রাশিয়া বনাম ইউক্রেন যুদ্ধ || পারমাণিক অস্ত্র ব্যবহারের আশঙ্কা থাকছে?

যুদ্ধ এবং পারমাণবিক শক্তি–একত্রে এই দুইয়ের প্রতি মানুষের একটা বিতৃষ্ণা রয়েছে। গত শতাব্দীর হিরোসিমা নাগাসাকি সমস্ত বিশ্বের যৌথ স্মৃতিতে এখনও দগদগে। এরই মধ্যে নতুন যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন সবাই। সবথেকে বড় প্রশ্ন পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার রাশিয়া করবে কিনা? আরো একবার কি এর ভয়াবহ ফল দেখবে মানব সভ্যতা? এই আশঙ্কা কুরে কুরে খাচ্ছে বিশ্বের মানুষকে। রাশিয়ার রাষ্ট্রনায়ক কি আগেপিছু কিছু না ভেবেই এই অস্ত্র ব্যবহার করবেন? ইউক্রেন প্রসঙ্গে পুতিনের বক্তব্যে থাকা কিছু প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত এই আশঙ্কায় আরো ধুয়ো দিয়েছে।

ইউক্রেন আক্রমণের দিন কতক আগেই রাশিয়া এবং বেলারুশ কিছু পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা নিরীক্ষা করেছিল। যুদ্ধ ঘোষণার সময়েও পুতিন রাশিয়াকে পৃথিবীর পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন দেশগুলির মধ্যে অন্যতম বলেছিলেন বেশ জোর দিয়েই। যদিও সে ভাষণে মনে হয়েছিল পারমাণবিক অস্ত্রশস্ত্র রাশিয়া কেবলমাত্র আত্মরক্ষার্থেই ব্যবহার করবে। সরাসরি ইউরোপীয় দেশগুলি বা আমেরিকা যদি রাশিয়া আক্রমণ করে, তবেই পারমাণবিক শক্তির পথ বেছে নেবে তারা। কিন্তু বর্তমানে পুতিন এও জানিয়েছেন ইউক্রেন হামলায় যে সব শক্তি সরাসরি বাধা সৃষ্টি করবে তাদের অবস্থা এমন করে ছাড়া হবে যার নজির  ইতিহাসেও দুষ্প্রাপ্য। এছাড়াও ২১ ফেব্রুয়ারি সম্প্রচারে পুতিন অভিযোগ আনেন ইউক্রেনের বিরুদ্ধেও–ইউক্রেনের শীর্ষ নেতৃত্বও পারমাণবিক অস্ত্রশস্ত্র নাকি তৈরি রেখেছে। যা সর্বৈব মিথ্যা। এ নিয়ে ফের উদ্বেগ বাড়ে ২৭ ফেব্রুয়ারির পর। সেদিন পুতিন ঘোষণা করেন রাশিয়ার পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারকারী সেনাদের সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। যে কোনও মুহূর্তে তাদের প্রয়োজন হতে পারে।

যদিও রাশিয়া জানিয়েছে নেটোর পদস্থ আধিকারিকেরা রাশিয়ার দিকে যে বয়ান ছুঁড়ে দিচ্ছিল তার জবাবেই এই হুঁশিয়ারি। সন্দেহ করা হচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেদের শ্লথ গতি এবং বিভিন্ন দেশগুলির জারি করা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞায় মানসিকভাবে খানিকটা বিপর্যস্ত রাশিয়া। ব্রিটেনের সুরক্ষাসচিব বেন ওয়ালেস পুতিনের আচরণকে ‘চোখে ধুলো দেওয়ার চেষ্টা' বলে আখ্যা দিয়েছেন। সত্যিই কি তাই? কেবল ফাঁপা হুমকি? নাকি এ নিয়ে সত্যি সত্যি আতঙ্কিত হওয়ার অবকাশ আছে? বিশেষত যুদ্ধে পরাজিত হলে রাশিয়া কি পারমাণবিক অস্ত্রকেই হাতের পাঁচ হিসেবে বেছে নেবে?

এই প্রশ্নের উত্তর খানিক পাওয়া যাবে রাশিয়ার সামরিক কৌশলটিতেই। এ পর্যন্ত রাশিয়ার অবস্থান লক্ষ্য করে বিশেষজ্ঞরা কিছু আনুমানিক সিদ্ধান্তে পৌঁছতে সক্ষম হয়েছেন। বিশেষজ্ঞরা সামরিক ক্ষেত্রটিতে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের কৌশল এবং উপকৌশলকে প্রাথমিকভাবে আলাদা করে দেখছেন। পারমাণবিক অস্ত্র কৌশলের দুটি প্রধান গুরুত্ব রয়েছে। প্রথমত, হাতের পাঁচ হিসেবে। রাশিয়া অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়লে বাঁচার শেষ উপায় হিসাবে তারা এই অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে। অথবা পারমাণবিক হামলা করে রাশিয়াকে শেষ করে দিতে পারে এমন দেশকে নিষ্ক্রিয় করার জন্যেও তারা হামলা চালাতে পারে। দ্বিতীয়ত, পারমাণবিক হামলার হুমকি রাশিয়াকে একটি নিরাপদ যুদ্ধের অবকাশ দেয়। যাতে বাইরের কোনও শক্তি যুদ্ধের ক্ষেত্রে রাশিয়াকে বাধা না দিতে পারে–তা নিশ্চিত করে। অপরদিকে উপকৌশল পদ্ধতির অস্ত্র ব্যবহার রাশিয়ান সামরিক শক্তির আভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রটিকে আরো মজবুত করে। বিশেষত ১৯৯০ থেকে ২০০০–এ পর্যায়ে এই বিশেষ পদ্ধতির সাহায্যেই মসকৌ সামরিক শক্তির পরিকাঠামোগত দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠে। কিছু রাশিয়ান কৌশলবিদের মতে সীমিত পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার অত্যন্ত যুক্তিযুক্ত। এর একচুল এদিক ওদিক হলেই নেটোর যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হওয়ার একটা সুযোগ তৈরি হত। এবং একত্রিত ভাবে এই দেশগুলির শক্তি অবশ্যই রাশিয়ার থেকে বেশি। তাতে ইউক্রেন জোটেরই সুবিধা হত আখেরে। বর্তমানে এই নিয়ে একটি বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। একদল মনে করছেন উপকৌশলগত পদ্ধতিতে রাশিয়া পারমাণবিক হামলা করতে পারে যুদ্ধে শীঘ্র জয়লাভের জন্য।

যদিও এই ধরনের চিন্তাভাবনা অত্যন্ত যুক্তিহীন। কারণ রাশিয়ার বক্তব্যে কোথাও সামরিক শক্তি এই কৌশলগত অবস্থানে যেতে পারে তার আভাস নেই। মূলত দুটি ভুল অনুমানের উপর এই জাতীয় সিদ্ধান্ত দাঁড়িয়ে রয়েছে, যে রাশিয়ার মূল সামরিক শক্তি অত্যন্ত দুর্বল, তাই তাকে পারমাণবিক শক্তির সাহায্য নিতে হবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে এককালে সত্যিই বেশ দুর্বল থাকলেও বর্তমানে রাশিয়ার সামরিক শক্তি মোটেও দুর্বল নয়। এবং দ্বিতীয়ত সরাসরি বাকি দেশগুলির উপর পারমাণবিক আক্রমণের তেমন কোনও সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না বলে মনে করছেন অনেকেই, কিন্তু যদি বাঁচার আর পথ না থাকে তবে এই পারমাণবিক অস্ত্রে ভরপুর পৃথিবীতে সরাসরি পারমাণবিক আক্রমণ হবে না—এও আকাশ কুসুম চিন্তামাত্র।

পারমাণবিক হামলার জুজু দেখিয়ে পশ্চিমী দেশগুলিকে দূরে রাখতে চাইছে রাশিয়া যুদ্ধের শুরু দিন থেকেই। বর্তমানে পশ্চিমী দেশগুলির সবথেকে বড় হাতিয়ার হল অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। কিন্তু এরও কিছু বিপজ্জনক দিক রয়েছে। যাবতীয় অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার ফলে যদি রাশিয়ার জাতীয় অর্থনীতি ভেঙে পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়, তবে রাশিয়ার অভিজাত বর্গ ইউক্রেনের দখল নিতে আরও মরিয়া হয়ে উঠবে। এই অবস্থায় ইউক্রেনের ওপর সীমিত পারমাণবিক আক্রমণের আশঙ্কাও আরো বাড়বে। এই জন্যই যাবতীয় রাশিয়ার নিষেধাজ্ঞা যুদ্ধের উপর হওয়াই বাঞ্ছনীয়, রাশিয়ার জাতীয় রাজনীতির বিরুদ্ধে নয়। তবে পরিস্থিতি দিনদিন আরও ঘোরালো হয়ে চলেছে। আমেরিকার আধিকারিকেরা সতর্ক করেছেন, প্রয়োজন হলে রাশিয়া শুধু পারমাণবিক নয়, জৈবিক অস্ত্রও ব্যবহার করতে পারে। যুদ্ধজয়ের জন্য রাশিয়া যে কী পদক্ষেপ নেবে তা নিয়ে আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

More Articles