CAA-র পর বিজেপির NRC-জিগির! বাংলা-বিহার-ঝাড়খণ্ডে যে সঙ্কটের মুখে মুসলিমরা

CAA Implementation: তবে এই সিএএ আইন সে রাজ্যে বসবাসকারী শেহশাহবাদিয়া মুসলিমদের উদ্বেগ বাড়িয়েছে ব। ইতিমধ্যেই বিজেপি নেতামন্ত্রীরা এনআরসি কার্যকর করার জন্য চাপ বাড়াচ্ছে।

দেশ জুড়ে ভোটের আগে কার্যকর করে দেওয়া হল সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট (CAA)। বিজেপির তরফে আঁচ মিলেছিল আগেই। তবে এর আগে এনআরসি-সিএএ নিয়ে যে বিক্ষোভ-আন্দোলন দেখেছে দেশ, তাতে ভোটের আগে এমন একটা বিতর্কিত বিল বিজেপি সরকার কার্যকর করতে পারে বলে ভাবতে পারেনি অনেকেই। চার বছর আগেই এই আইন পাশ করিয়েছিল কেন্দ্র। তবে তা কার্যকর হল ২০২৪ লোকসভা ভোটের ঠিক আগে আগে।

বিজেপি সরকারের এই সিদ্ধান্তে খুশি মতুয়ারা। বাংলায় মতুয়া ভোট তুলতে অনেকটাই কাজে আসবে বিজেপির এই স্ট্র্যাটেজি। কিন্তু অন্য দিকও তো রয়েছে। ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গ থেকে শুরু করে বিজেপিশাসিত অসমে পর্যন্ত শুরু হয়ে গিয়েছে সিএএ বিরোধী বিক্ষোভ। এম কে স্ট্যালিন থেকে শুরু করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো অবিজেপি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা জোর সরব হয়েছেন এই সিএএ আইনের বিরোধিতায়।

১৯৫৫ সালের যে নাগরিকত্ব আইন ইতিমধ্যেই ছিল, তাকে অনেকখানি সংশোধন করা হয়েছে নতুন এই সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্টে। নতুন আইনে বলা হয়েছে, ২০১৪ সালের ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তানের মতো দেশ থেকে যে সমস্ত অমুসলিমরা অর্থাৎ হিন্দু, শিখ, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সি সম্প্রদায়ের মানুষ ধর্মীয় অত্যাচারের কারণে এ দেশে আশ্রয় নিয়েছেন, তাঁদের নির্দিষ্ট নথি ও শর্ত মিলিয়ে নাগরিকত্বের শংসাপত্র দেবে ভারত। অর্থাৎ সকলেই আছেন, বাদ শুধু মুসলিমরাই। অথচ যে দেশগুলির নাম করা হয়েছে আইনে, তারা সকলেই মুসলিম রাষ্ট্র। সেখান থেকে মুসলিম শরণার্থীদের আসার সম্ভাবনাই তো বেশি। কিন্তু হিন্দি রাষ্ট্রের স্বপ্নে বুঁদ মোদি সরকার সমূলে বাদ দিতে চান সমস্ত মুসলিমদের। অর্থাৎ সমস্ত হিন্দু ভোটকে এই লোকসভা নির্বাচনে একজোট করাই মূল লক্ষ্য।

আরও পড়ুন: মতুয়ারা হাসছেন, অসম ফুঁসছে! কেন বিজেপি শাসিত অসমে CAA-র তীব্র বিরোধিতা?

যদিও মোদি সরকার আশ্বাস দিয়ে জানিয়েছে, ভারতীয় মুসলিমদের আশঙ্কার তেমন কোনও কারণ নেই। ভয় তাঁদের, যাঁরা অনুপ্রবেশকারী। তবে শুধু সিএএ তে শেষ নয়। এই জল আরও অনেক দূর এগোবে বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। ইতিমধ্যেই বিহার ও ঝাড়খণ্ড ও বাংলায় বিজেপি দাবি তুলতে শুরু করেছে এনআরসি প্রয়োগেরও। বিজেপির দাবি, এই তিন রাজ্যে বাংলাদেশের অনুপ্রবেশকারীরা বেআইনি ভাবে থাকছেন। ফলে সেখানে এনআরসি কার্যকর করা হোক। এমনকী এই তিন রাজ্যের জনসংখ্যার একটা বড় অংশ দখল করে রেখেছে শেরশাহবাদিয়া মুসলিমরাই। তাদেরকেই বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করছে এই তিন রাজ্যের বিজেপি।

বিহারের কিসানগঞ্জ, পূর্ণিয়া-সহ একাধিক এলাকায় শেরশাহবাদিয়া মুসলিমেরা রয়েছেন বিভিন্ন সূত্রের খবর। পশ্চিমবঙ্গের মালদহ, মুর্শিদাবাদ, উত্তর দিনাজপুর, বীরভূমেও জনঘনত্ব রয়েছে তাঁদের। ঝাড়খণ্ডের সাহেবগঞ্জ ও পাকুর জেলাতেও একই ছবি বলে দাবি করেছে বিজেপি। সর্বভারতীয় শেরশাহবাদিয়া অ্যাসোসিয়েশনের তরফে মহম্মদ ইকবাল জানিয়েছেন, বাংলা, বিহার ও ঝাড়খণ্ডের ওই সব এলাকাগুলিকে বেশিরভাগ সময়েই বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা নিশানা করে। এই সব এলাকায় শেরশাহবাদিয়া মুসলিমের সংখ্যা বেশি বলেও জানা গিয়েছে। এর চেয়েও বেশি সমস্যা সাঁওতাল পরগনা এলাকাগুলিতে।

দেশ জুড়ে সিএএ বিজ্ঞপ্তি জারির পরেই ঝাড়খণ্ডের সাঁওতাল পরগনার সাহেবগঞ্জ জেলার রাজমহল কেন্দ্রের বিজেপি বিধায়ক অনন্ত ওঝা বলেছেন, এবার এনআরসি কার্যকর হবে। যতক্ষণ না তা হবে, তারা ধারাবাহিক ভাবে সেই দাবি জানিয়ে যাবেন। অনন্ত জানান, এটা শুধু নির্বাচনী সমস্যা নয়। পশ্চিমবঙ্গে তো বটেই, তার সঙ্গে সঙ্গে ঝাড়খণ্ডের সীমান্ত সংলগ্ন এলাকাগুলিতে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের ভিড় বাড়ছে। অবৈধভাবে মানুষ সেখানে বাস করছে। এনআরসি হলেই তাঁদের চিহ্নিত করা সম্ভব হবে। সিএএ কার্যকর করার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে অনন্ত-সহ বহু বিজেপি নেতারই বক্তব্য, ঝাড়খণ্ড তো বটেই, গোটা দেশ জুড়েই উদ্বাস্তু মানুষেরা নাগরিকত্ব পাবেন এই আইনবলে।

তবে এই সিএএ আইন সে রাজ্যে বসবাসকারী শেহশাহবাদিয়া মুসলিমদের উদ্বেগ বাড়িয়েছে বলেই জানাচ্ছেন ঝাড়খণ্ডের শেরশাহবাদিয়া অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য মহম্মদ ইকবাল। বিশেষত সাঁওতাল পরগনার মুসলিমদেরই উদ্বেগ বেড়েছে। ইতিমধ্যেই বিজেপি নেতামন্ত্রীরা এনআরসি কার্যকর করার জন্য চাপ বাড়াচ্ছে। জাতীয় নাগরিক পঞ্জি বা এনআরসি হল ভারতের কোনও রাজ্যে বসবাসকারী প্রকৃত নাগরিকদের খতিয়ান। জাতীয় নাগরিক পঞ্জিতে প্রকৃত ভারতীয়দের নাম নিবন্ধন করা হয় এবং জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া হয়। ইতিমধ্যেই অসমে এই আইন কার্যকর করা হয়েছে। এনআরসি-র ফলে ২০১৯ সালে হিন্দু ও মুসলমান-সহ প্রায় দুই মিলিয়ন লোক নাগরিকত্বের তালিকা থেকে বাদ পড়েছিল।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো অনেকেই দাবি করেছেন, দেশ জুড়ে এনআরসি চালু করার প্রথম ধাপ এই সিএএ। মমতা আরও বলেন, ইচ্ছে করেই রমজান মাস শুরুর প্রথম দিনটাকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল সিএএ বিজ্ঞপ্তির জন্য। বিভাজনের রাজনীতিকেই আরও ব্যাট চালিয়ে খেলার চেষ্টা করছে বিজেপি, এমনটাই অভিযোগ করেছেন মমতার মতোই আরও অনেকে। প্রশ্ন উঠেছে, আফগানিস্তান এলেও কেন সিএএ তালিকায় মায়ানমারের নাম এল না। মায়ানমারও তো ভারতের সীমান্তের মধ্যেই পড়ে। একে রাজনীতির খেলা বলেই মনে করেছেন মমতা।

আরও পড়ুন: CAA: নাগরিকত্বের নামে ভোট টানতে হিন্দুদের মধ্যেই বিভাজন করে ফেলছে বিজেপি?

এনআরসি আর সিএএ-র মধ্যে তেমন কোনও মিল নেই বলে আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। সিএএ-র সঙ্গে ধর্মীয় বিধিনিষেধ রয়েছে। তবে এনআরসি-র ক্ষেত্রে তেমনটা নেই বলেই দাবি করেছেন শাহ। এনআরসি বাস্তবায়িত হলে যে কোনও নাগরিককে ভারতীয় হওয়ার নথি জমা করতে হবে। যদিও এই মুহূর্তে কেন্দ্রের তরফে এনআরসি চালু করার কোনও ইঙ্গিত মেলেনি। তবে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও ঝাড়খণ্ডের মতো বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া এলাকাগুলিতে ইতিমধ্যেই রাজ্য-বিজেপি এনআরসি-র দাবি জানাতে শুরু করেছে। সিএএ জারির পরে দেশ জুড়েই মুসলিমদের মধ্যে আতঙ্ক বেড়েছে। আদতে মুসলিমদের শঙ্কা বাড়িয়ে হিন্দুত্বের জিগির তোলাই কি ভোটের আগে আসল উদ্দেশ্য বিজেপির। তার উপর গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো এনআরসি দেখা দিলে কতটা বিপাক বাড়বে? বিপাক কি শুধুই মুসলিমদের? দু'ক্ষেত্রেই কি বিপদ বাড়বে না এ দেশে বসবাসকারী সাধারণ বাসিন্দাদের। আসলে ভারতের যে চিরকালীন ঐক্যের সুর, তাকে ভেঙেচুরে শেষ করতে চাইছে বিজেপি? তিন রাজ্যের বিজেপির এনআরসি দাবির মধ্যে উস্কে উঠেছে যেসব প্রশ্ন।

More Articles