সীমান্তে নিঃশ্বাস ফেলছে চিনা ফৌজ! এই অভিনব নিরাপত্তা বলয়ই ভারতের হাতিয়ার
3D Defence System: সীমান্ত অঞ্চলে চিনের গতিবিধির ওপর নজর রাখতেই এই বিশেষ ধরনের নিরাপত্তা বলয় তৈরি করেছে ভারতীয় সেনা।
২০২০ সালের মে মাস থেকেই লাদাখ সীমান্তে চিন তাদের সেনা সমাবেশ বাড়িয়েছে বলে দাবি একাংশের। সে-বছরই জুন মাসে ভারতীয় সেনার সঙ্গে চিনের সেনাদের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষও হয়। অভিযোগ, তারপরেই ওই এলাকায় চিনের সেনা তাদের নিয়ন্ত্রণ ক্রমশই বাড়িয়েছে। বিরোধী নেতাদের বক্তব্য, ভারতের একাধিক পোস্ট চিনা সেনার নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় ভারতীয় সেনাকে পিছিয়ে আসতে হয়েছে। এই নিয়ে দু’দেশের মধ্যে বেশ কয়েকবার বৈঠক হলেও তাতে নাকি সুরাহা হয়নি। কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকার অবশ্য আগাগোড়াই চিনের এই আগ্রাসন নিয়ে নীরব রয়েছে। এদিকে লাদাখের পাশাপাশি অরুণাচল সীমান্তেও তারা সেতু, সড়ক তৈরি করে পরিকাঠামো মজবুত করছে। আমেরিকা ভারতকে এই নিয়ে সতর্ক করার পরে বিষয়টি নিয়ে ‘আমরা লক্ষ রাখছি’ জাতীয় মন্তব্যের বেশি কিছু করেনি বিদেশ মন্ত্রক। আমেরিকা মনে করে, চিন যেভাবে ভারতের চারপাশে নিজেদের উপস্থিতি বাড়াচ্ছে, তা নিরাপত্তার পক্ষে উদ্বেগের। ভারত যে নেহাতই বসে নেই, অবশেষে তার প্রমাণ মিলল। কী সেই পদক্ষেপ?
ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার-ইন-চিফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল হরপাল সিং সীমান্তে স্থায়ী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে এক বিবৃতি সামনে এনেছেন। তিনি জানান যে, প্রথমবারের মতো একটি প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর অঞ্চলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কর্পস অফ ইঞ্জিনিয়ার্স দ্বারা একটি থ্রিডি-প্রিন্টেড স্থায়ী নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা হয়েছে। সীমান্ত অঞ্চলে চিনের গতিবিধির ওপর নজর রাখতেই এই ধরনের নিরাপত্তা বলয় তৈরি করেছে ভারতীয় সেনা।
ইঞ্জিনিয়ার-ইন-চিফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল হরপাল সিং জানিয়েছেন যে, এই ধরনের থ্রিডি নিরাপত্তা বলয় প্রতিরক্ষা বিস্ফোরণ প্রতিরোধ করতে সক্ষম। পাশাপাশি এই ধরনের থ্রিডি নিরাপত্তা বলয় ৩৬-৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তৈরি করা যেতে পারে। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় স্থানান্তর করা যেতে পারে। এর সঙ্গে, পূর্ব লাদাখেও একইরকম স্থায়ী প্রতিরক্ষা-সংক্রান্ত একাধিক পরীক্ষা করা হয়েছে, এবং তা প্রয়োজনীয় বলে প্রমাণিত হয়েছে।
আরও পড়ুন: আকাশপথে হঠাৎ উধাও! আজও খোঁজ মেলেনি এই রহস্যময় বিমানের
কেন সেনার এই পদক্ষেপ
সেনা সূত্রে খবর, এখনও সীমান্তে ৫০ থেকে ৬০ হাজার লাল ফৌজ সীমান্তের কাছাকাছি অঞ্চলে অবস্থান করছে। চিনের পিএলএস সেনাবাহিনীর ট্যাঙ্ক, কামান, ক্ষেপণাস্ত্র এবং বিমানগুলিও এলএসি-র কাছাকাছি অবস্থান করছে। দেশের প্রতিরক্ষার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত উচ্চপদস্থ সূত্রের মতে, গত দুই বছরে, অর্থাৎ গালোয়ান উপত্যকায় হিংসার পর ভারতীয় সেনা চিনের বিরুদ্ধে সবরকমভাবে নিজেদের তৈরি রেখে চলেছে।
সেনা সূত্রে খবর, গত দুই বছরে ২২-২৪ হাজার অতিরিক্ত সেনা সীমান্তে মোতায়েন করা হয়েছে। তার জন্য বিশেষ আবাসন সুবিধা প্রস্তুত করা হয়েছে। এই সেনা জওয়ানদের জন্য, ভারতীয় সেনাবাহিনী এমন মডুলার-শেল্টার তৈরি করেছে, যা মাইনাস (-) ২০ ডিগ্রি শীতেও ১৫ ডিগ্রি তাপমাত্রা প্রদান করে দেয়। এছাড়াও, এগুলি এমন আশ্রয়কেন্দ্র, যা এক সপ্তাহের মধ্যে তৈরি করা হয়। প্রয়োজনে অন্য জায়গায়ও নিয়ে যাওয়া যেতে পারে।
এই বছরের জুনে ভারতকে সতর্ক করে আমেরিকাও। ভারতের সঙ্গে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বরাবর চিন তাদের সামরিক অবস্থান ক্রমশ দৃঢ় করছে বলে ফের উদ্বেগ জানায় আমেরিকা। এর আগেই প্যাংগং লেকের কাছে চিনের পরিকাঠামো নির্মাণ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল আমেরিকা। এরপর সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত ‘শাঙ্গরি লা ডায়লগ’-এ বক্তব্য রাখতে গিয়ে আমেরিকার প্রতিরক্ষা সচিব লয়েড জেমস অস্টিন জানান, দক্ষিণ চিন সাগরে নিজেদের এলাকা বলে দাবি করা জায়গাগুলিতে আগ্রাসী এবং বেআইনি পদক্ষেপ করছে চিন। তাদের নৌবহরও বেআইনিভাবে এলাকা দখলে সক্রিয় হচ্ছে। এরপর ভারতও তলে তলে তৈরি হতে থাকে।
কী এই থ্রিডি নিরাপত্তা বলয়
সীমান্ত অঞ্চলে চিনের গতিবিধির ওপর নজর রাখতেই এটি করা। ইঞ্জিনিয়ার-ইন-চিফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল হরপাল সিং জানিয়েছেন এমনটাই। পূর্ব লাদাখ সংলগ্ন এলএসি-তে চিনের প্রস্তুতির পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় সেনাবাহিনীও যে কোনও রকম পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রস্তুত রয়েছে। ট্যাঙ্ক এবং কামানগুলিকে শত্রুদের চোখ থেকে রক্ষা করতে গালোয়ান উপত্যকা-সংলগ্ন DSDBO-তে ট্যাঙ্ক ব্রিজ এবং নতুন এয়ার-ফিল্ড প্রস্তুত করা হচ্ছে।
এই জিনিসটি স্থানান্তর করা যেতে পারে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। এর জন্য স্থায়ী প্রতিরক্ষা-সংক্রান্ত একাধিক পরীক্ষা করা হয়েছে, যা প্রয়োজনীয় বলে প্রমাণিত হয়েছে। পূর্ব লাদাখ-সংলগ্ন এলএসি-তে চিনের প্রস্তুতির জন্য এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। ট্যাঙ্ক এবং কামান তৈরি আছে। ২৪,০০০ সেনাও প্রস্তুত আছে। সীমান্তের কাছাকাছি অঞ্চলে অবস্থান করছে ৫০ থেকে ৬০,০০০ চিনা সেনা। উচ্চপদস্থ সূত্র বলছে যে, গালোয়ান উপত্যকায় হিংসা ছড়িয়েছে চিন। সেই সময় থেকে ভারতীয় সেনা নিজেদের তৈরি রেখে চলেছে চিনের বিরুদ্ধে।
শত্রুর হাত থেকে বাঁচতে ৪৫০টি ট্যাঙ্ক, কামান এবং সামরিক-যান রক্ষার জন্য প্রযুক্তিগত স্টোরেজ তৈরি করা হয়েছে। এর স্ট্রাকচার প্রভাবিত হয় না শত্রুর ট্যাঙ্কের বুলেট দ্বারাও। এগুলি হলো থ্রিডি পার্মানেন্ট ডিফেন্স। ভারত এটি পরীক্ষা করেছে ট্রায়াল চলাকালীন। ভারতীয় সেনাবাহিনী ১০০ মিটার দূর থেকে একটি শেল নিক্ষেপ করে টি-৯০ ট্যাঙ্ক থেকে। ভারতীয় সেনাবাহিনী গান্ধীনগরে অবস্থিত আইআইটি এবং কিছু স্টার্ট-আপের সাহায্য নিয়েছে এই থ্রিডি পার্মানেন্ট ডিফেন্স স্ট্রাকচার তৈরির জন্য। প্রচণ্ড ঠান্ডাও এই ট্যাঙ্কের কর্মক্ষমতা প্রভাবিত করে না।
এদিকে পাকিস্তান সীমান্ত থেকেও ভারতের বেশি নজর এখন চিনা সীমান্তে। এর আগে ভারতীয় সেনাবাহিনীর নতুন প্রধান জেনারেল মনোজ পান্ডে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা সম্পর্কে চিনকে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছিলেন। তিনি সাফ জানিয়েছিলেন যে, সীমান্তে অন্যায় সহ্য করা হবে না। এই আবহে ভারতীয় সেনাবাহিনী লাদাখ সেক্টর থেকে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার কাছে সেনাবাহিনীর ছয় ডিভিশন সৈন্যকে স্থানান্তর করেছে। তবে দুই বছরের বেশি সময় ধরে সৈন্য বদলির প্রক্রিয়া চলছে। জানা গেছে, এখনও পর্যন্ত ৩৫ হাজার সেনাকে চিন সীমান্তে স্থানান্তর করা হয়েছে। ভারত যে নেহাত নিষ্ক্রিয় নয়, তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল।