মধ্যবিত্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা? এবারের বাজেট কি আজেবাজেট?

এ বছরের (২০২২-২০২৩) যে বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন, তাকে ‘ভারতের মধ্যবিত্ত ও বেতনভোগী বর্গের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা বলে আখ্যা দিয়েছে কংগ্রেস। আয়কর ব্যবস্থায় বিন্দুমাত্র আলোকপাত করেনি এই বাজেট, অভিযোগের আঙুল এদিকেই। “ভারতের মধ্যবিত্ত তথা বেতনভোগী বর্গ একটু মুক্তি আশা করেছিল। দীর্ঘ মহামারীর সময় বেতন কেটে নেওয়া ও চূড়ান্ত মূল্যবৃদ্ধি তাদের অতিষ্ঠ: করে তুলেছে। অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রী প্রত্যক্ষ আয়করের ব্যাপারে আবারও তাদের চূড়ান্ত নিরাশ করলেন। মধ্যবিত্ত ও বেতনভোগী বর্গের প্রতি এ বিশ্বাসঘাতকতাই,” বাজেট দেখে এমনটাই ট্যুইট করেন রণদীপ সুরজওয়ালা।

ব্যক্তিগত আয়কর কাঠামোয় কোনওরকম পরিবর্তন না করে সরকার জানিয়েছে সংশোধিত আইটি রিটার্ন ফাইল করা যাবে দুবছর সময়সীমার মধ্যে। মূল্যবৃদ্ধির পরিমাণ দেখে অনেকেই আশা করেছিলেন কর ছাড়ের পরিমাণ বাড়ানো হবে। কিন্তু  এই ছাড় অপরিবর্তিতই আছে। তবে কমানো হয়েছে কর্পোরেট কর। ১৮% থেকে তা বর্তমানে কমে দাঁড়িয়েছে ১৫%। আরেকটি ট্যুইটে সুরজওয়ালা এই বাজেটকে আখ্যা দিয়েছেন ‘কুছ নেহি বাজেট’ (ফাঁপা বাজেট)। তাঁর মতে গরিব মানুষ, কৃষক, বেতন-ভোগী বর্গ, মধ্যবিত্ত এবং খুচরো ব্যবসার কথা ভাবতে বিন্দুমাত্র রাজি নয় মোদি সরকার।

রণদীপ সুরজওয়ালার ট্যুইট

 

অন্য দিকে রাজ্যবর্ধন সিং রাঠোর (বিজেপি নেতা) একে জনতার বাজেট বলেই অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে পরিকাঠামোর ৩৫% বৃদ্ধি অর্থনীতিকে অগ্রসর করবেই। দেশের উৎপাদন বাড়িয়ে তা আদতে দেশের সম্পত্তি দেশে রাখতেই সাহায্য করবে।

বাজেটে যে দিকে তাকাব

মোবাইল চার্জার, স্মার্টফোন, হিরের গয়না, পোশাক, জুতো ও চামড়াজাত দ্রব্যের দাম কমেছে। তবে তাতে মধ্যবিত্তের অর্থনৈতিক অবস্থার খুব একটা উন্নতি হবে বলে মনে করছেন না বিশেষজ্ঞরা। বরং কো-অপারেটিভ গুলির সারচার্জ কমিয়ে ১২% থেক ৭% করা হয়েছে। চালু করা হচ্ছে ফাইভ জি পরিসেবা। শেয়ার বাজারে আনা হচ্ছে জীবনবীমা নিগমের আই পিও। রেলে পিপিপি মডেলকে আরও উৎসাহ দেওয়া হবে। বিশেষভাবে সক্ষম এবং পেনশনভোগীদের আয়করে ছাড় বাড়ানো হচ্ছে তবে ডিজিটাল সম্পত্তির লেনদেনে আয়কর দিতে ৩০ শতাংশ। সমস্ত আমদানীকৃত জিনিসের দাম বাড়ছে। বেড়েছে ছাতার উপর ট্যাক্সও।

তবে এর প্রভাব সম্বন্ধে সরকারের সঙ্গে একমত নন বিশেষজ্ঞরা। এই বাজেট (২০২২-২০২৩) সাধারণ জনতা ও মধ্যবিত্তের জীবনে কী প্রভাব ফেলবে? আসুন দেখে নিই–

আয়কর

এই করোনাকালের বাজারে চাকরি হারিয়েছে অনেকেই। অনেকের বেতনে কাটছাঁট হয়েছে। উপরন্তু এই ব্যাপক মূল্যবৃদ্ধি। আয়করদাতা নাগরিকেরা তাই এবার আশা করেছিলেন এবারের বাজেটে আয়করে কিছু ছাড় পাওয়া যাবে। করের পরিমাণ কমিয়ে, ডিডাকশন বাড়িয়ে, ওয়ার্ক ফ্রম হোমের ভাতা চালু করে মানুষের জীবনে খানিক আরাম দেবে রাষ্ট্র। আর এস এম ইণ্ডিয়ার প্রতিষ্ঠাতা, ডঃ সুরেশ সুরানা জানাচ্ছেন, “ব্যক্তিগত আয়কর মুকুবের নিম্নতম সীমা আড়াই লাখ থেকে বেড়ে তিন লাখে দাঁড়াবে বলেই আশা করেছিল বহু মানুষ। এইচ এন আই দের সর্বোচ্চ ট্যাক্স ৪২.৭ % থেকে কমে দাঁড়াবে ৩৯ %--এমন আশাও ছিল। একই সঙ্গে আয়ের পার্থক্য কমাতে সম্পত্তির ওপরে বা উত্তরাধিকারে প্রাপ্ত সম্পত্তির ওপরে কর বাড়বে মনে করা হয়েছিল। সে সম্বন্ধেও কোনও উচ্চবাচ্য করেনি সরকার।”

যদিও মিতেশ জৈন (ইকোনমিক ল প্র্যাক্টিস পার্টনার) বলেছেন, “সারচার্জের দীর্ঘসময়ের মূলধন সঞ্চয়ের ট্রান্সফার ৩৭% থেকে কমিয়ে করা হয়েছে ১৫%, তাতে কার্যকরী করের পরিমাণ ২৮.৪৯৬% থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ২৩.৯২%। ব্যক্তিগত করদাতাদের এটা খানিকটা স্বস্তি দেবে।”

 

পেনশনভোগী ও বিশেষভাবে সক্ষমদের জন্য সুখবর

বিশেষভাবে সক্ষমদের জন্য বার্ষিক বা এককালীন ভাতা ঘোষণা করা হয়েছে। মিতেশ একে সুখবর বলেই মনে করছেন। পেনশনভোগীদের জন্যেও সুখবর, রাজ্য সরকারের কর্মীদের ন্যাশনাল পেনশন স্কিম অ্যাকাউন্টের জন্য বরাদ্দ ট্যাক্সের সীমা ১০% থেকে বাড়িয়ে ১৪% করা হয়েছে।


 ব্যক্তিগত আয়ব্যয়

ইন্দাস ল পার্টনার রীতেশ কুমারের মতে, “কয়েকটি প্রস্তাবে ব্যক্তিগত আয়ের হিসেবে প্রভাব পড়বে। দুর্ভাগ্যবশত এক্ষেত্রেও সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে। সরকার সেকশন ৮০ সি ধারা অনুযায়ী ওয়র্ক ফ্রম হোম ইত্যাদির ছাড় কমিয়ে বিনিয়োগ বাড়াতে পারত। ব্যক্তিগত আয়কর বিভাগ নিয়েও লোকের নানা আশা ছিল। এমনকি হাউসিং লোন ডিডাকশনেও কোনো পরিবর্তনের কথা বলা হয়নি প্রস্তাবে। লং -টার্ম ক্যাপিটালের ওপর সারচার্জ কমানোতে সাধারণ মানুষের করের বোঝা হয়তো কাহ্নিকটা কমবে।”

চাকরি

পি এল আই স্কিমে ১৪টি সেক্টরে ৬০ লাখ নতুন কাজের সুযোগ তৈরি করা হবে। নাগরিকদের স্কিল, রিস্কিল বা আপস্কিল অনলাইন প্রশিক্ষণের মধ্যে দিয়ে বাড়াতে ডিজিটাল ইকোসিস্টেম ফর স্কিলিং অ্যাণ্ড লাইভ্লিহুড (দেশ-স্ট্যাক ই-পোর্টাল) খোলা হবে।

 স্বাস্থ্য

ভ্যাকসিনের প্রয়োজনীয়তা কমার যুক্তি দিয়ে চিকিৎসা খাতে ও জনস্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ টাকা ৭৪,৮২০ কোটি থেকে কমিয়ে করা হয়েছে ৪১,০১১ কোটি টাকা। প্রায় ৩৩,০৮৯ কোটি টাকার বাজেট ছাঁটাই স্বাস্থ্যখাতে। জনস্বাস্থ্যে এর প্রভাব খুব একটা যে ভালো হবে না, তা বলাই বাহুল্য।

 

ক্রিপ্টো বিনিয়োগ

এ বিষয়ে ডঃ সুরেশ সুরানা বলেন, ক্রিপ্টো ডিজিটাল অ্যাসেটের ওপর ৩০%-রও বেশি সারচার্জ স্বচ্ছতা আনবে বটে, কিন্তু লং টার্ম ক্যাপিটালের ওপরে কর না কমলে তা অ্যাসেট হোল্ডারদের বিরম্বনার কারণই হবে।

 

নির্মাণ প্রসঙ্গে

২০২২-২৩-এর মধ্যে পি এম আবাস যোজনায় ৮০ লাখ বাড়ির জন্য বরাদ্দ হয়েছে ৪৮,০০০ কোটি টাকা।

নির্মলা সীতারামন নিজে যদিও একে আগামী ২৫ বছরের ব্লুপ্রিন্ট বলেছেন, মধ্যবিত্ত যে এ বাজেটে খুশি নয় তা বোঝা যায় সারাদিন সোশ্যাল মিডিয়ায় বাজেট নিয়ে হয়ে চলা মিমের পর মিম দেখেই। বিটকয়েনের এগজিকিউটিভ চেয়ার পারসন কিরণ মজুমদার শ-ও এ কথা স্বীকার করেছেন। কোনও কোনও মিমে দেখা যাচ্ছে মুন্না ভাইকে উদ্দেশ্য করে সার্কিট বলছে, “ভাই, য়ে তো শুরু হোনে সে পেহলে হি খতম হো গয়া”; অবশ্য এবার অর্থমন্ত্রী মাত্র ৯০ মিনিটে বাজেট পেশ করেছেন–সেও একটা কারণ হতে পারে। তবে এ ছাড়াও সরাসরি মধ্যবিত্তকে উল্লেখ করে হয়েছে হরেক রকম মিম।

কিরণ মজুদারের শ-এর ট্যুইট

কিরণ শ মজুদারের ট্যুইট

 

যদিও অর্থমন্ত্রী তাঁকে অবুঝ বলে অবজ্ঞা করেছেন, তবু ট্যুইটে এই বাজেটকে জিরো সাম বাজেট আখ্যা দিয়েছেন রাহুল গান্ধী। এ সম্পর্কে মন্তব্য রেখেছেন শশী থারুরও। এই বাজেটকে তিনি অত্যন্ত নিরাশাজনক মনে করেছেন। তাঁড় মতে, “আচ্ছে দিন আরো পিছিয়ে গেল বই এগিয়ে এল না। মধ্যবিত্তের যন্ত্রণা এতটুকু লাঘব হল না।” মনীশ তিওয়ারি আরেকধাপ এগিয়ে একে বলেছেন “পানসে, বাস্তববোধহীন ও বাস্তবে প্রয়োগের অনুপযুক্ত”।

রাহুল গান্ধীর ট্যুইট

 

তৃণমূল কংগ্রেসের ডেরেক ও’ব্রায়েন এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনা করে বলেন, “হিরে ব্যাপারটার সঙ্গে এই সরকারের খুব মিতালি। বাদবাকি–কৃষক, মধ্যবিত্ত, দিনমজুর, বেকারদের জন্য এটা পি এম (ডাজ নট) কেয়ার বাজেট।”

কংগ্রেসের প্রাক্তন ইউনিয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশ বলেন, “একদিকে জলবায়ু ও আবহাওয়া সংরক্ষণের কথা হচ্ছে, আবার আরেকদিকে রিভারলিঙ্কিং প্রজেক্টের মতো বাস্তুতন্ত্র ধ্বংসকারী ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কথাবার্তা শুনতে তো মন্দ লাগে না। কিন্তু কাজেকর্মে কী হচ্ছে সেটাই আসল। ওই ক্ষেত্রটিতে মোদি সরকার সবসময়ই কিছু না কিছু শেষ করে দিচ্ছে।”

More Articles