদলে যায়। কিন্তু বাংলার তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমে গিয়েও নির্বাচন লড়ার মূল মন্ত্রে বদল আনেনি। বাংলা হোক বা গোয়া তৃণমূল প্রসার বাড়াতে চেয়েছে নিজস্ব ধাঁচেই। তৃণমূলের সেই আর্থিক নানা প্রকল্প দিয়েই গোয়ার মানুষের মন (ভোট বলেও সোহাগ করে ডাকা যায়) জয় করার প্রত্যাশা রয়েছে দলের।

বাংলার বিধানসভা নির্বাচনে ‘নো ভোট টু বিজেপি’ ছিল তৃণমূল কংগ্রেসের সবচেয়ে তীক্ষ্ণ রাজনৈতিক উচ্চারণ। সারা দেশেই বিজেপি বিরোধী দলগুলিকে জোট গড়ার আহ্বানও দিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অঘোষিত বা স্বঘোষিতভাবেও বিজেপি বিরোধী নেতৃত্বের মুখ হয়েছেন তিনিই। উপকূলের এই রাজ্যেও বিজেপিকে সরানোর ডাক দিয়েই খাতা খুলতে চেয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু কার ভরসায়? কেন গোয়ার মতো রাজ্য, যেখানে ভাষা থেকে শুরু করে ধর্মের বিন্যাস, সংস্কৃতি এবং মানুষের চাহিদা সবটুকুই বাংলার চেয়ে ভিন্ন, সেখানে কোন অঙ্গে জনতার মন জিতবে বলে ভাবছিল তৃণমূল?

বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জয়ের পিছনে বড়ো অবদান রয়েছে মহিলা ভোটারদের। বাংলার নির্বাচনী ইস্তাহারে গুরুত্ব পেয়েছিল পরিবারের মহিলাকে মাসিক ৫০০ (তপশিলীদের ক্ষেত্রে ১০০০) টাকা দেওয়ার প্রকল্প লক্ষ্মীর ভাণ্ডার। সেই একই প্রকল্পকে ‘গৃহলক্ষ্মী প্রকল্প’ নামে গোয়ায় নিয়ে গিয়েছে তৃণমূল। মহিলাদের মাসিক ৫০০০ টাকা ভাতা! বার্ষিক ষাট হাজার। উল্লেখযোগ্য, গোয়াতে পুরুষদের তুলনায় মহিলা ভোটারের সংখ্যা বেশি। মোট ভোটারের মধ্যে মহিলাদের সংখ্যা ৫ লক্ষ ৬ হাজার ৬০৫। সুতরাং এই নির্বাচনে বার্ষিক ৬০ হাজার টাকার প্রতিশ্রুতি, সমস্ত চাকরিতে মহিলাদের ৩৩% সংরক্ষণের আশ্বাস দিয়ে এই ভোটের কিয়দংশ টানা গেলেও তৃণমূলের পক্ষে তা সুবিধাজনক।

বাংলার মতোই গোয়ার যুবদের জন্য যুব শক্তি, ৪% সুদে ২০ লক্ষ টাকার ক্রেডিট কার্ড, পাঁচবছরে দারিদ্রমুক্ত গোয়া আর দিনমজুরদের দৈনিক ৩৬৪ টাকা মজুরিকে বাড়িয়ে ৬০০ টাকা করার স্বপ্নও দেখিয়েছে তৃণমূল। কিন্তু গোয়ার মানুষের বিশ্বাস অর্জনে কি এগোতে পারল তৃণমূল কংগ্রেস?

গোয়ার চল্লিশ বিধানসভা আসনের নির্বাচনে একা লড়ার জায়গায় যে তৃণমূল নেই তা নেতৃত্বের কাছে স্পষ্ট ছিল। আবার, বিজেপি বিরোধীদের একজোট করতে চেয়ে কংগ্রেসের মতো জাতীয় দলের থেকেই সবুজ সংকেত মেলেনি। কংগ্রেসের সাফ বক্তব্য ছিল, “আমাদের বিধায়ক, নেতাদের ভাঙিয়ে নিয়ে গিয়ে জোট চাইলে তা হবে না।” রইল বাকি গোয়ার নিজস্ব রাজনৈতিক দল। তৎকালীন নির্দল বিধায়ক বিজয় সারদেশাইয়ের হাত ধরে ২০১৬ সালে তৈরি হয় গোয়া ফরোয়ার্ড পার্টি। জিএফপি ঘোষিতভাবেই জানিয়েছিল বিজেপি বাদ দিয়ে আর যে কোনও দলের সঙ্গে জোট গড়তে রাজি তারা। ২০১৭ সালের গোয়া বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি বিরোধী দল হিসেবেই প্রচারে আসে জিএফপি। কংগ্রেসের সঙ্গে সেবার জোট গড়তে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছিল জিএফপি। যে নির্বাচনে বিজেপির বিরোধিতা করেছিল জিএফপি, বিধানসভার ফল বেরোতে সেই বিজেপির সঙ্গে জুড়েই গেরুয়া দলকে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করে জিএফপি। কংগ্রেস ১৭ টি আসনে এগিয়ে থাকলেও বিজেপি গোয়া ফরোয়ার্ড পার্টি এবং মহারাষ্ট্রবাদী গোমন্তক পার্টি ও নির্দলদের সঙ্গে নিয়ে রাজ্যে সরকার গড়ে। তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পারিক্করকেই গোয়ার মুখ্যমন্ত্রীপদে ফেরাতে হবে এই শর্তেই বিজেপিকে সমর্থন জোগায় গোয়া ফরোয়ার্ড পার্টি। এবার কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করেছে জিএফপি। ফলে স্থানীয় দলের সমর্থন পাওয়ার জন্য হাতে রইল কেবল এমজিপি!

গোয়ার প্রথম শাসকদল মহারাষ্ট্রবাদী গোমন্তক পার্টি ক্ষমতায় আসে ১৯৬৩ সালে। তার দু’বছর আগে ১৯৬১ সালেই পর্তুগিজ উপনিবেশ পরিচয় থেকে মুক্তি পেয়েছে এই রাজ্য। স্বাভাবিক নিয়মেই অব্রাহ্মণ ভোটার, যারা পর্তুগিজ শাসনের সময় থেকেই নানাভাবে বঞ্চিত তাদের মধ্যে বেশ প্রভাব রয়েছে এমজিপির। মজার বিষয়, এই এমজিপির হাত ধরেই গোয়াতে খাতা খুলেছিল বিজেপি। ১৯৯৪ সালের নির্বাচনে বিজেপি ও এমজিপি জোট গড়ে। সেই সময় এমজিপি ১০ টি ও বিজেপি ৪ টি আসন পেয়েছিল ঠিকই। কিন্তু সূঁচ হয়ে ঢুকে বড়ো মাছ হয়ে বেরিয়েছে বিজেপি। গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির সঙ্গে জোট ছেড়ে বেরিয়ে আসে এমজিপি। শিবসেনা এবং আরএসএসের সঙ্গে হাত মেলায়। ২০১৭ সালের বিধানসভায় এমজিপি ৩ খানা আসন জিতে ফের এই বিজেপিকেই সমর্থন জোগায়। বিজেপি ১৩ টি আসন জিতেও এমজিপি, জিএফপি এবং নির্দলদের সাহায্যে ক্ষমতায় আসে। ২০২২ বিধানসভা নির্বাচনে ‘বিজেপি বিরোধী’ তৃণমূলের সঙ্গে জোট করেছে একদা বিজেপির জোটসঙ্গী এমজিপি! বহু পারমুটেশন কম্বিনেশন করেই গোয়ার মানুষ কখনও ভরসাযোগ্য রাজনৈতিক দল পেয়েছে কী না এ প্রশ্নের উত্তর কষ্টসাধ্য। 

এমজিপির সঙ্গে সই পাতালেও কংগ্রেস থেকে নেতা ভাঙিয়ে আনার অভিযোগ উঠেছে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। তবে এই আসা যাওয়ার মাঝের সমীকরণগুলিও অনন্য! গোয়া বিধানসভা নির্বাচনের আগেভাগেই প্রার্থীপদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভার সাংসদ তথা গোয়ার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী লুইজিনহো ফেলেইরো। ফাতোরদা বিধানসভা কেন্দ্র থেকে তৃণমূল তাঁকে প্রার্থী করেছিল ঠিকই তবে নারী ক্ষমতায়নের উদ্দেশে একজন মহিলা ওই আসনে প্রার্থী হবে এই যুক্তিতে তিনি নিজেই প্রার্থীপদ প্রত্যাহার করেন। গত সেপ্টেম্বর মাসে কংগ্রেসের বিধায়ক পদ ছেড়ে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দিয়েছিলেন ফেলেইরো। যোগ দেওয়ার এক মাসের মধ্যে তৃণমূল কংগ্রেস ছেড়েছিলেন কংগ্রেসের প্রাক্তন বিধায়ক অ্যালেক্সো রেজিনাল্ডো। তৃণমূল ছাড়েন প্রাক্তন বিধায়ক লাভু মামলেদারও। দলত্যাগের সময় তিনি অভিযোগও করেন, “গোয়াকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করার চেষ্টা করছে তৃণমূল।” দল ছাড়ার ঘোষণা করেন গোয়া তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক যতীশ নায়েকও।

কংগ্রেস ও অন্যান্য দল ভাঙিয়ে তৃণমূল গোয়ায় আসন জেতার যে নকশা বুনতে শুরু করেছিল, যত দিন এগিয়েছে ধারাবাহিক পদত্যাগে দলের ভিত্তিই নড়বড়ে হয়েছে। তৃণমূলের তরফে যে প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই অন্য দল ছেড়ে জুড়েছেন তৃণমূলে। বিজেপি বা বা কংগ্রেসের টিকিট না পেয়েই ঘাসফুল শিবিরে নাম লিখিয়েছেন তাঁরা। সুতরাং তৃণমূলের নীতি অথবা ‘বিজেপি হঠাও’ ভাবধারার প্রতি কি আদৌ আনুগত্য রয়েছে কারও? এ প্রশ্নও গোলমেলে। গোয়ায় বিজেপির বিকল্প যে তৃণমূল এই কথা গোয়াবাসীকে  বিশ্বাস করিয়ে উঠতে পারেননি মমতা। সেই কারণেই এখন তিনি বলছেন, আরও সময় পেলে আরও ভালো হতো।

অন্যদিকে, বিজেপির প্রথম ধাক্কা এসেছে নিজেদের অন্দরমহল থেকেই। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রয়াত মনোহর পারিক্করকে সামনে রেখেই ২০১৭ সালের ভোটের সওদা করতে নেমেছিল কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন এই দল। দু’ দশকেরও বেশি সময় ধরে গোয়াতে বিজেপির শিকড়কে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন মনোহর। সেই মনোহর পারিক্করের ছেলে উৎপল পারিক্করই আসন্ন বিধানসভা ভোটে দাঁড়াচ্ছেন নির্দল প্রার্থী হিসেবে। পানাজির আসনে উৎপলকে টিকিট দেয়নি বিজেপি। গোয়া বিজেপির দাবি, ওই আসনের বদলে অন্য দু’টি আসনের প্রস্তাব দেওয়া হলেও পানাজি থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়েই নাছোড়বান্দা ছিলেন উৎপল। উৎপলের প্রতি বিজেপির আচরণে ক্ষুব্ধ গোয়ার গৌড় সারস্বত ব্রাহ্মণ সমাজও। মনোহর পারিক্করের নেতৃত্বে এর আগে বিজেপিকে সমর্থন জুগিয়েছিলেন তাঁরা। শুধু উৎপলই নন, দলে থেকেও টিকিট না পাওয়ার কারণেই নির্দল হয়ে লড়ছেন রাজ্যের উপমুখ্যমন্ত্রী চন্দ্রকান্ত বাবু কাভলেকারের স্ত্রী সাবিত্রী কাভলেকর। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এবং বর্ষীয়ান বিজেপি নেতা লক্ষ্মীকান্ত পরেশকরকেও টিকিট দেয়নি দল। ফলে তিনিও নির্দল হয়েই লড়ছেন। দলের অন্দরের মানুষদের ভোটের আগে চটিয়ে দিয়ে নির্দল প্রার্থী বাড়িয়ে আসলে নিজেদেরই বিপদ ডেকে আনছে বিজেপি, মনে করছেন অনেকেই। এমনকী মুখ্যমন্ত্রী পদ নিয়েও বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী প্রমোদ সাওয়ান্ত আর স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিশ্বজিৎ রানের মধ্যে ঠান্ডা লড়াই রয়েছে। ২০১৭ সালে কংগ্রেস ছেড়ে কেবলমাত্র মুখ্যমন্ত্রী পদের প্রত্যাশাতেই বিজেপিতে যোগ দেন বিশ্বজিৎ। কিন্তু বিজেপি আরএসএস ঘনিষ্ঠ প্রমোদ সাওয়ান্তকে মুখ্যমন্ত্রী করে।

মহারাষ্ট্রবাদী গোমন্তক পার্টির সঙ্গে জোট করেই ১৯৯৪ সালের ৬.৭২% ভোট থেকে ২০১২ সালে ৩৪.৬৮ শতাংশ ভোট পায় বিজেপি। গোয়ার মুক্তির পর থেকে টানা ১৭ বছর এমজিপি গোয়ার প্রশাসন নিজেদের দখলে রেখেছিল। ২০১৭ সালে এমজিপির সঙ্গে জোট ভেঙে গেলে এমজিপি ঘনিষ্ঠ ওবিসিদের মধ্যে নিজেদের প্রভাব বিস্তারে মরিয়া চেষ্টা করেছিল বিজেপি। কিন্তু এবার সেই শ্রেণির ভোট বিজেপির পাতে পড়বে কী না সংশয় রয়েই গিয়েছে। 

বিজেপির ভোটের ইতিহাস বলছে ধর্মীয় ভোট টানতে বিজেপির স্ট্র্যাটেজি খুব ব্যর্থ হয়নি। গোয়ায় ক্রিশ্চান ধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ২৬ শতাংশের কাছাকাছি। ২০১২ সালে বিজেপি ছ’টি আসনে ক্রিশ্চান প্রার্থী দিয়ে ৬ টি আসনেই জয়যুক্ত হয়। ২০১৭ সালে আটটি আসনে ক্রিশ্চান প্রার্থী দিয়ে সাতটিতেই জেতে বিজেপি। এবারের নির্বাচনে বিজেপির তালিকায় রয়েছেন ১২ জন ক্রিশ্চান প্রার্থী। 

বাংলায় বিজেপি ছিল ‘বহিরাগত’। তৃণমূলের বয়ান ছিল, বহিরাগতকে মেনে নেবে না বাংলা। নেয়ওনি। ত্রিপুরায় পুরসভা ভোটে তৃণমূল ছিল ‘বহিরাগত’। একটি মাত্র আসন জুটেছিল তাদের। গোয়াতে বাংলার এই দল বহিরাগত, ফলে গোয়ার সংস্কৃতি ও গোয়ার মানুষদের জাত্যাভিমানের সঙ্গে এই দল খাপ খাওয়াতে পারবে কী না এই ইস্যুকেই সামনে এনেছে বিরোধীরা। তৃণমূলের সাংগঠনিক কোনও ভিত্তি নেই যে রাজ্যে সেখানে অন্যের দল ছেড়ে আসা নেতাদের নিয়ে দল যদি দাঁড়িয়েও যায় তা কি আদৌ টেকসই হবে? বিজেপিকে ঠেকাতে গিয়ে ভোট ভাগের অঙ্কে বিজেপিরই লাভ করে ফেলছেন কী না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই নিয়েও তর্ক অমূলক নয়। সুতরাং, আরব সাগরের মাৎস্যন্যায়ের নীতি বাংলার রাঘববোয়ালদের সিলেবাসে কমন কী না এর উত্তর আজ বাদে কাল একমাত্র দিতে পারবেন গোয়ার মানুষই।

More Articles